“নারী-দি-বস” উদযাপনে দিলীপ কুমার মিস্ত্রী
by
·
Published
· Updated
আমার শুধু মা
।১।
‘বেহায়াছেলে কোথাকার। এতো গালাগাল করি সারাদিন, তবুও তোর লজ্জা হয়না ! দূর হয়ে যা না আমার চোখের সামনে থেকে। তোর কি মরণও হয়না !’
চোদ্দ বছরের কিশোর সুতনু। মায়ের অহেতুক এমন তিরস্কার নির্বিবাদে, শান্তভাবে দাঁড়িয়ে হজম করল। কোনও প্রতিবাদ সে জানাল না। শুধু মায়ের মুখে একদৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। একসময়, তার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামতে দেখে, মা’ই গুটিগুটি–পায়ে সেখান থেকে সরে যেতে উদ্যত হল। আর মা চলে যাচ্ছে দেখে সুতনু তাকেই কাতরস্বরে একবার ডাকল, ‘মা’।
।২।
সুতনু পিতৃহীন। অবশ্য তাকে পিতৃহীন বলাটা ঠিক নয়। কারণ তার মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। এই দ্বিতীয়বার বিয়ের পিছনেও অনেক বিষয় জড়িয়ে রয়েছে।
আজ থেকে বারোবছর আগের ঘটনা। সুতনুর বয়স তখন মাত্র চোদ্দমাস। এক পথ–দূর্ঘটনায় ওর বাবা হঠাৎ মারা যায়। ওর মায়ের বয়স তখন খুবই অল্প। পঁচিশেরও নিচে। তারওপর যথেষ্ট সুন্দরী এবং অঢেল বিষয়–আশয়। অনেকের কুনজর পড়ে গেল তার দিকে। অনেক ভেবেচিন্তে, সুতনুর মা শুভ্রা নিজের সম্পর্কে মামাতো দেওরকে বিয়ে করল, স্বামী মারা যাবার মাত্র সাতমাস পর।
আত্মীয়–স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী, নানামুণির নানান কথা এবং উপদেশ তাকে শুনতে হয়েছে। কিন্তু শুভ্রা নিজেকে এই নিয়ে কখনও কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি। সে বাপেরবাড়ি, কাছের মানুষ, সকলকে বুঝিয়েছে, এছাড়া সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। অলক তন্ময়ের আপন মামাতো ভাই। সম্পত্তি পেলে তো ওর ভাইই পাবে। তাতে তন্ময়ের আত্মা খুব একটা কষ্ট পাবে না। তাছাড়া, অলকও পিতৃহীন নিজের টাকে কোনদিনই ফেলতেআমাকে ওই !’
। ৩ ।
দু–তিনটে বছর মোটামুটি ভালোই কাটল। বিয়ের আগে অলক নিজে কিছুই করত না। বাড়ির অবস্থাও তথৈবচঃ। চার–চারটে ভাই। দুটো অবিবাহিত বোন।বাবার সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার কিছু নেই বললেই চলে। তাই সে বিয়ের পরেই নিজের বাড়ি ছেড়ে এখানেই পাকাপাকিভাবে চলে এল। দাদার ব্যবসার দায় সম্পূর্ণভাবে নিজের কাঁধে নিয়ে নিল। ভালো, চালু জামাকাপড়ের ব্যবসা। রতনপুর বাজারে সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকান বলতেই তন্ময়ের এই দোকান। সাত–সাতজন কর্মচারী রয়েছে। না চাইতেই অলকের ভাগ্যে জুটে গেল সুন্দরী বৌ, গাড়ি–বাড়ি, আর অগাধ টাকাপয়সা। একপ্রকার লটারি পাওয়ার মতো।
বছরতিনেক পর, শুভ্রা–অলকের সংসারে এক নতুন অতিথি এল– একটি কণ্যাসন্তান। সুতনুর বয়স তখন পাঁচ ছুঁই ছুঁই। দুটোমাস গড়াতেই তার কপালে দুঃখ জমতে শুরু করল। অলক ইদানিং সুতনুকে আগের চেয়ে একটু কম সহ্য করতে পারে। ছেলেটার জন্য শুভ্রাকে আজকাল অনেকরকম কথা শুনতে হয়। শুভ্রা কখনও–সখনও একটু–আধটু প্রতিবাদ করে। কিন্তু তার প্রতিবাদের ধার ক্রমশঃ কমতে থাকে। অলকের মারমুখী মেজাজের সামনে শুভ্রা ক্রমেই নিজের নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। তাছাড়া, একেবারেই সহজ–সরল ছেলে সুতনুকে নিয়ে তার সামনে নতুন নতুন সমস্যাও এসে হাজির হচ্ছে। যা নিয়ে শুভ্রাও হাঁপিয়ে উঠছে।
। ৪ ।
শুভ্রার মেয়ের বয়স এখন চার। শুভ্রা আবার একজনের মা হতে চলেছে। ছেলে সুতনু ক্লাস ফাইভে পড়ছে। কিন্তু বরাবরই তার ডালমাথা। ওর বাবাও এমন ছিল। লেখাপড়ায় তার কোনকালেই মন ছিল না। তাই টেনেটুনে মেট্রিকটা পাশ করেছে চারবারে। কিন্তু ব্যবসায় তার সাথে কেউ পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি। রতনপুর বাজারে আজও সক্কলে তার কথা বলে। অলকও তাই শুভ্রাকে মাঝেমধ্যে বলে, ‘সুতনুকে আর পড়িয়ে, অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই। অহেতুক পয়সা খরচও হচ্ছে। তার চেয়ে দোকানে লেগে পড়ুক। কাজটা শিখুক। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।‘ শুভ্রা অলকের কথায় কান দেয়না। তন্ময়ের মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারই পাশাপাশি, ছেলে সুতনুকেও সে দেখে।
। ৫।
অলক আজ বেজায় খুশি। বাজারে সমস্ত দোকানদার, বন্ধুদের সে মিষ্টিমুখ করিয়েছে। পাড়া–প্রতিবেশীরাও কেউ বাদ যায়নি। সন্ধ্যায় তার দোতলা বাড়ি টুনির আলোয় ঝলমল করছে। বাড়ির উঠোনে, পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে ধেই ধেই করে নাচছে সুতনু আর তার বোন অনসূয়া। আজ এই আনন্দ উৎসবের মাঝে এ’বাড়ির একজন মাত্র মানুষ নিজ মনের এতটুকু আনন্দ–উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করতে পারছে না– সে আর কেউ নয়, শুভ্রা। কেননা, নার্সিংহোমে তার কোলে আজ যে শিশুটি হেসে উঠেছে, সে যে এক পুত্রসন্তান। এরপর সূতনুর জন্য যে এক ভয়ংকর, কঠিন ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে, তা ভেবেই শুভ্রা ভীষণ আতঙ্কিত। আজ অলক আর তার ভাবনার মাঝে যে বিস্তর তফাৎ সেটা সে স্পষ্ট এবং হাড়েহাড়ে অনুভব করছে। আর ভেতরে ভেতরে তীব্র যন্ত্রণায় শুধু ছটপট করছে । বাড়িতে আনন্দের বন্যা বইছে জেনেও নিজের কষ্টের কথা কা’রও কাছে বলতে পারছেনা। এ কষ্টটা ভেতরে ক্রমেই বাড়ছে। নার্সিংহোমের স্টাফরা তার অস্বস্তি ধরে ফেলেছে। একজন আয়া তো তাকে প্রশ্ন করেই বসল, ‘ম্যাডাম, ছেলেতো হয়েছে। তবু মুখ শুকনো কেন ?’
।৬।
ইদানিং শুভ্রার সংসারে নিত্যঅশান্তি যেন লেগেই রয়েছে। আর অশান্তির মূল কারণ একটাই– ছেলে সুতনু। অলক আজকাল সুতনুকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। নানান অছিলায় সে তাকে বকাঝকা, এমনকি মারধরও করছে প্রায় নিয়মিত। শুভ্রাও আর পেরে উঠছে না। আরও দুটো বাচ্চা, সংসারের হাজার কাজ। তারমধ্যে রোজদিন এই অশান্তি, আর কাহাতক্ ভালো লাগে। সেও আজকাল ছেলে সুতনুর ওপর তার বিরক্তি নানাভাবে প্রকাশ করে ফেলছে। সুতনু সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেও কখন প্রতিবাদ জানিয়ে মাকে একটি কটুকথাও বলে না। মা তাতে আরও অবাক হয়। কারণ ছেলেতো যথেষ্ট বড় হয়েছে।
সুতনু এবার চোদ্দতে পা রেখেছে। কিন্তু বোধবুদ্ধিতে একটুও এগোয়নি। বাড়িতে খেতে–বসতে–শুতে; সবসময় বাবা–মায়ের তিরস্কার, চড়–থাপ্পড় যেন রুটিন মাফিক ব্যপার। কিন্তু তাতে তার খুব বেশি রাগ হয়না। খুব বেশি হলে, চোখের জল ফেলে নিজের মনকে একটু হালকা করে নেয় সে। আর তার সবচেয়ে বড়গুণ, দুই ভাইবোনের ওপর অসম্ভব টান, ভালোবাসা। বোন তার চেয়ে বছর চারেকের ছোট। আর ভাই প্রায় ন’বছর।
।৭।
সকাল নটা বাজল। সুতনু স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি। তার ভাই–বোন আগেই বেরিয়ে গেছে। তাদের যাতায়াতের জন্য নিয়মিত গাড়ি আসা–যাওয়া করে। সুতনু বাড়ির কাছেই সরকারি স্কুলে পড়ে। তাই সে হেঁটেই যায় আসে।
রোজকার মতো সে স্কুল–ব্যাগটি পিঠে নিয়ে, ঘর ছেড়ে বেরুবার মুখে হাঁক পাড়ল,’মা,বাবা আসছি !’ ব্যাস, তার হাঁক শুনে, ঘরের ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এল অলক। সে সুতনুর চুলের মুঠি ধরে, গালে–পিঠে অবিরাম চড়–কিল মারতে শুরু করল। সেইসঙ্গে চিৎকার করে বলতে লাগল,’অসভ্য, জানোয়ার কোথাকার। তোকে আজ মেরেই ফেলব। তোকে না আমি বলেছি, আমাকে বাবা ডাকবিনা। কে তোর বাবা ? আমি তোর বাবা নই। তোর বাবা মরে ভূত হয়ে গেছে।‘
ছেলের এমন অবস্থা দেখে মা আর সহ্য করতে পারল না। ছুটে এসে ছেলেকে বাঁচাতে চেষ্টা করল। আর তাতে অলকের মধ্যে রাগ আরও বেড়ে গেল। সে গলার আওয়াজ আরও একটু চড়িয়ে বলতে লাগল,’বাজে মেয়েছেলে কোথাকার। একজনকে খেয়েছিস, তাতে তোর শান্তি হয়নি ? ভেবেছিস, আমাকেও খাবি ? তোর সেগুঁড়ে —-!’
এরপরই অলক সুতনুকে ছেড়ে, একধাক্কায় শুভ্রাকে মাটিতে ফেলে দিল। তা দেখে, আপাত কেবলা–ছেলে সুতনু হঠাৎই যেন একটা হিংস্র বাঘ হয়ে উঠল। ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার উপর। কিন্তু তার পক্ষে কী সম্ভব একজন সমত্ত মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠা। অলক সুতনুকে মাটিতে ফেলে তার গলা টিপে ধরল। শুভ্রা প্রাণপণ চেষ্টা করেও কিছুতেই ছেলেকে বাঁচাতে পারলনা। নিরূপায় হয়ে সে চিৎকার করে প্রতিবেশীদের ডেকে আনল। তারা এসে ছেলেটাকে প্রাণে বাঁচাল বটে, তবে তাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করতেই হল। অলককে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। অ্যাটেম্–টু–মার্ডার কেস।
সুতনুর আঘাত গুরুতর। চিকিৎসা চলছে। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, বেঁচে গেছে অল্পের জন্য। তবে কয়েকদিন থাকতে হবে এখানে। ওর মানসিক আঘাতটাও তো কম নয়। সাইকো–থেরাপিও প্রয়োজন।
শুভ্রা তিনবেলা নার্সিংহোমে যাওয়া–আসা করছে। সঙ্গে যাচ্ছে দুই ছেলেমেয়ে। দাদার অসুস্থতার কারণে ওদের মনও একদম ভাল নেই। নার্সিংহোমে গিয়ে দুই ভাইবোন দাদার মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে আদর করে। আর শুধু একটি কথাই বলে, ‘ঠাকুর, আমাদের দাদাকে তাড়াতাড়ি ভালো করে দাও। তোমাকে আমরা অনেক কিছু দেবো।‘
।৮।
সুতনু এখন কিছুটা সুস্থ। সকালে ওর ভাইবোনেরা আজ অনেকদিন পর স্কুলে গিয়েছে। মা তাই একা ছেলের কাছে এসেছে নার্সিংহোমে। বেডে বসে রয়েছে সুতনু। মা তার পাশেই বসেছে একটা টুলের ওপর।
মা ছেলেকে আদর করতে করতে কেঁদে ফেলল। সুতনু হাত দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘মা তুমি শুধু শুধু কাঁদছ। আমিতো একদম ভালো হয়ে গেছি।‘
ছেলের কথা শুনে মায়ের কান্না আরও বেড়ে গেল। সে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে খুব কষ্টে বলল, ‘ বাবা, তোকে আমি এতো গালাগালি বকাবকি করি, তবু তুই কেন আমার কাছে পড়ে পড়ে মার খাস বল তো ? এখানে থাকলে, তুইতো একদিন মরেই যাবি। হতভাগা ছেলে, তুই অন্য কোথাও, অন্য কা’রও কাছে চলে যেতে পারিসনা ?’
ছেলে এতোক্ষণ ঠিকই ছিল। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে, এবার সে দুচোখ লাল করে, ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগল। দুহাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’ মা, তোমার তো মা আছে। বাবা আছে। স্বামী আছে। ছেলেমেয়ে আছে। আছে ঘরবাড়ি টাকাপয়সা। কিন্তু মা, আমার যে মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই !’