রোজগার করতে না পারলেও বুদ্ধিমানের মতো বিনিয়োগ থেকেও তো লাভবান হওয়া যায়। কয়েকটা মিউচুয়াল ফান্ডে অতীনের আপত্তি সত্বেও রুমা টাকা রেখেছিল। কয়েক বছর লোকসানে থাকার পর মোটামুটি লাভ রেখে সবকটাই বিক্রী করতে পেরেছিল। সেই সামান্য পুঁজি অতীনের হাতে দিয়ে পায়ে পড়েছিল, একটা মাথা গোঁজার আস্তানা কেনার জন্য। অতীনের লোন পেতে কোনও অসুবিধা ছিল না, বা নেই। ঋণও বেশি নিতে হোত না। অতীন কদিন এদিক সেদিক ঘুরে, খান কতক প্রসপেকটাস কিনে, বিস্তর জল্পনার পর চুপ মেরে গিয়েছিল। শত প্রশ্নের একটা জবাব ঠিকমতো মিলত না। রুমা কাছাকাছি একটা হাউসিং কমপ্লেক্সের ফর্ম-প্রসপেক্টাস নিয়ে আসার পর সাত দিন ভালো করে কথা বলেনি। সাতদিন পর মুখ খুলল, “বাড়ি থাকতে আলাদা ফ্ল্যাট কিনব, এমন শিক্ষা আমি পাইনি। আমরা স্বার্থপর ফ্ল্যাট কালচারে মানুষ হইনি।”
“তাহলে কি আমি হয়েছি? আমাদের বাড়ি আর বাগান দেখোনি? বাবার কোম্পানির বাংলোতেও সুন্দর বাগান ছিল। আর কিনবে না যদি, খামোকা আমায় বোকা বানানোর জন্য দৌড় করালে কেন?”
অতীনের সেরা স্ট্রাটেজি হল চুপ করে থাকা। সেটা ও দিনের পর দিন পারেও। রুমার বাক্য বন্ধ না হলে অতীন সোজা বাইরে বেরিয়ে যায়। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর ফেরে রাত করে। হয়তো কোনও দিন হাতে থাকে গরম রসগোল্লা বা অমৃতির সন্ধিপ্রস্তাব। কিন্তু তার আগে রুমাকে উদ্বেগে ঘরবার করিয়ে বুঝিয়ে দেয়, অপ্রিয় প্রসঙ্গের অবতারণার পরিণতি কতটা উদ্বেগজনক হতে পারে।
ননদের সাথে একদিন কথা হচ্ছিল বাড়ি নিয়ে, “তুই জানিস না? তোরও জানা উচিৎ। জামশেদপুরের বাড়িটা বিহার সরকারের কাছে বন্দক রাখা আছে। বাবা মাত্র পাঁচ হাজার টাকা লোন নিয়েছিল। সেটা এখন সুদে বেড়ে কয়েক লাখের ফেরে পড়েছে। সন্তু তো অত টাকা দিতে পারবে না। আর দাদাকে কে তো কিছু বলাই যাবে না; যা মেজাজ! আর মা কোত্থেকে অত টাকা পাবে? ঐ তো সামান্য কটা পেনশনের টাকা, আর বাড়ি ভাড়া। সেটাও বেশিটাই সংসারে আর নিজের ওষুধবিষুধে বেরিয়ে যায়। অন্তু ছাড়া কে দেখবে? সবটা একা দিতে না পারুক, দাদা নিশ্চই নিজের ভাগটা দেবে, সন্তুর অংশটা তো অন্তুকেই বেয়ার করতে হবে। বাড়িটা তো ওরও।”
তাহলে রহস্যটা এই? সন্তু হল অতীন বা অন্তুর মেজদা। বাড়ি ভোগ করবে দাদারা। দিদি জামাইবাবু গিয়েও নাক গলাবে। আর ঋণ শোধের বেলায় ছোটো ভাই? জামাইবাবুর কাছে নেওয়া ত্রিশ হাজার টাকা তো ও একাই ফেরৎ দিয়েছে খেপে খেপে। এখন লক্ষাধিক টাকার ঋণটাও অতীনের কাঁধে? বাড়িতে তো ওদের ঠিক মতো একটা ঘরও নেই। শাশুড়ি এবেলা একরকম বলেন, তো ওবেলা কথা ঘোরান। মেয়েটা হওয়ার সময় তো আসল রূপ বেরিয়েই পড়েছে। তারপরেও কোন লজ্জায় ননদ এ কথা বলতে পারে? অবশ্য ভাগ্যিস বলেছিল। নইলে রুমা কোনওদিন জানতে পারত না, যেমন বহুদিন জানতে পারেনি মাইনে পাওয়ার দশ দিনের মধ্যে সংসারে তেমন কিছু খরচ না করেও সব টাকা ফুরোত কী করে!
কথাগুলো জানতে পেরে রুমা রাগে, অভিমানে, নিরাপত্তাহীনতায় ভেঙে পড়েছিল। ননদ না জানালে ওর বর চিরকাল ওকে এই সত্যিটা গোপন করে আড়ালে টাকা পাচার করে যেত। বাড়ির ছেলে বাড়ির জন্য টাকা দেবে, এ তো স্বাভাবিক। তাই বলে স্ত্রীর সঙ্গে এমনকি নিজের সন্তানের সঙ্গে এত বড় ছলনা?
রুমা মরিয়া হয়ে একটা শেয়ার টার্মিনালে ডিম্যাট আর ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা লাগাতে লাগল। অতীনই ছিল প্রথম অ্যাকাউন্ট হোল্ডার। তখন বাজার উর্ধ্বমুখী ছিল। সাময়িক কিছু লাভ পেলেও অনেক টাকা আটকে রইল। সেই অবস্থায় বাড়ির কাছের টার্মিনালটা বন্ধ হয়ে গেল। বিস্তর ঝক্কি পুইয়ে অন্যত্র খাতা খুলল নিজের নাম প্রথমে রেখে। এনএসডিএল থেকে সিডিএসএল-এর নতুন ডিম্যাট-এ শেয়ার স্থানান্তরিত করতে হল মোটা গচ্চা দিয়ে। এর মাঝে শেয়ার বাজারে ধস নামা শরু হয়ে গেছে। কোনও স্ক্রিপ লোকসানে না ছেড়ে লাভের আশায় থাকতে থাকতে শেয়ারগুলোর দাম কোনওটা বারোশো থেকে ছশোয় নামল, তো কোনওটা আশি থেকে ন টাকায়। তারপরে সেই টার্মনালও উঠে গেল। নতুন কোম্পানির হাত ধরে বাণিজ্য বজায় রাখতে হল। আবারফ ট্রান্সফার চার্জ দাও। উপরন্তু লোকসান। বর্তমান কেন্দ্রটির ফ্র্যান্চাইজ় মালিক আবার রুমাকে না জানিয়ে এমন কিছু শেয়ার ওর আ্যাকাউন্টে কিনে দিয়েছে, যেগুলো লোকসানের পরিমাণকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই নিয়ে কথাকাটাকাটি। ওখানে যাওয়াই প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। নিজস্ব কম্পিউটার আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে হয়ত কিছু উদ্ধার হোত। পরবর্তী লম্বা মন্দায় রুমার বিনিয়োগ ক্রমশ অতলান্তে তলিয়ে গেল। গড় দাম কমাতে গিয়ে একটু একটু করে বিনিয়োগ বাড়িয়েই গেছে। বর্তমানে এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা বিনিয়োগের শেয়ার মূল্য দাঁড়িয়েছে চল্লিশ হাজারের কম! বাজারের গতিক মন্দ দেখলে যে লোকসান করেও শেয়ার বেচে দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয় আরও কম দামে ধরার অপেক্ষায়, সেটা যখন বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আতঙ্কে ও হতাশায় শেয়ার টার্মিনাল যাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিল।