তখন নিজস্ব চলভাষ ছিল না। বাড়ির ফোনে কথা বলার সুবিধা হোত না। রুমা কান্না চেপে টেলিফোন বুথ থেকে অতীনের অফিসে মাঝেমধ্যে ফোন করত। কোনও দিন পেত, কোনও দিন নয়। যখনই অতীনকে ফোনে পেত, পাণিহাটি ফেরার বায়না করে আসত। বড় ভাসুরের ফোন থেকে কথা বলতে অস্বস্তি লাগত। বুথে নিজের খরচে যত পারো এবং যা পারো মন খুলে বলে এসো। শেষমেষ দিন কুড়ির মাথায় অতীন কলকাতা থেকে আবার গিয়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে গেল।
তবে তাতেও মনে হয় সরস্বতীদেবীর কলজে ঠাণ্ডা হয়নি। ওরা বাড়িতে ফোন করলেই অধীর আগ্রহে মাতৃদেবী জানতে চাইতেন, বাচ্চাটা অসুস্থ হয়েছে কিনা। রুমা যা আনাড়ি আর অবাধ্য, তাতে অমনটা হওয়াই উচিৎ। না হয়ে থাকলে আরও অনেক ক্ষেত্র আছে, যেখান থেকে ছোট বৌয়ের দোষ বার করে ছেলেকে ওস্কানো যায়। ছেলেও দিব্যি মায়ের ঐ নগ্ন করাল রূপ দেখার পরেও মাকে মহৎ প্রতিপন্ন করতে এবং মায়ের সন্তুষ্টির জন্য বৌকে অযোগ্য প্রমাণ করতে বাচ্চা মানুষ করা ও তার স্বাস্থ্যরক্ষা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে রুমার খুঁত খুঁজে চলত। গুবলুর ভয়ানক বমির ধাত তো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নিত্য ঝগড়ার নৈমিত্তিক উপলক্ষ ছিল।
“জানি তো, আমার মা বলেছে বলে কথাটা তোমার পছন্দ হবে না। নিজে যেটা ভালো বুঝবে সেটাই করে যাবে। অমন করে শুইয়ে শুইয়ে খাওয়ালে বিষম লাগবে না?”
“বসিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে দেখো পারো কি না? তোমার দিদি বকার পর থেকে মাথার নীচে একটা বালিস দিই। কিন্তু ও সব লণ্ডভণ্ড করে আকাশ ফাটিয়ে কেঁদে চলে।”
“জানো মা বলছিল, একবারে সবটা না খাইয়ে বারে বারে খাওয়াও। ঐ যে তুমি দেড় ঘণ্টা ধরে সেরেল্যাক নিয়ে গেলানোর চেষ্টা করো, তাতে কি কোনও পুষ্টি হয়? ঐ সেরেল্যাকে জীবাণু ডেভেলাপ করে। আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে ওটা খাওয়ানোই উচিৎ নয়।”
“তুমি নিজেও তো চেষ্টা করে দেখেছ, ওকে আধ ঘণ্টার মধ্যে দু চামচও গেলানো সম্ভব হয় কি? এই ভাবেই তো ছ মাসের হতে চলল। আমার এক জেঠতুতো দাদার বমির ধাত ছিল বলে জেঠিমা একসঙ্গে দু’ বাটি রেডি করত। এক বাটি ওগরালে আর একটা পেটে থাকত। আমাকে যেমন আমার মা ঠাকুমার ভয়ে ঠিক মতো খাওয়াতেই পারত না। কিন্তু আমি মায়ের কাছে ঐ জেঠিমার গল্প শুনে গুবলু বমি করলে আবার ফ্রেশ করে গুলে খাইয়ে দিই, অফকোর্স যদি না বদহজমের জন্য বমি করে থাকে। এমনও হয়েছে, চারবার বমি করেছে, পাঁচবারের বার পেটে থেকে গেছে। ন্যাচরালি সময় তো বেশি লাগবেই। দেড় কেন দু ঘণ্টাও পেরিয়ে যায় তোমার মেয়ের খাদ্যানুষ্ঠান শেষ করতে।”
“তাহলে আর কী? যা খুশি করো।”
মা তো বলেই দিয়েছিলেন “আসতে হবে না”। কিন্তু সে কি মায়ের মনের কথা? হতেই পারে না। মাতৃভক্ত ছেলের তারপরেও বছরে দু’বার সপরিবারে জামশেদপুর ঘুরে আসা চাই। না পারলে ‘ভেড়ুয়া বনে গেছি’ ভাব করে মুখ ঝুলিয়ে থাকে। বাড়ির ভাগ কানাকড়িও জুটবে না জেনেও বাড়ির মানুষগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণা কেন, অভিমানটুকুও নেই। ঐ বাড়িতে নিজের বৌ আর বৌদিদের অধিকার ও অবস্থান যে সমান নয়, তা মানতেই চাইবে না; আর মানতে বাধ্য হলে সেটাই যুক্তিসহকারে সমর্থন করে যাবে। বৌ না হয় পরের মেয়ে, মেয়েটা তো নিজের। তার প্রতি বৈষম্য ও উদাসীনতাটাও অসঙ্গত মনে হয় না। রুমাকে তাই এখনও দশকাধিক বিবাহোত্তর অভিজ্ঞতা নিয়ে কয়েদ খাটার মতো করে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয় বিস্তর ধকল আর খরচ করে। মুখ খুলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সুযোগ অতীন ওকে কোনওদিন দেয়নি, সামান্য কিছু বললে উল্টে রুমার সঙ্গে কথা বন্ধ দেয়। জামশেদপুরে গুবলুর মুখেভাত না দেওয়া নিয়ে ননদ ননদাই এখনও রুমাকে বেঁধে, যদিও পাণিহাটিতে অনুষ্ঠান হওয়ার সৌজন্যে ওদের জ্ঞাতিগুষ্টিই দু দিন চার বেলা পাত পেড়ে আনন্দ করেছিল।
ঐ সমস্ত কথা মনে পড়লে এখনও নিজের মনে কাল্পনিক তর্ক করে যায় রুমা বরের সাথে, শ্বাশুড়ির সাথে, ননদ-ননদাইয়ের সাথে, মেজ এমনকি বড় জায়ের সাথেও যারা উদারতার মুখোশ পরে রুমার ভাগটা আত্মস্যাৎ করছে। একান্নবর্তীতার নাটক কত দিন চলে সেটাই দেখার। চলতে পারে। কারণ শ্বাশুড়ি নিজের পুঁজি দিয়ে ঠেকজোড়া দিয়ে যাচ্ছেন। অতীনও দিচ্ছে, তবে আগের চেয়ে অনেকটা কম। একটা ফ্ল্যাট কিনে রাখলেও মাথার ওপর একখানা ছাদ না হোক সিলিং অন্তত পেত, পায়ের তলায় মাটি না হলেও মেঝে থাকত। দিনদিন জমি-বাড়ির দাম যা আকাশ ছোঁয়া হয়ে যাচ্ছে, তাতে অতীনের অবসরের পর তিনজন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেই চিন্তাই মাথা খারাপ করে দেয়। মেয়েটাও দেখতে দেখতে বছর সাড়ে পাঁচ হয়ে গেল এই ভাড়া বাড়িতেই। খেলার সাথী নেই। অসমবয়সীদের আড্ডায় পাকা পাকা কথায় লোক হাসিয়ে বিনোদন করে। এবারে ক্লাস ওয়ান হবে। আইসিএসসির কাউন্ট ডাউন শুরু।