• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুব্রত বসু (পর্ব – ২)

আমার নাটক, নাটকের আমি

(২)

কি বললে পাড়ার নাটক?”

“হ্যাঁ। কোন হলে নয়, ফাঁকা জায়গায় চৌকি তক্তপোষ জুড়ে মঞ্চ তৈরী করে নাটক, তোমার বাবা  কাকাকে জিজ্ঞাসা করে দেখো না তাঁরাও মাচা তৈরী করে অভিনয় করেছে। হয় দুর্গাপুজো  প্যান্ডেলে ধারে  কিংবা ডিসেম্বর মাসে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে নাটক করার হিড়িক পড়ত”।
“তখন গ্রুপ থিয়েটার ছিল না?”
“ছিল হয়তো, তবে ওসব নিয়ে মাথা ঘামানো  অনেক পরের কথা, বাঙ্গালীর মাথায় অভিনয় করার সুপ্ত বাসনা  কিন্তু আজকের নয়। শুধু বাবা কাকা নয়, ঠাকুর্দা কিংবা তাঁর ভাই টাই জীবিত থাকলে তাঁরাও বলবেন যাত্রা করার কথা,মেয়েদের তো বিনোদন বলতে কিছু ছিল না,চিকের আড়াল থেকে যাত্রা দেখা,শিক্ষা তো সেভাবে প্রসার লাভ করেনি তাই  ঠাকুর বলেছিলেন  না যাত্রায় লোক শিক্ষে হয়”।
“যাত্রা বলতে খোলা মঞ্চে অভিনয়, সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রী দেখার জন্যে লোকে এখনো তো  ভিড় করে”।
“আরে দূর ওটা  একটা খিচুড়ি, না যাত্রা না থিয়েটার, আগেকার যাত্রায় দর্শকের মাঝখানে অভিনয়,তাকে বলত আসর, সেই আসরই কাহিনীর দাবী মেনে কখনো রাজসভা, কখনো রণক্ষেত্র, আবার কখনো শ্বাপদ সংকূল বনভূমি। কোন দৃশ্যপট নেই, কোন আসবাব নেই,বৈদ্যুতিক আলোর চোখ ধাঁধানো ব্যবহার নেই, হ্যাজাক কিংবা ডেলাইটের আলোয়,   শুধুমাত্র অভিনয়ের জোরে গোটা কাহিনী দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা। সেই আসর ঘিরে বসত বাজনদারদের দল , আসর থেকেই বেশ খানিকটা  সরু পথ দর্শকের মাঝখান দিয়ে  চলে গেছে একেবারে সাজ ঘরে,সেখান থেকেই আসরে হাজির হতে হত সময়মত সংলাপের সুত্র ধরে, মুখের কথা নয়, দীর্ঘ অনুশীলনের ব্যাপার।এক একজন এমনই অভিনয় করত সমবেত দর্শক উচ্চঃস্বরে ‘এনকোর এনকোর’ দিত, তার মানে সেই অভিনেতাকে আবার আসরে ফিরে এসে সেই সংলাপ পুনরায় বলতে হত,  রিপ্লের মতন।   পুরানো দিনের সিনেমা তো তোমরা দেখো না , কোন কোন ছবিতে এখনো যাত্রার দৃশ্য আছে”।
 “ সেট সেটিং থাকবে না মঞ্চ সজ্জা থাকবেনা, এরকম কোন যাত্রা আমি দেখিনি,
“দেখবে আর কোত্থ থেকে, সেই পরম্পরাটাই নেই, বাদল সরকারের নাম শুনেছ তো, তাঁর থার্ড থিয়েটারের কথা জানো না বোধহয়,  তিনিও প্রসেনিয়াম ভেঙ্গে দর্শকদের মাঝখানে নাটককে নিয়ে এসেছিলেন, যাতে অভিনেতা অভিনেত্রীরা দর্শকের  সাথে একাত্ম হয়ে অভিনয় করতে পারে। এর  ফলে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের বিশাল খরচ বেঁচে যাবে”।
“এসব নাটক জমত?”
“জমত  বৈকি, কার্জন পার্কে বাদল সরকারের এসব নাটক একসময় সাড়া ফেলে দিয়েছিল”।
“তবু তো সেটা জনপ্রিয় হল না, বিভিন্ন হলে নাট্যদল গুলি সেই মঞ্চেই অভিনয় করছে”।
“ঠিকই কথা, তবে কি জানো ওটা চালিয়ে যেতে গেলে ধক লাগে, নাটকের যে গ্ল্যামার সেটাকে বিসর্জন দিতে হয়, সকলে তো সেটা পারে না, তাই পুরানো ফর্মে ফিরে গেল,  কিন্তু তা বলে  তাঁর বিশ্বাস সেটা তো মিথ্যে নয়।সেই  ঠাকুর  রামকৃষ্ণদেবের কথা,   লোক শিক্ষা হবে বলেই তো নাটককে একেবারে দর্শকের মাঝখানে নিয়ে ফেলেছিলেন, এটা একটা মুভমেন্ট। সাফল্যটাই সবক্ষেত্রে বড় কথা  নয়।  আবার এটাও ঠিক এর ফলে আমরা একদিক থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম, বাংলা নাট্য সাহিত্য  বাদল সরকারের হাত ধরেই এবস্ট্রাক্ট নাটকের স্বাদ পেয়েছিল। এই বিষয়ে যে কোন আলোচনায় ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ও ‘বাকি ইতিহাস’ এর নাম করতেই হবে। এছাড়া বেশ কিছু ভাল মঞ্চসফল  নাটক তিনি লিখেছিলেন। থার্ড থিয়েটার শুরু করার পর তিনি এই ধরনের নাটক লেখা বন্ধ করে দিলেন।বাংলা  নাটকের ক্ষেত্রে এটা একটা ক্ষতিই বটে,  বিশেষ করে আমাদের মত নাট্যপ্রেমীদের কাছে। একথা লালুদাও বলতেন”।
“লালুদা মানে যিনি তোমার মাথায় নাটকের ভূত……”
“ছিঃ!ছিঃ! বলতে নেই ওসব কথা, নাটকের ভুত নয়, নাট্যদেবতা, তাঁর আশীর্বাদ না থাকলে অভিনয় করতে পারবে না তুমি, যত বড় অভিনেতা হও না কেন, তাঁর দয়া ভিক্ষা করতে হয়, পনেরো, কুড়ি বার অভিনয় করা নাটক, যার সংলাপ তোমার ঠোঁটস্থ, তিনি বিরূপ হলে মঞ্চে উঠে তুমি সমস্ত ভুলে যাবে। লালুদা তো বিরাট ব্যক্তিত্ব, পাড়ায় ছোটখাট নাটকে যাঁদের নির্দেশনায় আমরা নাটক করেছি, তাঁদের  ডিসিপ্লিন দেখলে চমকে যেতে হবে, মনে হবে রিহার্স্যাল রুমে সাক্ষাৎ উৎপল দত্ত বসে আছেন। আসল কথা কি জানো এটা তৈরী হত ভালবাসা থেকে।
“ খুব কড়া ছিলেন বুঝি সেই পাড়ার নাট্যপরিচালক’রা ?”
“কড়া মানে চিন্তা করতে পারবে না, পলির নেমন্তন্ন কলকাতায় দিদির ম্যারেজ এ্যানিভারসারিতে, সেইদিনেই ফাইন্যাল রিহার্স্যাল, সমীরণদা রাজি হলেন না ওকে ছাড়তে, ফাইন্যাল রিহার্স্যালে কোন প্রক্সি চলবে না। অনেক কাকুতি মিনতি রিকোয়েস্ট, কিছুতেই ভবি ভোলবার নয়, পলি রাগ করে চলে গেল, রিহার্স্যালে এল না। তিন দিন পর স্টেজ, কোন কম্প্রোমাইজে রাজি নন সমীরণদা, যাকে দিয়ে পক্সি দেয়ালেন, তাকে নিয়ে রাত দিন খেটে শো’র জন্যে তৈরী করে ফেললেন, পলিকে বাদ দিয়ে। এই হল ডিসিপ্লিন”।
“ এতো পুরোপুরি মিলিটারী শাসন ”।
“ হ্যাঁ,  রিহার্স্যাল চলাকালীন অন্ততঃ তাই, লালুদা বলতেন, শোনো নাটক ভালবাসলেই হল না, পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করতে হবে  , পারফরমিং আর্ট এমন একটা জিনিষ তাকে ছেড়ে তুমি অন্য কিছু করতে যাবে, সেই শিল্প তোমাকে ছেড়ে নিঃশব্দে চলে যাবে, তুমি জানতেও পারবে না, যখন জানবে তখন আর কিছু করার নেই “।
“তোমার কি সেই প্যাশান ছিল”?
“দূর, তাহলে তো আমাকে অন্য কোথাও দেখতে পেতে।   আমাদের মত ছাপোষাদের কি আর সেই সাহস আছে, সব কিছু ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব, সাংসারিক  দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়াকেই লোকে শুধু বিলাসিতা বলবে না, বলবে দায়িত্বজ্ঞানহীন অপদার্থ।  অথচ এ যে কি ভয়ংকর কঠিন পথ, সাধারণ লোকের  এ সম্বন্ধে কোন ধারণাই নেই।    তবে কি জানো এ এক আলাদা জীবন, তার সামান্য স্বাদ যে পেয়েছে সেটা রোমন্থন করে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যায়। এই যে পাড়ার নাটকের কথা বলছিলাম সেটাই বা কম কি।  কত স্মৃতি।
“বলো না, শুনতে ভালই লাগছে”।
“ সব কি আর মনে আছে নন্দিনী, পাড়ার নাটক ছিল বলেই না ওমন একটা মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। আমাদের সময়টা একেবারে অন্য রকম ছিল, বেকার ছেলে হয় কবিতা লিখছে, ভাবছে একটা লিটিল ম্যাগাজিন বার করবে, আবার কারুর মাথায় অভিনয় করার পোকা নড়ছে,সে ভাবছে একটা নাটক করলে কেমন হয়। এই নাটক মানেই এক দীর্ঘ প্রস্তুতি। প্রথম হল নাটক বাছাই করা, সে নাটক যেন নারীভূমিকা বর্জিত হয়”।
“কেন তা কেন?’
“ আরে বাবা নারী চরিত্র মানেই তো ফিমেল আর্টিস্ট, ভাড়া করা মহিলারা অভিনয় করবেন।  বাড়তি খরচ কে বহন করবে।এমনিই একটা নাটক নামানো কম খরচের নয়। নাটকে উল্লেখিত প্রতিটি জিনিষ যোগাড় করে দৃশ্য অনুযায়ী সাজিয়ে  রাখতে হয়, একে রিকিউজিশন বলে। এছাড়া মিউজিক আলো,হল ভাড়া, আরো টুকটাক অনেক খরচ।  সেই জন্যেই রামের অভিষেকের চেয়ে রামের বনবাসের নাটক অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য, অভিষেকের ড্রেস খরচ অনেক, বনবাসে খালি গায়ে বাকল পরিয়ে অভিনয় করানো যাবে”।
“হাসালে দেখছি, সীতাকেও কি শেষে  বাকল পরাবে নাকি”।
“ এটা একটা উদাহরণ,  ধরো  বনবাস শুরুই হবে রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে যাবার পর থেকে, হেমেন রায়ের লেখা সেই বিখ্যাত গান শোনোনি, “ কোথায় সীতা কোথায় সীতা জ্বলছে মনে স্মৃতির চিতা”।
“হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি বৈকি মান্না দে’র রেকর্ড আছে, অন্ধকারের অন্তরতে অশ্রু বাদল ঝরে”।
“ এটা শিশির ভাদুড়ীর সীতা নাটকের গান, স্টেজে মান্না দে’র কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে গাইতেন, আমরা চোখে না দেখলেও যাঁরা দেখেছেন তাঁদের মুখ থেকে শুনেছি, লালুদা এতটাই শ্রদ্ধা করতেন শিশির ভাদুড়ীর নাম উচ্চারণ করতে কখনো  শুনিনি, বলতেন বড়বাবু, বাড়ীতে বিছানার মাথার দিকের দেয়ালে শিশির ভাদুড়ীর ছবি”।
“তুমিই তো বললে সব পাড়াতেই বছরে একবার আধবার নাটক হত, পাড়ার মেয়েরা কি তাতে অংশ নিত না? তাহলে তো ফিমেল আর্টিস্টের সমস্যা মিটত”।
“পাগল হয়েছ, পাড়ার মেয়েরা পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে নাটক করবে? আকাশকুসুম কল্পনা, একলা বাড়ী থেকে খুব কমই  বেরুত তারা, ইস্কুল কলেজে গেলেও দল বেঁধে”। বিকালে কেউ ছাদে কিংবা বাড়ীর বারান্দায়। এই ভাবেই চার চক্ষুর মিলন হত”।
“তাহলে সে সময় প্রেম ছিল না বলো’।
“প্রেম কবে ছিল না নন্দিনী, সর্বকালে সর্বযুগে প্রেম ছিল, তবে সে আসত নিঃশব্দ চরণে, সমারোহ জাগিয়ে নয়, যাকগে যাক ওসব কথা বাদ দাও। নাটক তো বাছা হল এবার রিহার্স্যাল দিতে হবে, হয় কোন ক্লাব ঘরে, কিংবা কারুর বাড়ীর ছাদে। আমাদের পাড়ার রবীনবাবু, আমরা কাকুই বলতাম, ইন্ডিয়ান অক্সিজেনে চাকরী করতেন, অফিস ক্লাবের নাটকে জবরদস্ত একটি পার্ট তাঁর বাঁধা। লম্বা চওড়া চেহারা ব্যারিটোন কন্ঠস্বর, স্টেজ দাঁড়ালে দর্শক আর চোখ ফেরাতে পারত না, যে জিনিষটা ছবি বিশ্বাসের ছিল”।
“ অফিসে নাটক হত?”
“হত বৈকি, প্রত্যেক অফিসে, ব্যাঙ্কের প্রতিটি বাঞ্চে বছরে একবার স্টাফেরা নাটক করতেন, তার জন্যে ডিরেকটর, প্রম্পটার, ফিমেল আর্টিস্ট ভাড়া করা হত, অফিস শেষে রাত পর্যন্ত রিহার্স্যাল চলত। তারপর কলকাতার অফিসবাবুরা হয় স্টার,নাহয় রঙমহল , মফস্বলের অফিসবাবুরা সেই শহরের কোন হল ভাড়া করে নাটক করে আসতেন, এই সব নাটকে প্রম্পটিং করে দু’পয়সা হত আমাদের মতন বেকারদের।
“ এখন আর এসব হয় না”।
“না এখনকার অফিসবাবুরা সময় পান না, তাই রিক্রিয়েশন ক্লাব গানের অনুষ্ঠান করেন নামী দামী শিল্পীদের নিয়ে, আবার কেউ কোন গ্রুপ থিয়েটারকে দিয়ে  কল শো করান।  তবে কি জানো আমি যে সময়ের কথা বলছি, তথাকথিত অনামী ফিমেল আর্টিস্ট’রা প্রায় সকলেই গরীব ঘর থেকে উঠে আসা মহিলা, অফিস ক্লাবে নাটক করে সামান্য কিছু পয়সা রোজগার করতেন, সেটা এখন একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রুপ থিয়েটারে এখন যেসব মেয়েরা অভিনয় করেন তাঁরা সে অর্থে প্রফেসাল্যান  নয়। টিভি সিরিয়ালের হাতছানি অস্বীকার করা যায় না, একবার সেখানে মুখ দেখাতে পারলে, অভিভাবকরাও আপত্তির পরির্বতে আত্মশ্লাঘা অনুভব করবেন”।
“তারপর সেই রবীনবাবুর কি হল?”
“দেখেছ কোথা থেকে কোথায় চলে গেছি, তবে এসব তো তোমার অজানা নন্দিনী। এই রবীনকাকু ছিলেন আদ্যন্ত নাট্যমোদী মানুষ, বছরে একবার অফিস ক্লাবে নাটক করে মোটেই তৃপ্ত নন উনি, তাই আমাদের মতন অর্বাচীনদের নিয়েই শুরু করেছিলেন নাট্যপরীক্ষা। সফল বৈকি, যারা কোনদিন নাটক করেনি তারা সারা  সকাল দুপুর ইটের ওপর চৌকি তক্তপোষ সাজিয়ে,  ডেকরেটারের লোকজনের সঙ্গে সমান পরিশ্রম করে, মঞ্চ খাড়া করেছিল, তারাই আবার সন্ধ্যেবেলা মেকাপ ম্যান রবিদার কাছে মেক-আপ নিতে বসে গেল। দর্শকরা সবাই আমাদের কারুর না কারুর আপনজন। এরই মধ্যে যার সঙ্গে হয়ত চোখে চোখে কথা হয় দূর থেকে, তার জন্যে প্রতীক্ষাও মনে মনে। পরদিনের আগে জানার উপায় নেই আমাদের কীর্তিকলাপ তার চোখে ধরা পড়ল কিনা, বড়ই মূল্যবান সেই মতামত। পাড়ার এক দাদা ঘোষণা করে দিলেন তাঁর বিচারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকে পুরস্কৃত করবেন। উৎসাহ তখন তুঙ্গে, সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে হাঁটূ কাঁপা, প্রথম মঞ্চ অবতরণের উদ্‌বেগে”।
“কি নাম নাটকের”।
“শৈলেশ গুহনিয়োগীর ‘ক্যাম্প থ্রি’। কোন এক বড় কোম্পানী পান্ডববর্জিত এক জায়গায় নতুন প্রজেক্ট খুলছে, তাতে সামিল হতে একই বয়সী কিছু ছেলে কলকাতা থেকে চলেছে। সুখ দুঃখ হাসি কান্না সব মিলিয়ে নাটক। আমি হয়েছিলাম এই ছেলেগুলির কাজের সুপারভাইজার। খুব বাজে অভিনয় করেছিলাম”।
“কেন পাঠ ভুলে গিয়েছিলে”।
“না তা ভুলিনি, তবে খুবই বাজে অভিনয় করেছিলাম। অনেক পরে লালুদা বলেছিলেন এই বোধটা থাকা দরকার। যে কোন বিষয়ে এটা যে ঠিক হচ্ছে না, এই বোধটা তৈরী হওয়াই প্রাথমিক উত্তরণ। আমি পারিনি, আমার এটা হয়নি, কি করলে হবে নিজেই সেটা খুঁজতে হবে চেষ্টা করে । যতক্ষণ সে না পাবে , একটা অস্থিরতা, খচখচানি। এটা থেকেই একটা প্যাশান জন্মাবে। জানো নন্দিনী একবার এলাহাবাদ থেকে ফিরছি, সন্ধ্যেবেলায় প্রথম শো ছিল আমাদের, নাটক শেষ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেট গুছিয়ে কোনক্রমে মেকাপ তুলে সোজা স্টেশনে, বোমবে মেল ধরব, ট্রেনে উঠে মনমরা হয়ে বসে আছি। শো ভাল হয়নি, তার মানে এই নয় আমরা ডায়লগ মিস করেছি, কম্পোজিশন ভুল করেছি, কিংবা মিউজিক তার  ক্যাচিং ফেল করেছে, এসব কিছুই হয়নি। বার বার করা নাটক হবেই বা কেন। শো’এর শেষে দর্শকরাও প্রচুর হাততালি দিয়েছেন। আমাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে লালুদাই বললেন, “ কি হল মন খারাপ কেন”? কথাটা বলতে চাইছিলাম না, একে কম্পিটিশন শো, সকলেই আশা করে আছে, তবু বললাম, “ শো’টা আমাদের ভাল হয়নি লালুদা”। “কে বললে কেউ তো ভুল ত্রুটি তো করিনি”। বুঝলাম উনি আমাকে সান্ত্বনা দিতে চাইছেন।
“তা সত্ত্বেও, অভিনয় করতে করতে এটা অনুভব করেছি, কোথায় যেন একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে”।
“ সেটা একমাত্র অভিনেতা আর ডিরেকটার ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না সুবু কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেল, ঠিক জমে উঠল  না নাটকটা। এখান থেকে আমাদের শূণ্য হাতেই ফিরতে হবে। মন খারাপ করো না খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ো। সবসময় সব কিছু আমাদের হাতের মধ্যে থাকে না। তবে এটা ফিল করাটা খুব জরুরী”। পরে বুঝেছিলাম শিল্পের সর্বস্তরেই এই বোধ থাকা দরকার”।
একটু আগেই তোমাকে বলছিলাম না নন্দিনী নাট্যদেবতার কথা। কোন অলক্ষে তিনি বিচরণ করেন কেউ জানে না , একনিষ্ঠ পরিশ্রম ছাড়া তাঁর কৃপা পাবার অন্য কোন রাস্তা নেই। যারা বলে স্টেজে মেরে দেব, সেই নাটক কখনো ভাল হতে পারে না”।
“তোমার মুখে প্রথম শুনলাম নাট্যদেবতার কথা, যাঁর কথা বলতে বসেছে সেই লালুদা কি বিশ্বাস করতেন নাট্যদেবতার কথা”।
“জানি না, কখনো বলেনও নি এসব কথা, তবে ওনার মুখে বড় বড় অভিনেতাদের দুর্দান্ত অভিনয়ের কথা, নাটকের নানান ঘটনার কথা শুনে একথা আমার মনে হয়েছে।  এ আমার একান্ত অনুভূতি, তাঁর অলক্ষে অবস্থানের কথা অবিশ্বাস করতে পারিনা। আসল কথা কি জানো নন্দিনী সাধনা, নিরলস সাধনা। বড় বড় সাধকরা যেমন  সাধনার মাধ্যমে উচ্চস্তরে উপনীত হতেন, নাটকেও  সেরকম, দিকপাল অভিনেতাদের অভিনয় মিথ হয়ে গেছে”।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।