সন্ধ্যাবেলায় অন্তু শুনে মায়ের বিকৃত আচরণ সমর্থন করে রুমাকে মুখ করল না ঠিকই, তবে মাকেও কিছু বলল না। মৌনতাই সম্মতি। এভাবে সম্মতি পেয়ে যাচ্ছিল রুমার স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে প্রতিদিন ষোড়শোপাচার। প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকায় নার্সিংহোমের খরচা মিটেছিল। এখন মায়ের জন্য, ছি! মায়ের জন্য বলতে নেই, সংসারের বাড়তি খরচ যোগাতেও পিএফ। দুজন কাজের মহিলা বহাল করতে হয়েছিল, যারা একত্রে কামাই করলে অতীনকে কাপড়ের গামলা নিয়ে কলতলায় বসতে হোত। অন্য সব কাঁথাকানি নীচের ব্যালকনিতে শুকোনো গেলেও মায়ের শাড়ি সায়া জামা তিন তলার ছাদে গিয়ে শুকোতে দিয়ে আসতে হোত অতীনকে। আর সরস্বতীদেবী রুমাকে ছোটো মন সাব্যস্ত করে নিজে মহান সাজতে রান্নার মেয়েটাকে দিয়ে সৃষ্টির রান্না করিয়ে একে তাকে খাদ্য বিতরণ করতেন।
রুমা এমন কিছু অক্ষম হয়ে পড়েনি। শরীরে কষ্ট আছে ঠিকই, কিন্তু ও জানে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে চলবে না। প্রতিদিন ওর যত্নের নাম করে যা রাজসূয়ো যজ্ঞ চলছে। শাশুড়ি ও ননদ হাত লাগালে রান্নার কাজটা নিজেরাই চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু অতীনের পরম পূজ্যা মা থাকতে রুমার কোনও কিছু পারার অধিকার নেই। তাকে কেৎরে পড়ে থেকে শুধু বাক্য হজম করে যেতে হবে – ও কত আনাড়ি আর ওর শাশুড়ি কত করিৎকর্মা। তিনি না এলে বাচ্চাটাকে বাঁচানোই যেত না এবং আছেন বলেই সব সুশৃঙ্খলে চলছে। একে তাকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোও চলছে। মেয়ের বাড়িতে গজা, নিমকি পাঠানো যাচ্ছে।
বাচ্চা কাঁদলে ভদ্রমহিলার বিরক্ত লাগে এবং দাবি করেন একমাত্র ওঁর কোলে বাচ্চাকে রাখলে তবে নাকি সে শান্ত হবে। কিন্তু মেয়ের প্রচণ্ড রেগে অকারণ কান্নার একটা কারণ আবিষ্কার করেছিল রুমা। দুদু পান করতে করতে হঠাৎ রেগে মাকে আঁচড়ে দেবার অর্থ, সেই সময় তার হিসিরও বেগ এসেছে। ঠ্যাং তুলে ‘হিস্স্স্’ দিয়ে হিসু করিয়ে নিলে আবার শান্ত হয়ে চুকচুক চুকচুক। ঠাকুমার দশটা বাচ্চার বড় করে তোলার অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগল না। এটা কি কম অপরাধ? ছোটোলোক বাড়ির মেয়ে না হলে এমনটা হয়? ওঁর মতো করিতকর্মা যেখানে প্রথম সন্তানের বেলা নিজের মায়ের ওপর সব ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেখানে এই ছোটো বৌ কেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে না কাতরে মেয়ের মাথার জন্য সরষে ধুয়ে শুকিয়ে বালিস বানাবে, রান্নাঘরে ঢুকবে, নিজস্ব পরিচ্ছন্নতার বিধি প্রবর্তন এবং পালন করবে? বৌ সব কিছু নিজে পেরে গেলে ওনার কর্তৃত্বটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে না? তাই রুমা ঘরের বা বাচ্চার কাজে একটুও পারদর্শিতা দেখালে জ্বলে উঠতেন, “কিচ্ছু হচ্ছে না!…তুমি বাচ্চা ধরতে জানো না।…তুমি তেল মাখাবে না, স্নান করাতে পারবে না”। রুমা কোনও কাজ নিজে করে নিলেই চিৎকার জুড়তেন, “তাহলে কি আমাকে দরকার নেই?” হিংস্র হয়ে ছোট পুত্রবধূর সাবলম্বনকে আক্রমণ করতেন। “বৌয়ের আঁচল ধরা” বলে পুরুষালি শাসনের জন্য কম উস্কেছেন?
শুধু তাই নয়, নচ্ছাড় বৌটাকে নরম ঘাড় সামলে বারবার উপুড় করার কৌশল না শিখতে বলেছেন ঠারে ঠোরে। তেল মাখানোর বিধিও শিখতে মানা করেছিলেন। কিন্তু ননদের অনুপস্থিতিতে রুমাকে শ্বাশুড়ির আপত্তি সভয়ে উপেক্ষা করে কোনও কোনও দিন মেয়েকে তেল মাখাতেই হোত, তাও পিঠে তেল মাখানোর সময় বাচ্চাকে উপুড় করতে পারছেনা ভান করে। সাহায্যের জন্য ডাকলে সরস্বতী রুমার অপটুতাকে কটাক্ষ করতে করতে শশব্যস্তে ছুটে আসতেন। আর না ডাকলে রেগে সেদিন স্নানটাই বাতিল করে দিতেন। রান্নাঘর ফেরৎ ঠাণ্ডা হাতের ছ্যাঁকায় কচি চামড়া শিউরে উঠলেও তাকে কাঁদিয়ে তেল মাখাবেন উনি। রুমার পরিস্কার শুকনো হাতেও নিজের সন্তানকে যত্ন করায় তাঁর সম্মতি ছিল না। ননদ বেশ বাগিয়ে ধরে স্নান করিয়ে দিত। সরস্বতীদেবী মেঝেয় বসতে পারেন না। ননদ কোনও দিন নিজের বাড়ি গেলে উনি চেয়ারে বসে ঝুঁকে পড়ে আধা-খ্যাঁচড়া করে স্নান করাতেন। রুমার কাজ ছিল অপটু সেজে হাতে হাতে যোগান দেওয়া। এমনকি বাচ্চাটা কখন খাবে সেটাও ঠাকুমার নির্দেশ ছাড়া স্তন্যদায়িনী মায়ের বোঝা চলত না। কারণ উনি নিজের চার ছেলে মেয়ে ছাড়াও আরও হাফ ডজন বাচ্চা ঘেঁটেছেন।
ময়দা মেখে গায়ে ঘষে বাচ্চার নরম লোম তুলে ফেলা যায় বলে মায়ের কাছে শুনেছিল রুমা। সেটাই মেয়ের ওপর প্রয়োগ করতে গিয়েছিল। শ্বাশুড়িও নিশ্চই জানতেন। কিন্তু প্রস্তাবটা রুমা আগে রেখে ফেলেছে। সুতারং ময়দা ঘষা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, “সব লোম আপনি ঝরে পড়বে, সাত পুরু চামড়া উঠবে”। গুবলু এখন ভালুকছানার মতো রোমশ।
‘আস্তাকুঁড়’ কথাটা যে কতবার ব্যবহার করেছেন রুমা আর রুমার সংসার সম্পর্কে। তা রুমার গোছগাছ নেই ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতাবোধ থাকতে পারে না? এঁটোকাটা থেকে বাইরের পোষাক বদলানো – সব কিছুতেই তার অসম্ভব পিটপিটানি। কিন্তু পিটপিটানির মতো উচ্চমার্গীয় শৌখিনতা দেবীকে মানায়, আস্তাকুঁড়বাসীদের কেন থাকবে? তাছাড়া তার এত স্পর্ধা, সন্তানের ব্যাপারে শাশুড়ির জারি করা পরিচ্ছন্নতাবিধি ব্যক্তিবিশেষে প্রযোজ্য না মেনে সর্বজনীন করার চেষ্টা করে? নিয়ম প্রণেতা ইচ্ছামতন নিয়মের ব্যাতিক্রম করতেই পারেন। উনি রাস্তার পা না ধুয়েই খাটে বসতে পারেন, এক হাতে খেতে খেতে খাবারের টুকরো-গুঁড়ো ফেলতে ফেলতে খাদ্য পরিবেশন করতে পারেন, বাঁ হাতে রুটি দিতে পারেন, কিন্তু সেগুলো রুমা স্নানের আগে রান্নাঘরে ঢুকলেও মহাদোষ। রুমা শাশুড়ির কথা মেনে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার আগে নিয়ম করে বুক ঢেকে নিত। তারপর প্রতিবার বুক বাঁধা কাপড়খানা নিজের বুদ্ধিতেই ধুয়ে মেলে দিত। অথচ সরস্বতীদেবী নিজের মোজা পরা হাত অপ্রয়োজনে বাচ্চার ঠোঁটে ঠেকাতেন রুমার অস্বস্তি অগ্রাহ্য করে। তা করতেই পারেন, চন্দন আর গোবর কি সমতুল্য? তাই আস্তাকুঁড়জাত বাচ্চার গায়ের মিষ্টি সৌরভ ছাপিয়ে স্বভাবতই দুর্গন্ধ পেতেন, অথচ সেই পাঁকে জন্মানো পদ্মের মাতৃ-উৎস অস্বীকার করে নিজের শিলমোহরে দাগানোর চেষ্টাও কম ছিল না।