• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে দেবব্রত রায় (পর্ব – ২)

ভুলভুলাইয়া-র হাট

(আগের ঘটনা) 

আমি সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে তাকে বললাম, “….কিন্তু, এটার কী হবে?” আমার কথা শুনে লোকটা এবার একটু থামলো তারপর, আগের মতোই তার সেই  হলদেটে দাঁতগুলো বের করে হাসিহাসি মুখে বললো, ” সাইকিল সারানোর দুকানট ইকটুক দূর আছে বট্যা । তা আপুনি অই পুব পানে তাকিয়ে দাঁড়ান কেনে, হুই পথ-ই সজা আপনেকে সাইকিল সারানোর দুকানটতে পৌঁছি দিবেক! ” তারপর, নিজের মনেই সে বিড়বিড় করে বলে উঠলো।  ,….তব্যা, সিখেনে যাবার সময় পুটুলিতে করে ইকটুক লবণ লিয়ে যাবেন।  দু-চারটা কড়ি অদবা, কয়েকটা জালখাটি যদি পেতেন…

(পর্ব – ২ )

লোকটার ওই অদ্ভুতধরনের কথাবার্তা শুনে আ -মার কেমন যেন ওকে ছিটেল বলে মনে হলো! আমি সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা পরিবেশে লোকটার প্রায় নাগালের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনেমনে বেশ নার্ভাস ফিল করলাম ! কোনোদিন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনি কিন্তু, এই মুহূর্তে ভীষণভাবে চাইছিলাম স্বয়ং ঈশ্বর না হোক  অন্তত ,আর কেউ এসে আমাকে এই সমস্যার থেকে উদ্ধার করুক !  কিন্তু ,সেই মুহূর্তে আসেপাশে এমন কি, বহু দূর পর্যন্ত অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেও কাউকেই দেখতে পেলাম না বরং  , এদিকওদিক তাকাতে গিয়েই আমার নজরে পড়লো একটু তফাতে রাস্তার ধারে-ই একটা মাছধরা জাল শুকোতে দেওয়া আছে। মনের ভিতরে সামান্য দ্বিধা নিয়েই আমি লোকটাকে বললাম, ” ওই তো জাল, কিন্তু….”  আমার কথা শুনে সেই লোকটাও পিছন ফিরে জালটা দেখল তারপর, বললো, ” আসেন, আমার সাথে আসেন! ” কথাগুলো বলেই , সে এগিয়ে গেল তারপর, একটা চালাঘরের উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে কার উদ্দেশ্যে যেন হাঁক পেড়ে বললো, ” কাকি, লোতন বাবুর  লেগে চারটা জালখাটি  লিচ্চি-গ! “
ভিতর থেকে কোনও প্রত্যুত্তর আসার আগেই , লোকটা সেই মাছধরা জালটার সামনে উবু হয়ে বসে আমাকে আবারও যারপরনাই  হতবাক করে কপালে হাত ঠেকিয়ে একটানা মন্ত্রের মতো  কী-সব যেন বিড়বিড় করে বলে জালটাকে প্রণাম করলো তার -পর, সেখান থেকে গুনে গুনে চারটে জালকাঠি নিয়ে একটা নেকড়ার পুঁটলিতে বেঁধে দু-চারবার  আমার গায়েমাথায় বুলিয়ে কোনোরকম ইতস্তত বোধ না- করেই নিজের হাতে সেগুলো আমার পকেটে পুরে দিয়ে সে বললো, ” যান, সজা হুই পথ ধরে এগালেই ভুলভুলাইয়া-র হাট। সিখেনে জরা শিমুলগাছের তলায় আপনের সাইকিল সারানর মানুষট বুসে আছেন বট্যা !  “
ভুলভুলাইয়া-র হাট!  ভাবলাম, বেশ নাম তো হাটটার!
লোকটাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়ে একরাশ কৌতুহল নিয়ে আমি হাঁটা দিলাম ভুলভুলাইয়া -র হাটের দিকে।
বাদামিরঙের পাথর বিছানো রাস্তার দুপাশে যতদুর চোখ যায় শুধুই কার্পেটের মতো ঢেউ খেলা -নো সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ মাঠ! আর, সেই বিশালাকৃ -তির তৃণভূমি জুড়ে  প্রায় দশ-পনেরো হাত ছাড়াছা -ড়া-ই  তমাল পাইন পিয়াশাল জুনিপার হেমলক বির্চ গাছগুলি যেন পথিকের শ্রান্তি নিরাময়ের আঁকুতিতে একেকটি  ছত্রালয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে !
বিকালের প্রারম্ভিক আলোয় রাস্তার থেকেই বিস্তীর্ণ সেই সবুজ ভূমি-র একেবারে শেষপ্রান্তে ঘন জঙ্গলের কুয়াশাচ্ছন্ন  দিগন্তরেখার সামনে দাঁড়িয়ে হটাৎ-ই নিজেকে যেন বড়ো-ই ক্ষুদ্র মনে হলো আমার! আমি সেই বিশাল দিগন্তরেখাটির দিকে  মুগ্ধদৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে-ই আবারও সাইকেলটা নিয়ে ভুলভুলাইয়া-র দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তার দুপাশে গজিয়ে ওঠা বনসাই আকৃতির ঝোপগুলোর আসেপাশে লক্ষ্য করলাম, লাল হলুদ রঙের নরম পালকে মোড়া  একপাল গোল গুবগুবে মুরগী ছড়িয়েছিটিয়ে চরে বেড়াচ্ছে ! দেখামাত্র-ই, মনের ভিতরে ওদেরকে যেন ভীষণ আদর করার একটা অদম্য ইচ্ছে  পেয়ে বসলো আমাকে ! আমি সেই গাঢ় সবুজ রঙের ছোটোছটো ঝোপগুলোর আসেপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা অদ্ভুত ধরনেরর মুরগীগুলোর দিকে মুগ্ধ-দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই লক্ষ্য করলাম, আমার চারদিক ঘিরে  অদ্ভুত এক রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে! নরম রোদ্রুতে ভেসে যাওয়া আদিগন্ত সবুজ মাঠ, গাছ-গাছালি সবকিছুই যেন সেই রঙের খেলায় মেতে ধীরেধীরে আসন্ন গোধুলিবরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে !
সেই  বিচিত্র রঙের খেলা দেখতে দেখতে হটাৎ , একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল হতেই আমি  ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম! লক্ষ্য করলাম পাম্পহীন সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে এতখানি পাহাড়ি-পথ বেয়ে আসা সত্ত্বেও , আমার যেন সামান্য ক্লান্তিটুকুও অনুভব হচ্ছে না! আমি যেন সম্পূর্ণ অতীতহীন হয়ে হিলিয়ামগ্যাস ভর্তি একটা বেলুনের মতো হাওয়ার স্রোতে ভাসতে ভাসতে বাধাহীন এগিয়ে চলেছি !  আমার জীবনে যেন পুরানো কোনো ব্যাথা নেই, কোনো আঘাত নেই, তার বদলে একটা পক্ষীরাজঘোড়া যেন আমার বুকের ভিতরে ডানা ঝাপটিয়ে খচমচ করে উড়ে বেরাচ্ছে !

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।