সাপ্তাহিক প্রকল্পশ্রীরিয়্যাল ধারাবাহিকে প্রকল্প ভট্টাচার্য (পর্ব – ৫ ।। প্রথম ভাগ)
by
·
Published
· Updated
নাম: পরিমলবাবুর পরিবারকথা
পর্ব ৫: কাজের মানুষ
মুখ্য চরিত্র:পরিমলবাবু (বয়স পঁয়ষট্টি, ক্লার্কের চাকরি করে রিটায়ার করেছেন) পরমা (পরিমলবাবুর স্ত্রী, বয়স পঞ্চান্ন, গৃহবধূ) প্রসূন (ছেলে, বয়স ত্রিশ, আইটি ফার্মে চাকরিরত) জুঁই (পুত্রবধূ, বয়েস পঁচিশ, স্কুল টিচার) প্রীতি: (মেয়ে, বয়স পঁচিশ, কলেজে পড়ে) প্রিয়ম (নাতি, বয়েস সাত বছর, ক্লাস টু) (ডাইনিং টেবিলে সকলে) জুঁই– আচ্ছা, সকলকে একটা খারাপ খবর দিই। সন্ধ্যাদি আজ থেকে কাজে জবাব দিয়েছেন। পরমা– ওমা, সেকি! সন্ধ্যা, মানে আমাদের পুরনো কাজের লোক!! জুঁই– হ্যাঁ মা। প্রিয়ম– মা, কাজে জবাব দেওয়া মানে কী? প্রসূন– জবাব মানে রিপ্লাই। কাজে জবাব দেওয়া মানে হল কাজ করতে করতে তোমার মায়ের কোনো প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আর কি! জুঁই– শোনো, তুমি নিজে নাহয় বাংলাভাষায় সুনীতি চাটুজ্যে, ছেলেটাকেও কেন বানাতে চাইছ বলো তো? প্রিয়ম, কাজে জবাব দেওয়া মানে রিজাইন করা। প্রসূন– ভুল! রিজাইন করা মানে পদত্যাগ! কাজে জবাব দেওয়া-র অ্যাকচুয়াল বাংলা হবে… কী হবে রে প্রীতি? প্রীতি– ইস্তফা দেওয়া। চাকরি ছেড়ে দেওয়া। প্রসূন– হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক! অর্থাৎ সন্ধ্যাদি আমাদের বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। অ্যাঁ! সেকি!! কেন!! জুঁই– যাক, বুঝেছ তাহলে! পরিমল– আচ্ছা, কারণটা কী? মাইনেপত্র তো আমরা ঠিকমতোই দিই, পুজোয় শাড়িও… পরমা– হ্যাঁ, আর কাজও তেমন করাই কই! নিজেরাই তো অর্ধেক করে নিই! জুঁই– আসলে ওঁর শরীরটা খুব খারাপ হচ্ছিল। ডাক্তার নাকি বলেছে সব কাজকর্ম বন্ধ করে দিতে। ওঁর ছেলে এখন চাকরি করছে, সেই জেদ ধরেছে ওঁকে আর কোনও বাড়িতেই কাজ করতে দেবে না, অগত্যা। প্রিয়ম– মা, আমিও যখন চাকরি করবো, তোমায় চাকরি করতে দেব না। প্রসুন– আর আমি!! জুঁই– থ্যাঙ্কিউ প্রিয়ম! কিন্তু তার এখনো অনেক দেরী। তাছাড়া তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা না করলে চাকরি পাবেও না, সেটা মনে রেখো! প্রসূন– টিপিকাল দিদিমনি! যে কোনও আলোচনার সূত্রে পড়াশোনা টেনে আনতে পারে! প্রীতি– ওঃ দাদা, তুই নিজেও প্রিয়মের পড়াশোনায় হেল্প করবিনা, আবার বৌদিকেও করতে দিবিনা? জুঁই– দ্যাখো না, সবসময় এই করে! প্রীতি– কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। একটু আগে মা বলল, সন্ধ্যাদি বিশেষ কাজ করতো না, আমরাই করে নিতাম। ইন দ্যাট কেস, ডু উই রিয়েলি নিড আ কাজের মানুষ? পরিমল– এই কথাটা আমি তোদের মা কে আজীবন বুঝিয়ে পারিনি রে, এবার তুই চেষ্টা কর! পরমা– তোমাদের কোনও ধারণা আছে, বাড়িতে কী কী কাজ করা হয়? নেই। যদি বলি জামাকাপড় কাচতে পারছিনা, তো তোমরা একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে দিয়ে খালাস। কিন্তু তাতে জল ভরো রে, সাবান দাও রে, সুইচ দিয়ে সামনে হত্তে দিয়ে পড়ে থাকো রে, অফ হলে সব জল বেরোল কিনা দ্যাখো রে, জামাগুলোর কলার আর কব্জীর ময়লা উঠলো কিনা দেখে আবার সাবান ঘষো রে, শেষে সব এক এক করে তুলে নিংড়ে শুকোতে দাও রে… প্রসূন– কিন্তু মা, ফুল অটোমেটিক মেশিনে কাপড় তো শুকিয়েও দেয়! পরমা– তোমার মাথা দেয়! কুঁচকে মুচকে যে কাণ্ড করে, সেটার থেকে রুমালগুলো আর গেঞ্জীগুলো আলাদা করে দেখিও তো একবার! পরিমল– আচ্ছা, বুঝলাম। তারমানে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারেও… পরমা– ওঃ ঐ আর এক যন্ত্রণা! ওর থেকে ঝাড়ু দিয়ে সহজে কাজ হয়। প্রসূন– তাহলে মোদ্দা কথাটা হল যে আমাদের এখনই একজন কাজের মানুষ চাই, তাই তো? জুঁই– হ্যাঁ, সেটাই। প্রিয়ম– আচ্ছা বাবা, তুমি লাস্ট ইয়ার যে চাকরিটা ছেড়ে দিলে, সেখানেও এইরকম প্রবলেম হচ্ছে এখন? প্রসূন– না প্রিয়ম, এতোটা হচ্ছে না। কারণ, আমরা যতোই কাজ করিনা কেন, আমাদের কেউ কাজের মানুষ তো বলেনা! প্রিয়ম– তাহলে ওরা কীকরে নতুন লোক পাবে? প্রসূন– অনেক এজেন্সি থাকে, সেখান থেকে রিক্রুট করে নেয়। অলরেডি নিয়েছে নিশ্চয়ই আমার রিপ্লেসমেন্ট। প্রিয়ম– তাহলে সেই এজেন্সিকে বললে সন্ধ্যামাসির রিপ্লেসমেন্ট দেবেনা? পরিমল– বাঃ, এটা কিন্তু ভালো আইডিয়া। হ্যাঁ, এখন অনেক এজেন্সি তো হয়েছে এ রকম শুনি! কথা বলে দেখলেই হয়! প্রীতি– রাইট, খুব ভাল আইডিয়া। আমি আনন্দকে ফোন করছি, ও এইসব জানবে। পরিমল– ব্যস, আর চিন্তা নেই। আমাদের কাজের লোক পাওয়া গেছে। পরমা– পাওয়া গেছে! কে? পরিমল– কেন, ঐ আনন্দ! সর্বঘটেই তো আছে, কাজের লোক আর কাকে বলব! প্রীতি– উফফ, বাবা, তুমি না! পরিমল– আচ্ছা ঠিক আছে, আনন্দর জানাশোনা কোনো এজেন্সির নম্বর থাকলে দিতে বল, আমিই নাহয় কথা বলছি।
——————— (এজেন্সিকে ফোন) পরিমল– হ্যালো, এটা কি সর্বকর্মা এজেন্সি? ব্যক্তি– হ্যাঁ, সর্বকর্মা থেকে বলছি। নমস্কার। বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি? পরিমল– আসলে কাজের লোক, মানে বাড়িতে কাজ করবার হেল্পিং হ্যাণ্ড-এর ব্যপারে কিছু জানবার ছিল। ব্যক্তি– আপনার নাম, ঠিকানা, বয়স আর কাজের অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে বলুন। পরিমল– না না, আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে, আমি কাজ খুঁজছি না! আমার বাড়িতে… ব্যক্তি– হ্যাঁ, এগুলো সেজন্যই দরকার। আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড না জানলে তেমন লোক পাঠাবো কী করে, যাদের সঙ্গে আপনি, বা আপনারা মানিয়ে নিতে পারবেন! পরিমল– ওরেবাবা, এত কিছু হয় নাকি! ব্যক্তি– দেখুন, আমাদের এক্সক্লুসিভ সার্ভিস। আমাদের সমস্ত হেল্পিং হ্যাণ্ডরা এজুকেটেড, কমপক্ষে গ্রাজুয়েট। আমরা ওঁদের হাউসহোল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট বলি। অনেকে ড্রাইভিং, অতোমোবাইল রিপেয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল সার্ভিসিং, টিভি-এসি মেকানিক, অনেকে টিচার… পরিমল– দাঁড়ান দাঁড়ান, আমার মাথা ঘুরছে! বাড়িতে কাজ করবার জন্যে এতকিছু! ব্যক্তি– স্যর, আজকাল কাজ কথাটা অনেক ভাস্ট। ধরুন আপনি এমন একজনকে চাইছেন যিনি আপনার বেবি সীট করাবেন, বা হোম ওয়ার্কও করাবেন, তাহলে… পরিমল– মানে, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, সবই… ব্যক্তি– ইঞ্জিনীয়ার তো অনেকেই আছেন, ডিপ্লোমা এবং ডিগ্রীও। ডাক্তার এখনো আসেননি, তবে এসে যাবেন। জানেনই তো, চাকরির যা বাজার, আমরা সেইজন্যই এই সার্ভিস দিচ্ছি। পরিমল– আচ্ছা, ইয়ে, মানে, আপনাদের চার্জ কী রকম হয়? ব্যক্তি– থার্টিফাইভ থেকে শুরু। পরিমল– সকলেই থার্টিফাইভ ইয়ার্স ওল্ড, নাকি এক্সপিরিয়েন্স? ব্যক্তি– না না, এটা আমাদের মান্থলি চার্জ। খুব নমিনাল চার্জ নিই আমরা। পরিমল– তার মানে!! মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা!! ব্যক্তি– জিএসটি নিয়ে আর একটু বেশী পড়বে। তবে এক্সক্লুসিভ সার্ভিস। কোনো কমপ্লেইনের সুযোগই পাবেন না। পরিমল– আচ্ছা, একটা কৌতূহল, আপনাদের যাঁরা সার্ভিস দেন, সকলেই কি ইয়াং? ব্যক্তি– তা নয়, অনেক সিনিয়ার সিটিজেনও আছেন। আজকাল অনেকে ঠাকুর্দা-ঠাকুমার রিপ্লেসমেন্ট চাইছেন, যাঁরা ছেলেমেয়েদের গল্প শোনাবেন, ঘুম পাড়াবেন ইত্যাদি। পরিমল– রিটায়ার্ড চাকুরে হলে চলবে? ব্যক্তি– কেন চলবে না! অনেকেই চান এইরকম… পরিমল– তাহলে আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন না ভাই! রিটায়ার করে বসে আছি, আর যা টাকার কথা বললেন, সেটা আমি আজীবন চাকরি করেও হাতে পাইনি, তাই যদি… ব্যক্তি– আপনি মজা করছেন স্যার! পরিমল– অবশ্যই মজা করছি, কিন্তু সেই মজা শুরু করেছেন আপনিই! ঘর ঝাঁট দেওয়া আর জামাকাপড় কাচবার জন্যে মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা? চ্যাংড়ামো হচ্ছে? ব্যক্তি– আপনি বুঝতে পারছেন না, আমাদের সার্ভিস এক্সক্লুসিভ! পরিমল– আরে রাখো তোমার এক্সক্লুসিভ ইনক্লুসিভ!! দরকার নেই আমার। গুড বাই! (ফোন রাখেন। পরমার প্রবেশ) পরমা– কী হল, অনেক টাকা চাইছে তো? জানতাম। ঐ আনন্দর দেওয়া নম্বর মানেই বড়লোকি ব্যাপার। আর প্রীতিটাও সেই সঙ্গে নাচে। পরিমল– কিন্তু তাহলে এখন উপায়? পরমা– উপায় হয়ে গেছে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে যে কাজ করে, তার নাম প্রমীলা। তাকে বলেছি আমাদের বাড়ির কাজটাও করে দিতে। পরিমল– করবে বলেছে? পরমা– এখনো সেটা বলেনি, তবে বলেছে কাল সকালে আসবে ঘরদোর দেখে ফাইনাল জানাবে। পরিমল– কাল সকালে কেন? আজ আসবে না কেন? পরমা– আজ নাকি ওর টাইট পোগ্রাম, মানে আমাকে তাইই বলল। কাল সকাল দশটায় সময় দিয়েছে। পরিমল– এর সঙ্গেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে কথা বলতে হবে! যেন আমরা চাকরির ইন্টারভ্যু নিচ্ছি! পরমা– একটু ভুল হচ্ছে তোমার। কাল ইন্টারভ্যু আমরা দেব, ও আসবে এটা দেখতে, যে আমরা ওর সার্ভিস নেওয়ার যোগ্য কি না! আমরা পাশ করলে ও কাজ করতে রাজী হবে। পরিমল– হায় রে!!