• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক প্রকল্পশ্রীরিয়্যাল ধারাবাহিকে প্রকল্প ভট্টাচার্য (পর্ব – ৩ ।। প্রথম ভাগ)

নাম: পরিমলবাবুর পরিবারকথা

পর্ব ৩: জন্মদিনের উপহার    

মুখ্য চরিত্র: পরিমলবাবু (বয়স পঁয়ষট্টি, ক্লার্কের চাকরি করে রিটায়ার করেছেন) পরমা (পরিমলবাবুর স্ত্রী, বয়স পঞ্চান্ন, গৃহবধূ) প্রসূন (ছেলে, বয়স ত্রিশ, আইটি ফার্মে চাকরিরত) জুঁই (পুত্রবধূ, বয়েস পঁচিশ, স্কুল টিচার) প্রীতি: (মেয়ে, বয়স পঁচিশ, কলেজে পড়ে) প্রিয়ম (নাতি, বয়েস সাত বছর, ক্লাস টু)
(সকালে পরিমলবাবু কাগজ পড়ছেন, চায়ের কাপ নিয়ে পরমার প্রবেশ)
পরমা- কিগো, খুব ব্যস্ত?
পরিমল- ঐ আর কি… দেশের অবস্থা ভালো নয়, বুঝলে! জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, চাকরির বাজার খারাপ, সব মিলিয়ে সবসময় একটা টেনশন!
পরমা- আমাদের আর কি, এই তো হয়ে এল, আর কটা বছরই বা বাঁচবো!
পরিমল- তা ঠিক, তবে কী জানো, আমাদের বাবা-ঠাকুর্দারা খুব চাপের মধ্যে জীবন কাটিয়েছিলেন। পরাধীন দেশে নানা আন্দোলন তো ছিলই, বিশ্বযুদ্ধ, তারপর স্বাধীন হয়েই রায়ট, দেশভাগ, নকশাল আমল, এত সবকিছুর জন্যে তাঁরা কখনো কোথাও থিতু হতে পারেননি। আমরা বরং অনেক ভালো, কিছু সঞ্চয়, কিছু স্বপ্ন নিয়ে কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আবার সেই অস্থির জীবনের দিকেই এগোচ্ছে দেখছি।
পরমা- বুঝলাম। তা দেশের চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, নাকি পরিবারের সমস্যা নিয়েও একটু ভাবার সময় আছে তোমার?
পরিমল- আমার পরিবার হলো তুমি। কী সমস্যা বেগমসাহেবা? বলে ফেলো, এখুনি সমাধান করে দিচ্ছি।
পরমা- এই বুড়ো বয়সে আদিখ্যেতা কোরো না তো! বলি, সামনের সপ্তায় প্রিয়মের জন্মদিন আসছে, কী উপহার দেবে ভেবেছ?
পরিমল- প্রিয়মের জন্মদিন? সে তো সেই ডিসেম্বরের… ওহো, ডিসেম্বর তো পড়ে গেছে, তাই না! সত্যি তো!
পরমা- এই জন্যেই বলি, এবার থেকে কাগজ পড়ার সময় তারিখটা থেকে শুরু করবে। নয়তো দিন কালের হুঁশ থাকবে না তোমার!
পরিমল- আহা, এত উতলা হও কেন!
(প্রীতির প্রবেশ) গুড মর্নিং বাবা, মা! সকাল সকাল কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে শুনি?
পরিমল- ঝগড়া নয় রে, আলোচনা। প্রিয়মের জন্মদিন আসছে, তার কী উপহার দেওয়া যায়, এই নিয়ে।
প্রীতি- ওঃ, এ তো সিম্পল! বাবা একটা বই কিনে দিও। আমাকে আর দাদাকে তো আজীবন সমস্ত উপহার বইই দিয়ে এলে! ক্লাশে ফার্স্ট হলে বই, জন্মদিন এলে বই, চাকরি পেলে বই…
(প্রসূন আর জুঁইয়ের প্রবেশ)
প্রসূন- ঠিক বলেছিস। তোর বিয়েতেও বাবা বইই দেবে, দেখিস!
জুঁই- যাঃ, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। কেন বাবাকে এরকম বলছ! না বাবা, বই খুব ভালো উপহার। আজকাল কেউ দেয় না, কিন্তু আগে এটাই তো দেওয়া হতো!
পরিমল- ঠিক বলেছ। আগে বিয়েতে শ্রীমতী বেলা দে-র লেখা একখণ্ড ‘গৃহিণীর অভিধান’ ঠিক পাওয়া যেত।
পরমা- রাখো তো! ঐ একখণ্ড একখণ্ড বলে আমাকে তোমার সব বন্ধুরা দশকিলো গৃহিণী বানিয়ে দিয়েছিল, তা জানো?
পরিমল- আহা, সেইজন্যই তো তুমি পাকা গৃহিণী হয়েছ! বোঝো ব্যপারটা! আমার বাবাও…
পরমা- থাক, শ্বশুরমশাইকে আর এর মধ্যে টেনে এনো না! জানো জুঁই, আমার তখন নতুন বিয়ে হয়েছে, প্রথম বছর পুজোয় শ্বশুরমশাইকে প্রণাম করতে উনি আমাকে একখণ্ড গীতা দিলেন আশীর্বাদ করে। আমি সরলমনে নিলাম, উল্টেপাল্টে কিছু পড়লামও। ও মা, তার পরের বছর আবার আর এক খণ্ড গীতা উপহার পেলাম! তার পরের বছর আবার!!
পরিমল- চার নম্বর বছরে তুমি কী করেছিলে সেটা বলো! পুজোর আগেই বাবাকে গিয়ে বললে, আপনি আমাকে গত বছর যে গীতাটা দিয়েছিলেন, ওটা পড়া শেষ হয়ে গেছে। এইবছর আর একটা নতুন গীতা দেবেন, কেমন?
প্রীতি- ও মাই গড! মা তুমি এটা বলেছিলে! মানে, সিরিয়াসলি!
প্রসূন- হ্যাঁ, আমিও শুনেছি মা এটা বলেছিল, তারপর থেকে দাদু আর মা-কে গীতা উপহার দেন নি। তবে তোকে বাবা গৃহিণীর অভিধানই দেবে বিয়েতে, দেখিস!
প্রীতি- আরে ধুর, আমি বিয়ে করলে তো!
জুঁই- ওমা সেকি! বিয়ে করবে না কেন! আর করলে এখনই করে ফেল। এই দেখো, তোমার আর আমার একই বয়স, আর আমাদের ছেলে এখন ক্লাশ টু তে উঠে গেল, অথচ তোমার…
প্রীতি- ওঃ বৌদি কাম অন, আমার পিএইচডি এখনও বাকি! বিয়ে করবার সময় নাকি এটা!
পরমা- কেন রে, জুঁই ঠিকই তো বলেছে! এটাই ঠিক সময়।
প্রীতি- দিস ইস নট ফেয়ার বৌদি! তুমি এখন তোমার এক্সামপল দেখিয়ে মা-কে দলে টানছ!
জুঁই- আমার কথা অবশ্য আলাদা।  আমার তো বাবা ছিলেন না, কাকার দায়িত্বে মানুষ। তাই তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। এইরকম মা-বাবা না পেলে আমার পড়াশোনা হয়তো আর হোতোই না! আমি তাই শুরুতেই বলে রেখেছিলাম, বিয়েতে আমার একটাই শর্ত, আমি পড়াশোনা করে চাকরি করব। এঁরা সেটা খুশীমনেই মেনে নিয়েছিলেন, আর কথা রেখেওছেন। এর জন্য আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
প্রসূন- বাঃ, সব ক্রেডিট বাবা মায়ের! আর আমি যে তোমায় সারাক্ষণ সাপোর্টটা দিই, তার দাম নেই?
প্রীতি- তুই চুপ কর তো, হিংশুটি মটরশুঁটি! আচ্ছা বৌদি, সব বুঝলাম, কিন্তু এখানে আলোচনা হচ্ছিল প্রিয়মকে জন্মদিনে বাবা মা কী গিফট দেবে সেটা নিয়ে, তার থেকে টপিক শিফট করে হঠাৎ সবাই আমার বিয়ে নিয়ে পড়লে কেন, একটু বলবে?
জুঁই- ওমা, সেকি! প্রিয়মের জন্মদিনে বাবা মা আবার আলাদা গিফট দেবে কেন! আমরা সবাই মিলে…
পরিমল- না বৌমা, ছোট ছেলে তো, সকলের কাছ থেকেই উপহার আশা করে থাকে। আমরাও ছোটবেলায় করতাম সেটাই।
পরমা- তুমি খবর্দার ওকে বই উপহার দেবে না, বলে রাখলাম!
পরিমল- আরে না না। আজকাল বই কেউ আদৌ পড়ে কি না সন্দেহ! সেদিন ঐ রামবাবু বলছিলেন, ওঁর নাতি এখন ই-বুক পড়ে, কিণ্ডল না মিণ্ডল দিয়ে।
প্রসূন- আমরাও কি দেব ভাবতে হবে। গতবছর সাইকেল দিয়েছিলাম, এখন ছোট হয়ে গেছে, তাই…
জুঁই- তুমি দয়া করে একা সিদ্ধান্ত নিও না! এখন ও লম্বা হচ্ছে, ছোট-মাঝারি সাইকেল কিনতে হবে না। কয়েকবছর পরে একেবারে বড় সাইকেল দিও।
প্রসূন- কেন কেন, আমি কোন সিদ্ধান্তটা ভুল নিয়েছি শুনি?
জুঁই- বলব? এই পাশের ফ্ল্যাটের ছোট ছেলেটাকে মাউথ অর্গান গিফট দেওয়ার আইডিয়াটা কার ছিল শুনি?
প্রসূন- কেন, কী খারাপ গিফট! বেশ মিউজিক্যাল, ভালোই তো!
জুঁই- হ্যাঁ, খুব ভালো। তুমি তো আর বাড়ি থাকো না, সেই মিউজিক্যাল প্রডিজি সারাদিন প্যাঁ-প্যাঁ করে ওটা বাজিয়ে বাবা মায়ের মাথা ধরিয়ে দিত, সে খবর রাখো? তারপর আর একজনকে দিলে ক্যাপ ফাটানো বন্দুক। কী ভায়োলেন্ট গিফট!
প্রসূন- আরে সে তো কালিপুজোর আগের দিন জন্মদিন ছিল কী দেব, তাই… আর খুব খুশীও তো হয়েছিল!
জুঁই- খুশী হবে না কেন! আজকাল ছোটরা এত বেশী ভায়োলেন্স দেখে সব জায়গায়, বোমা, বন্দুক, ছোরাছুরি এইসব তো ওদের পছন্দ! ঐ বন্দুক ফাটিয়ে আমাদেরই প্রায় বাড়িছাড়া করতে এসেছিল আনন্দে!
প্রসূন- আচ্ছা বাবা আচ্ছা। প্রিয়মের গিফট-এর ব্যপারে আমি কোনো ডিসিশন নেব না। সক্কলে যা বলবে, সেটাই হবে। মেজরিটি উইনস।
পরমা- আমার মনে হয়, প্রিয়মের যেটা প্রয়োজন সেটাই দেওয়া উচিৎ, তাই না?
প্রীতি- ঠিক, কিন্তু বই নয় প্লিজ, অন্য কিছু ভাবো!
প্রসূন- সেটাই তো ভাবছি! আচ্ছা, আমাকে এবার বেরোতে হবে। প্রিয়মও উঠে পড়েছে, এসে পড়বে। এই আলোচনাটা আমরা পরে আবার কন্টিন্যু করব, কেমন?
জুঁই- সেই ভালো। আমাকেও রেডি হতে হবে। যাই।
প্রীতি- রাইট। আমিও পালাই। টা টা!
পরমা- ব্যস, সব টা টা দেখিয়ে কাজে চলে গেল, পড়ে রইলাম শুধু আমরা দুই অকেজো বুড়োবুড়ি।
পরিমল- হুম।
পরমা- কী হুম হুম করছ? এত কী চিন্তা করছ শুনি?
পরিমল- ভাবছি, আজকাল ছোটদের সত্যিই কী দরকার! এই যেমন প্রিয়ম, না চাইতেই তো সবই আছে, নতুন করে কিছুর আদৌ দরকার আছে কী?
পরমা- এই! খবর্দার কিপ্টেমি করবে না! নাতির উপহার না দিলে কিন্তু আমি খুব রেগে যাব!
পরিমল- আরে কী মুস্কিল, আমি কি উপহার দেব না বলেছি! আচ্ছা, তুমিই বলে দাও কী দেওয়া যায়। যা বলবে, সেটাই হবে!
পরমা- ঈশশ! ঢং! কতো যেন আমার কথা শুনে চলেন!
পরিমল- সেকি! সবসময় তোমার কথাতেই তো চলি!! তুমি তো শুধু আমার বৌ নও, তুমি হলে আমার, যাকে বলে, ফ্রেণ্ড ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড! তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা!
পরমা- এইসব ন্যাকামি বন্ধ করো তো!~ আমি দুচক্ষে দেখতে পারিনা!
পরিমল- আচ্ছা, কিন্তু এটাই বাস্তব। জেনে রেখো, কোনদিন যদি আমাদের জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে গল্প লেখা হয়, তার নামও এটাই হবে।
পরমা- শখের সমুদ্দুর! আচ্ছা, কী নাম হবে শুনি?
পরিমল- কেন, পরিমলবাবুর পরিবারকথা!!!

ক্রমশ…                   

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।