• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিশ্বজিৎ লায়েক (পর্ব – ৯)

জন্মস্থান – পুরুলিয়া পেশা – সরকারি চাকরি প্রকাশিত কবিতা বই :- ১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে ২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর ৩) ভিতরে বাইরে ৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল ৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি ৬) কৃষ্ণগহ্বর ৭) শরীরে সরীসৃপ ৮) প্রেমের কবিতা ৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর ১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম উপন্যাস ১) কৃষ্ণগহ্বর

পূর্ব প্রকাশিতের পর

কাপড়ের দোকানে লোকজনের ভিড় দেখেই রাকা বুঝতে পারে পূজার আর দেরি নাই। বাবা বেঁচে থাকার সময় পূজার একমাস আগেই দোকানে দোকানে গিয়ে এটা নয় ওটা,  ওটা নয় এটা পছন্দ করে জামা প্যান্ট জিন্স জুতো সব কিনে নিত। বন্ধুদের ডেকে এনে দেখাত। রাকাও যেত ওদের বাড়ি। সেইসব দিন আর রাকার জীবনে নাই। তিন বছর আগেই উধাও হয়ে গেছে। এখন নিজেকে বড় বড় লাগে। মা তো কিছু করার আগে রাকাকেই জিজ্ঞেস করে নেয়, ‘হ্যাঁ রে রাকা এটা করলে কেমন হয়!’ রাকাও চটপট সিন্ধান্ত নিতে পারে। বাবার চলে যাওয়া তাকে অনেকটাই কঠিন বাস্তবের সম্মুখে দাঁড় করিয়েছে। সে নিজেও দেখেছে আলো থেকে সরিয়ে দিলে একটা গাছ কীভাবে তার ডালকে আলোর দিকে প্রসারিত করে।
সুনয়দা একটা হোয়াটসএপ গ্রুপে জয়েন করিয়েছে। গ্রুপের নাম ‘কে আছো বন্ধুজন’। আজ দু’দিন হল। রাকা নিজে গ্রুপে একটাও কথাও লেখেনি। শুধু অন্যের পোস্ট পড়ে গেছে। আজ গ্রুপের এডমিন প্রশ্ন দিয়েছেন। চাঁদে যেতে হবে। কে কী নিয়ে যাবেন তার লিস্ট দিতে হবে। রাকা কী কী নিয়ে যাবে অনেক ভেবেও কোনো কুল কিনারা পাচ্ছে না।
এখন সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টা। হাল্কা শীত পড়েছে। মাসিমার দোকানে গরম বেগুনি আর চা খাবে বলে গ্যারেজ থেকে একটু আগেই ছুটি নিয়েছে। অবশ্য চা আর বেগুনি সেকেণ্ড চয়েস, আসল হল তুলিকে দেখা। এই অর্ণবদার গ্যারেজে কাজ নিয়ে কত দিন তুলিকে দেখেনি। তুলি কি তাকে ভুলে গেছে! জানে না রাকা। তার ভয় হচ্ছে।
সোঁ সোঁ করে সাইকেল চালিয়ে একেবারে মাসিমার চায়ের দোকানে এসে থামল। পূজার বাজার বলেই হয়ত আজ বেশি ভিড় জমেনি। সামান্য দু’চার জন লোক আড্ডা মারছে। একেবারে গরম গরম ফুলুরি আর বেগুনি এক ঝাঝরা তুলে ঝুড়িতে রাখল মাসিমা। আজ গোটা চারেক বেগুনি খেতে হবে। সামান্য মুড়ি হলে ভাল হয়। দেশী চালের দুধ সাদা মুড়ি আর লাল চা। মুড়ির চেয়ে ভাল স্ন্যাকস আর কিছু হয় না। কিন্তু বাঙালিরা বিস্কিট আর চিপসের প্যাকেটে মত্ত হয়ে গেল। একবার ভেবেও দেখল না মুড়ির চেয়ে সস্তায় এত পুষ্টিকর আর কিছুই হতে পারে না। বাঁকুড়ায় সকালের খাবার বলতে মুড়ি আর চপ। যাদের বাড়িতে রাতে রুটি হয় তারাও কেউ কেউ অবশিষ্ট তরকারি মেখে সামান্য মুড়ি খায়। সেই ছোটো থেকেই দেখে আসছে। হঠাৎ করে রসনা বদলে গেল। ছোলা বাটোরায়। ধোসা আর ইটলিতে।
এতটাই চমকাবে আগে ভাগে বুঝতেই পারেনি রাকা। এযে জল না চাইতেই শরবত!
-‘মা, তাড়াতাড়ি কর। বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে।’
-‘দাঁড়া মা আমার। হাতটা ধুয়েনি। তারপরে দিচ্ছি।’
মাসিমা কড়কড়ে দু’হাজার টাকার একটা নোট বের করে তুলির হাতে দেয়। তুলি, ‘আসছি মা…’ বলেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একঝাঁক মেয়েদের দিকে ইশারা করে বলে, ‘চল।’
এতক্ষণ যেন কোনও স্বপ্নে ডুবে ছিল রাকা। যে স্বপ্নে কোনও দুঃখ নেই, অভাব নেই, অতৃপ্তি নেই। কেবল অঢেল আনন্দ আর সুখ। হঠাৎ করে মাসিমার ডাকে খেয়াল হয়, হাতের বেগুনি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
-‘কীরে রাকা, ভাবছিস কী এতো?’
-‘কই কিছু না তো!’ রাকা লজ্জা পায়। মনে মনে ভয় হয়, মাসিমা কি বুঝতে পেরে গেল! রাকা তো তুলির থেকে চোখ সরাতেই পারেনি। কী আছে তুলির ওই মুখে! ওই বড় বড় টান চোখ দুটি কেন তাকে বিভোর করে দেয় কিছুই জানে না রাকা! মন অবশ হয়ে যায়। চারপাশে খেলা করে, ভেসে বেড়ায় কেবল তুলির মুখ। চারপাশে ঘুরতে থাকে। যেন চারপাশে কেউ আয়না ফিট করে দিয়েছে। ডান, বাঁ, সামনে, পিছনে, উপরে, নিচে যে দিকে তাকায়; তুলি আর তুলি!
-‘মাসিমা একটা ঠোঙা দাও। বেগুনি গুলি বাড়ি নিয়ে যাব। মা একা অপেক্ষা করবে। বাড়িতে বরং মার সঙ্গে মুড়ি মেখে খাব।’
মাসিমা ঠোঙা বাড়িয়ে দেন। রাকা বেগুনিগুলি ঠোঙায় মুড়ে সাইকেলের সামনের বাস্কেটে রাখে। দাম মিটিয়ে সোঁ সোঁ করে সাইকেল চালিয়ে একেবারে মলের কাছে এসে দাঁড়ায়। এবার পূজায় জামা, প্যান্ট কেনার মতো টাকা নেই রাকার। অর্ণবদা একটা টি-শার্ট কিনে দেবে বলেছে।
কয়েক বছর আগেও এত ঝকঝকে দোকান-পাঠ ছিল না। আজ এই শহরে সাত সাতটা মল। বিগবাজার। আলোয় আলোয় চারপাশটা দিনের মতোই উজ্জ্বল। সুখী সুখী মানুষের মুখ। সুখ যেন উছলে পড়ছে। ঝলমল করছে বাজার করার আনন্দ! পূজার আর দিন পনের বাকি। এরই মধ্যে সন্ধ্যে থেকেই মলের গেটের দু’পাশে দুই ঢাকি। ঢাক বাজায়। ঢাকের বাজনা শেষ হলে সামনের ব্যালকনিতে গানের তালে তালে একটা মেয়ে নাচে। মেয়েটার নাচ দেখতেও কেউ কেউ ভিড় জমায়। রাকাও একদিন এসেছিল। নাচ দেখে উলটো দিকের ফুটপাতে দশ টাকার ফুচকা খেয়ে চলে গেছল। অর্ণবদা বলেছিল, ‘নাচ কেমন দেখলি রে রাকা!’
-‘মন্দ না। একদিন যাবে নাকি!’
-‘সে বয়স কি আর আছে রাকা!’ অর্ণবদা হাসে।
উলটো দিকের ফুটপাতে উঠে আজকেও সেই মেয়েটির নাচ দেখে রাকা। না, না আজ তো সেই মেয়েটি আজ নেই। আজ অন্য মেয়ে। প্রতিদিনই হয়ত পালটে যায়। রোজ তো আর আসা যায় না। সে সময় রাকার নেই। আজ যে গানটা বাজছে সেটা নতুন হিন্দি সিনেমার। রাকা সিনেমাটা দেখেছে কিন্তু কিছুতেই নামটা মনে আসছে না। দূরে স্ট্যান্ড করা সাইকেলের দিকে তাকেতেই রাকা দেখে তুলি আর তুলির বন্ধুরা এদিকেই আসছে। রাকা মলের অন্য পাশের ফুটপাত থেকে নেমে এসে মলের গেটের কাছে দাঁড়ায়।
রাকা দেখে, তার দিকে আঙুল দেখিয়ে তুলি তার এক বন্ধুকে কী যেন বলছে! রাকা এই দৃশ্যের সামনে একটু থমকে দাঁড়ায়।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।