• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিশ্বজিৎ লায়েক (পর্ব – ২)

জন্মস্থান – পুরুলিয়া পেশা – সরকারি চাকরি প্রকাশিত কবিতা বই :- ১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে ২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর ৩) ভিতরে বাইরে ৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল ৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি ৬) কৃষ্ণগহ্বর ৭) শরীরে সরীসৃপ ৮) প্রেমের কবিতা ৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর ১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম উপন্যাস ১) কৃষ্ণগহ্বর

পূর্ব প্রকাশিতের পর…

এতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়েছিল সুনয়। না,আকাশে কোনো মেঘের চিহ্ন নেই। মানে বৃষ্টি হবে না। এই কড়োর পাহাড়ে দাঁড়িয়ে তার মনে অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। নিজেকে ভয়শূন্য মনে হয়। মনে হয় কেউ কোথাও নেই। আমি! না,  আমিও নেই। সব শূন্য আর শূন্য। এই শূন্যতার মধ্যে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে সুনয় নিজেকে পায়নি, পেয়েছে আমির ভেতর অন্য এক আমিকে। যে আছে অথচ নেই। এ যেন এক অধরা মাধুরী!
নিজের সঙ্গে নিজের এই কথা-আলাপ তার কখনও খারাপ লাগেনি। বাঁকুড়া শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে এই পাহাড়। পাহাড় বলা বোধহয় ভুল হচ্ছে। টিলহা বলাই শ্রেয়। আসলে মানুষ এত চিন্তা ভাবনা করে সবসময় কথা বলে না। তাই টিলহা পাহাড় হয়ে যায় কত সহজেই। সুনয় হয়ে যায় সু।
বাইকে স্টার্ট দিল সুনয়। টিউশন পড়িয়ে এই বাইক কিনেছিল। এতদিন ঘরেই পড়েছিল। চালানো হয়নি। এতদিন মানে বছর চারেক। সাইকেলটা চুরি হল তাই নিয়ে আসা। সাইকেল পৃথিবীর প্রকৃত সহজ যান, কিন্তু খুব বেশি দূরে সাইকেল নিয়ে যাওয়া যায় না তাই সমস্যা। নইলে খরচ তেমন নেই। জঞ্ঝাটও নেই। এখন পেট্রলের যা দাম বাড়ছে! সাইকেল কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড বা সালফার ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে না। সেই অর্থে প্রকৃতির দূষণে সাইকেলের কোনো ভূমিকাও নেই। সুনয় তাই পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কাজকর্ম, ঘোরাফেরা সাইকেলের সাহায্যেই চালিয়ে নেয়। এতে যেমন পয়সা বাঁচে, শরীর আর মন ও তাগড়া থাকে।
ইস্‌ বৃষ্টিটা এসে গেল। কিন্তু মেঘ তো ছিল না এতক্ষণ! শরৎকালের মতো ইতস্তত বৃষ্টি। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। বাইকের স্পিড কমিয়ে দিল সুনয়। একশো আশি ষাট চল্লিশ…। ধ্যাৎ, সাইকেল-সাইকেল মনে হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে মুখে। কপালে-চিবুকে। বুকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে মৃদু চুম্বনের মতো অনাস্বাদিত বৃষ্টির বেগ। শরীরে জেগে উঠছে শীতকাল।
কাঞ্চনপুর। জয়মাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দেখি চা পাওয়া যায় কিনা! বাইক স্ট্যান্ড করল সুনয়। ভিজে একসা। ভেজা কাকের মতো অবস্থা।
না, চা হবে না, দুধ ছিটে গেছে, লিকার । লেবু সহযোগে পাওয়া যাবে। তাও মিনিট দশেক দাঁড়াতে হবে। লোকে কেন যে দুধ মিশিয়ে চা খায় সুনয় জানে না। বৃষ্টি থেমে গেছে। মাথার উপর আকাশের রং নীল। ভিয়েনে বড় বড় সাইজের রসগোল্লা। রাজভোগ। দাম মাত্র পাঁচ টাকা।
সুনয় জিজ্ঞেস করল, ‘এত সস্তা! লাভ থাকে!’
বাঁকুড়া শহরে এগুলো দশ টাকার কমে মিলবে না। পুরুলিয়ায় বারো টাকা, জামসেদপুরে পনের টাকা। কলকাতায় কুড়ি টাকা।
দোকানদার হাসলেন। বললেন, ‘আমার ঘরের তৈরি ছানা। তাই দিতে পারি। ছানা কিনে দিলে হয়তো দিতে পারতাম না।’
সুনয় গ্রামের ছেলে। গ্রাম তাকে বরাবর আকর্ষণ করেছে। যদিও সুনয়ের গ্রামে এখন বিষাক্ত বাতাস, দ্বন্ধ-হিংসা মারাত্মক আকার নিয়েছে। শুরু হয়ে গেছে রাজনীতি আর ল্যাং মারামারির খেলা। শহর ধীরে ধীরে বদলায়। কিন্তু গ্রাম যখন বদলায় খুব সহজেই বদলে যায়।
অঞ্জন। সুনয়ের বন্ধু। ভূগোলে অনার্স। স্কুল মাষ্টার। ও বলত, গ্রামের সঙ্গে খরস্রোতা নদীর সম্পর্ক আছে। জল থাকলে বয়ে যায়। না থাকলে ধূ-ধূ বালি। এখন বোধহয় জলের সময় নাকি ধূ-ধূ বালি! এই যে জল বয়ে যায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ঠিক তেমনি  মানুষও বয়ে যায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। দুজনের স্রোত হয়ত আলাদা কিন্তু জীবন তাকে বয়ে বেড়াতেই হয়। নাহলে গায়ে গায়ে একসময়  শ্যাওলা জমে। পিছলে পিছলে যায় সমূহ স্বাদ। যদিও কখনো কখনো এই চুম্বকে মানুষ পাথর হয়ে যায়। চিন্তা-চেতনাহীন। কুশপুতুল। দুঃখ, বঞ্চনা, পীড়ন, রাগ, রস, ক্রোধ প্রশমিত করার জন্য মানুষ দলবদ্ধ হয়ে এই কুশপুতুল পোড়ায়। গায়ের ঝাল মিটিয়ে নেয়। আর বাড়ি ফিরে চা খায়। বউয়ের সঙ্গে গল্প করে। ছেলে কোলে পায়চারি করে। গালে হামি দেয়। টিভি দেখে। চ্যানেল বদলায়। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
বাইক এসে থামল।  এটা চাটানি পাড়া। এই হল মাসিমার চায়ের দোকান। এখানেই সুনয় রোজদিন পাউরুটি আর ঘুঘনি খায়। মাসিমার হাতের ডিমভাজার স্বাদই আলাদা। ডিম ভাজার গায়ে গোলমরিচের গুঁড়ো।  সুনয় ডিম ভাজার দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।
মাসিমা তাড়া লাগায়, এই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে! চায়ে চিনি দেব? জিজ্ঞেস করে।
সুনয় হাসে। বলে, দাও দাও চিনি গুড় যা ইচ্ছে দাও।
আজ রবিবার। অফিস নেই। মাসীমার চায়ের দোকানে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা হবে। এই তো এগারোটা বাজতে চলল। এরপর ভিড় জমবে। তরুণ কবিরা আসবে। ঈশান, কল্যাণ, অর্জুন, চুর্ণি, মায়া। কবিতায় ম-ম করে উঠবে মাসিমার দোকানের চায়ের টেবিল।
এই যা! রাস্তার ওপারে ছোটো মত ভিড়! মাসিমাকে সুনয় জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
আর বলিস না বাবা! সেই যে ছেলেটা যাকে তুই বলেছিলি কোথায় যেন ভর্তি করে দিবি। মেট্রিক পাশ করে যাবে। সেই যে রাকা না কি যেন বলে, ও বাচ্চুর মুখে ঘুষি চালিয়ে দিয়েছে।
বাচ্চু কে! রাকা ঘুষি চালাল কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি রুটি গরম কর। আমি ওপাশ থেকে দেখে আসি কী ঘটেছে।
রাস্তা পেরিয়ে এপাশে এসে ভিড়ের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখে একটা আলোচনা হচ্ছে। উত্তেজনা তেমন না থাকলেও পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে।
সুনয় ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে সোজাসুজি রাকাকেই জিজ্ঞেস করে,  ব্যাপার কী রাকা! কী হয়েছে?
রে রে করে কয়েকজন ছেলে তেড়েফুড়ে ওঠে, আপনি কে! কী হয়েছে মানে? আমাদের পাড়ার ছেলের গায়ে হাত পড়েছে। আমরা অত সহজে ছেড়ে দেব না। ওকে ক্লাবে নিয়ে যাব। ওখানেই মীমাংসা হবে। রাজু দা এক্ষুণি আসছে।
সে ঠিক আছে।  মীমাংসা যা হবার হবে। আগে তোমরা আমার তরফ থেকে চা, ঘুঘনি আর পাউরুটি খেয়ে নাও। বেশ আত্মবিশ্বাসের গলায় কথাটা বলে সুনয় জোরে শ্বাস নেয়।
রোগা পাতলা মতো একটা ছেলে তিড়কে ওঠে। আপনি ভেবেছেন কী! আমরা আপনার পয়সায় খাব? আমরা কী এতই ভিখিরি নাকি!
সবাই হো হ করে হেসে ওঠে।  সুনয় বলে, তোমরা খেতে না চাইলে না খাও। কিন্তু রাকাকে কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে দাও। দেখো ওর চোখ, মুখ কেমন শুকনো হয়ে গেছে খিদের চোটে।
আপনি মশাই রাস্তা মাপুন। রাজুদা না আসা অব্দি আমরা ওকে কেউ ছাড়ছি না। আপনি মেলা ঝামেলা করবেন না।
ওই দেখ,  তোমাদের রাজুদা আসছে। রাজুকে দেখতে পেয়েই পুরো জটলা উল্লাসে ফেটে পড়ে। যেন বিশাল এক গুণ্ডা বদমাইশকে ওরা ধরে ফেলে আটকে রেখেছে। আর রাজুদা এসেই ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়ে দেওয়ার নিদান দেবে। যেন কতই না বীরত্বের কাজ করে এসেছে তার সবিস্তার ফিরিস্তি শোনাবে ওরা, তাদের রাজুদাকে।
রাজুর বাইক এসে থামল মাসিমার চায়ের দোকানে।  আরে সুনয়, তুই থাকতে আমাকে আসতে হল এই ভরদুপুরে!
আর বলিস না, তোর চ্যালা চামুণ্ডে আমাকে পাত্তা দিলে তবে তো! বললাম, তোমাদের রাজুদা যতক্ষণ না আসে চল সবাই চা, ঘুঘনি, পাউরুটি খেয়ে নাও। সে বলে কিনা আমার আপনার পয়াসায় খাব কেন? ওরা কি ভিখিরি! সুনয় হাসে।
ছেলেগুলো কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।সবাই সুনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করে। এ ওকে, ও তাকে ফিসফিস করে যেন কী বলে!
ততক্ষণে রাকা ছাড়া পেয়েছে। একটু বিমর্ষ লাগছে। ঝরঝরে ভাবটা উবে গেছে। চোখে মুখে একটা ভয়ের আবহ খেলা করছে। কী জানি কী হয়! এই বিপন্ন বিষ্ময়ের ভিতর রাকার মন দুলছে।
রাজু লম্বা বেঞ্চের মাঝখানে এসে বসল। তারপাশেই বসে আছে সুনয়। রাজুই রাকাকে ডাকল। শোন রাকা, তুই আমাদের পাড়ার আজকের অতিথি। কী খাবি বল?
রাকার মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটল। বলল, সত্যি বলছেন রাজুদা! আমাকে খাওয়াবেন, তাহলে ডবল ডিমের টোস্ট আর এক প্লেট ঘুঘনি। পেটটা চোঁ চোঁ করছে সেই কোন সকাল থেকে।
বাচ্চু একবার রাজুদার দিকে, একবার সুনয়ের দিকে আর একবার রাকার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলল, মার খেলাম আমি আর ও খাবে টোস্ট আর ঘুঘনি! দিনকাল কী পড়েছে মাইরি!
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।