• Uncategorized
  • 0

“নারী-দি-বস” উদযাপনে যশোধরা রায়চৌধুরী

মেয়েদের প্রতিবাদী কবিতা

ঠিক কোন মুহূর্তে, সাধারণ অর্থে, আমরা একটি লেখাকে প্রতিবাদী বলি, রাজনৈতিক বলি?
কবিতার ভেতরে জ্বালাময়ী বক্তব্য থাকতে হবে, নাকি কবিকে কোন রাজনৈতিক পার্টির সদস্য হতে হবে? নাকি কবির সঙ্গে থাকতে হবে কোন এক বিপন্ন সময়ের নাড়ীর যোগ? কোন না কোনভাবে কি কবি চাইবেন সেই অনুভূতিগুলিকে শব্দে তুলে আনতে, যেগুলির ভেতর কোন না কোনভাবে রয়ে গেছে তাঁর চারপাশের বিক্ষত, বিধ্বস্ত অবস্থার প্রতি প্রতিক্রিয়া? সহজ করে বললে, কবিকে স্পর্শ করছে এমন কিছু, যা অশুভ, যা অন্যায়… এবং তাঁর লেখায়, কবি , সেই কথাটা কোনভাবে তুলে আনছেন।
যখন আমরা প্রথম বর্ষের ছাত্রী, আমাদের ইউনিয়নের বামপন্থী দাদাদের কাছে প্রথম রাজনীতির পাঠ, হাতেখড়ি চলছে, তখন একটা কথা শুনেছিলাম। এখনো কানে লেগে আছে। এবং এখনো বেদবাক্যের মতই সত্য।
“সবকিছুর মধ্যেই, বুঝলি, রাজনীতি আছে। এই যে তুই একটা জামা পরেছিস, এই যে তুই একটা বই ফেলে অন্য একটা বই কিনলি, এই যে তুই বাসে না উঠে ট্যাক্সিতে উঠলি, এগুলো প্রতিটি একটা করে রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট। আজ যে বিষয়ে একটা প্রশ্ন উঠবে, সেখানে যদি দুজন কথা বলে আর তিনজন চুপ করে থাকে, এই চুপ করে থাকাটা দিয়ে সেই তিনজন কিন্তু রাজনীতির বাইরে থাকতে পারল না। সেও কিন্তু তার নীরবতা দিয়ে একটা রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট দিচ্ছে মনে রাখিস। কোনও কিছু রাজনীতির বাইরে নয়।“
এই কথার পিঠোপিঠি আরও অনেকগুলো কথা উঠে আসে। এক, অবস্থানহীনতাও একধরণের অবস্থান।  দুই , যে কোন মূল্যবোধই আসলে রাজনৈতিক , যে কোণ সচেতনতাই আসলে রাজনৈতিক।
এই রাজনীতির সঙ্গে আজকের দিনের মারকুটে প্রশ্নসংকুল রাজনীতির যোগ নেই। আবার একইসঙ্গে, এর পরে, বহু বছর ধরে আমাদের জীবনযাপনে , পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে যাকিছু দেখেছি , শিখেছি, জেনেছি, সবেতেই বার বার প্রমাণিত, ব্যক্তিগতই আসলে রাজনৈতিক। প্রতিটি মুহূর্তের বেচে থাকায় আমাকে অবস্থান নিতেই হয়েছে, আর আমাদের চারপাশেও , যেভাবে কবিতা লেখা হয়, ভাবা হয়, পড়া হয়, তাও পালটে গেছে।

২    

মেয়েদের লেখাকে নারীবাদীরা বিশেষ করেই বলেছেন রাজনৈতিক। সে অর্থে, যাঁরা সজোরে, সোচ্চারে প্রতিবাদী কবিতা লেখেননি কখনো, সেই মহিলাটি, রান্না করার আর শিশুপালনের ফাঁকে ফাঁকে প্রথম যেদিন একটা গোপন খাতায় কবিতা লিখছিলেন, তিনি আসলে বিপ্লবী। কেননা তাঁর সমাজ, তাঁর পরিপার্শ্ব, সবচেয়ে বড় কথা তাঁর পরিবার তাঁকে সে লেখায় উৎসাহ দেয়নি বা দেবেনা কখনো। অথবা , ওপরে ওপরে উৎসাহ দেখালেও, সে উৎসাহের পর পরই তাঁর ওপরে আসবে এমন সব দাবি, তাঁর সময়ের ওপরে আসবে এমন সব চাহিদা, যে লেখার ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়াবে এক লড়াই। একইসঙ্গে, তাঁর লেখার বিষয় যা-ই হোক, অন্তরে, অন্তরালে কোথাও তাঁর ওপর একটা শাসনের, নিষেধের বেড়াজাল আছেই, সেটাকে অস্বীকার করতে পারার  ওপরেই নির্ভর করছেন তিনি আদৌ কিছু লিখে উঠতে পারবেন কিনা। একইসঙ্গে, লেখার পরবর্তী যে প্রক্রিয়া, ছাপার, প্রকাশিত হবার যে প্রক্রিয়া, তাও এক রাজনীতি বৈকি। এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই এক নারীর লেখক হয়ে উঠতে পারা।
নারীর কলম তুলে নেওয়াই যদি হয়ে থাকে প্রতিবাদ, তবে বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় অন্নদাসুন্দরী দেবী বা জীবনানন্দ মাতা কুসুমকুমারী দেবীর মত গৃহবধূরাই প্রথম প্রতিবাদী নারী কবি। যদিও তাঁদের লেখায় পাব ঈশ্বর প্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, সৌন্দর্যের আরাধনা অথবা প্রেমের লীলার বিবরণ, পাব এমনকি স্বামীর প্রতি শ্বদ্ধার অর্ঘ্যও। তবু। এই অন্তঃপুরিকারা কীভাবে যে নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়েছিলেন। তবু এদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করব আমাদের বাংলা ভাষার কি সেই সৌভাগ্য হবে কোনদিন?
“আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দেবী … তাঁর কয়েকটি অপ্রকাশিত কবিতা ছাড়া অন্য কোন লেখা আমাদের কারো কাছে নেই। তখন কার দিনের সেই অস্বচ্ছল সংসারে একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠল না আর… কবিতা লেখার চেয়ে কাজ ও সেবার সর্বাত্মকতার ভেতরে ডুব দিয়ে তিনি ভালই করেছেন হয়ত। “ এই কথা লেখেন আমাদের বাংলা আধুনিক কবিতার দিগ্‌দর্শক জীবনানন্দ। বামাবোধিনীর মত পত্রিকায় কবিতা পদ্য লিখতেন কুসুমকুমারী। তবু যে ধরণের প্রশ্রয় পেলে একজন মানুষ কবি হয়ে উঠতে পারে, সে অবসর নারীরা পাবেন কোথায়।  অপূর্ণতা , অর্ধমনস্কতা, অতৃপ্তি, বঙ্কিম কথিত “আধখানা মালার নারকেল” হয়ে থাকার বেদনা, এই খন্ডিতের নিয়তি নিয়ে বাংলা কবিতার অন্তঃপুরিকারা আমাদের প্রথম প্রতিবাদিনী। তাঁদের প্রতি প্রণাম জানাই।

এইসবের পরেও বলি, এর পর গঙ্গা পদ্মা দিয়ে অনেক জল যেহেতু গড়িয়ে গেছে, সেইহেতু আমাদের চোখ পাততেই হবে, পরবর্তী নারীদের দিকে, যাঁরা অনেককিছুকে অস্বীকার করে, অনেক বেশি করে লড়েছিলেন। অপরাজিতা দেবী নামের আড়ালে ১২ বছর নিজেকে গোপন রাখার দরকার কেন পড়েছিল রাধারাণী দেবীর মত অসামান্যা সাহিত্যিকের? পরবর্তীতে স্বনামেও তিনি ধন্যা। আজকের নবনীতা দেবসেনের মা, রাধারানী রবীন্দ্র স্নেহ লাভ করেছিলেন, তাঁর কলম জন্ম দিয়েছে অনুকারী কবিদের। তবু তথাকথি অর্থে তিনি প্রতিবাদী ছিলেন না। অথচ নিবিড় ব্যক্তিগত, প্রেম ও মিলনের প্রতি সেযুগের রক্ষণশীলতার নিরিখে যথেষ্ট নির্ভীক ও অলজ্জভাবে আকাংক্ষা ময় কবি তিনি।
সেই  অসামান্য কলম পেরিয়ে ১৯৪০ এর দশকে এসে দাঁড়ালেই দেখব, বাকি সব ক্ষেত্রের মত কবিতার ক্ষেত্রেও বাংলার মেয়েরা চাইছেন পুরুষের কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়তে। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানচর্চায়, সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানের চর্চায়, বামপন্থী আন্দোলনে, সর্বক্ষেত্রেই মেয়েদের প্রবল উপস্থিতি নজরে পড়বে। বিশেষত ২০-৩০ এর দশক থেকে । সেসবের পাশেই , কবিতা আন্দোলনে পঞ্চাশের দশকে যে সব মেয়েরা নির্ভীক উচ্চারণে উঠে এলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যা কবিতা সিংহ।
কবিতা সিংহ (১৯৩১- ১৯৯৮)  একবার লিখেছিলেন মেয়েদের মাথার বাইরের দিকটা নিয়ে সকলের আগ্রহের কথা, বলেছিলেন মেয়েদের মাথার ভিতরের দিকটাকে নিয়ে কারুর মাথাব্যথা নেই।  সেটা ৫০ দশক , আজ থেকে ষাট বছর আগের কথা । সেজন্যেই কথাটি আলাদা করে ভাবায়।  এই সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে বাবা মায়েরা , অন্তত বাঙালি বাবা মায়েরা , ছেলে হোক বা মেয়ে, অংকে ৮০-৯০ না পাওয়াকে অপরাধ ভাবেন, সেখানে কথাগুলির ধার সামান্য কমে এসেছে বলে মনে হয়? কিন্তু কবিতায় কবিতা সিং হের বিস্ফোরণ ক্ষমতা এখনো অম্লান।
কবিতায় প্রথম কবিতা সিং হই আমাদের জানান যে অশ্রু আর মূত্র একই উপাদানে গঠিত কিন্তু “বিভিন্ন পাইপে যায় চক্ষু আর শিশ্ন অভিমুখে”। ( ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা হলে)।  নিজস্ব স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণের কথাটি কবিতা সিংহ অন্য অভিধায় বলেছিলেন, যখন তিনি বলেন :আমিই প্রথম/বুঝেছিলাম/দুঃখে সুখে/পুণ্যে পাপে/জীবন যাপন/ অসাধারণ… স্বর্গ নির্বাসিত প্রথম পাপ –জানা ইভের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘ভেঙেছিলাম/ হইনি তোমার/হাতের সুতোয়/নাচের পুতুল/ যেমন ছিল/অধম আদম/আমিই প্রথম বিদ্রোহিণী/ তোমার ধরায়/আমিই প্রথম।/…আমিই প্রথম/ ব্রাত্যনারী/স্বর্গচ্যুত/নির্বাসিত/জেনেছিলাম/স্বর্গেতর/স্বর্গেতর/ মানব জীবন/ জেনেছিলাম/আমিই প্রথম।
অথচ এই ইভের সত্তার ভেতরে বহিষ্কৃত ছিল না আদম, কারণ ‘আমিই প্রথম /নর্ম সুখের/ দেহের বোঁটায় /দুঃখ ছেনে/… তোমার পুতুল/ বানানো যায়/ জেনেছিলাম…’ এই কাহিনিতে বহিরাগত নয় প্রেম ও যৌনতা সুতরাং। কাহিনিটি এক্সক্লুসিভ নয়, ইনক্লুসিভ, আজকের ভাষায়। যা অনেক নারীবাদী আগে বা পরে স্বীকার করেননি। পুরুষ বিদ্বেষের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীবাদ, পাঠকের চোখে।
কবিতা সিংহ তাঁর জীবনদর্শনে এক লপ্তে ঢুকিয়ে নেন পুরুষকে, লেখার ভেতরে পুরুষের কাছ থেকে যা চাহিদা তা-ও জানাতে ভোলেন না, অর্থাৎ এক ইউটোপিক বা আদর্শ পুরুষ ছবি রচনার প্রয়াসও তিনি নেন।  তিনি নির্মাণ করেন এক “বিকল্প পুরুষ”। ‘স্বয়ংক্রিয়’ কবিতাটিতে তাঁর বলা, সেকেন্ড হ্যান্ড বাজার থেকে “দারুণ সস্তায়” কিনতে পারা যাবে এমন এক বিকল্প পুরুষ-এর কল্পবৈজ্ঞানিক মডেল।  যা “বাতিল স্বয়ংক্রিয়” এবং যাতে “একশো চুম্বন পাবে এই লাল সুইচ জ্বালালে/ চারশত তোষামোদ, কবিতার উদ্ধৃতিসমেত/ আলিঙ্গন / যৌনক্রিয়া/মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকা খয়েরি গোলাপি নীল এইসব বিবিধ বোতামে” পাওয়া যাবে “বারো ঘন্টা নাগাড়ে সমানে/ মাত্র এক লিটারের পবিত্র ডিজেল বিনিময়ে।
১৯৬৩ সালে লিখিত এই ‘স্বয়ংক্রিয়’ কবিতাটি। ভুললে চলবে না তার সামান্য কয়েকদিন আগেই কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে আমাদের পূর্বেই উল্লিখিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কয়েক মুহূর্তে’ নামের সেই বিখ্যাত কবিতাটি, ২০০৭ সালেও নবনীতা দেবসেন যার উল্লেখ করতে ভোলেন না যৌন প্রসঙ্গের কবিতা হিসেবে, এবং মন্তব্য করেন “অত্যন্ত শক্তিশালী কবিতা, ভাষায় অথবা ভাবনায় অশ্লীল কবিতা নয়”।
জানতে ইচ্ছে করে, কবিতা সিংহ সে সময় কবিতা লিখে “অশ্লীল” অভিধা পেয়েছিলেন কিনা। নিজেদের ইচ্ছে, কল্পনা আর চাহিদার কথা লিখলে সচরাচর যেটা মেয়েদের প্রাপ্য। প্রশ্ন আর প্রশ্ন, নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে বিক্ষত করে তার পথ চলা। কবিতা সিংহ এর পর লেখেন,
কিছু কি আলাদা রাখো ?
 শমীবৃক্ষে, রমণী হে একা?
সত্যকার এলোচুল, সত্যকার রমণীনয়ন
 সত্যকার স্তন?
 খুলে রাখো নিজস্ব ত্রিকোণ?
 তারপর চলে যাও বিরাট রাজার ঘরে –
 আহা যেন স্মৃতিভ্রষ্ট অজ্ঞাতবাসিনী
 খুলে রেখে চলে যাও সত্যকার শ্রোণী…
 শমীবৃক্ষে অস্ত্র খুলে রাখো
 খুলে রাখো রমণী ধরম
 কিম্পুরুষের সঙ্গে ঘটে যায় পৃথিবীর
 সমস্ত অফলা সঙ্গম।   ( পৃথিবী দেখে না )
লক্ষ্য করব, এখানে মহাভারতের চরিত্র ও ঘটনার সূক্ষ্ম ব্যবহার । কবিতা সিংহ উল্টিয়ে জামা পরার মত মহাভারতের বিখ্যাত অজ্ঞাতবাস পর্বের কাহিনিটিকে উলটো করে দেখান, ভেতরদিককে বাইরে আনেন, অর্জুনের কিম্পুরুষ বৃহন্নলার ছদ্মবেশধারণের কাহিনি থেকে ধার নেন নারীর নিজ সত্তা হারানো ও খুঁজে পাওয়ার কোয়েস্টকে ।  পুরুষ অর্জুনের সঙ্গে নারীর তফাত হল, সে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে, নিজের সমস্ত সবলতার স্থানকে শমীবৃক্ষে লুকিয়ে রেখে এসে। নিজের যৌনতাকে ফিরে পেতে তাকে যুগ যুগান্ত বাহিত নারীবিষয়ক অপপ্রচারের অজ্ঞাতবাস ঝেড়ে ফেলে  নতুন করে সক্ষম করে তুলতে হয় নিজেকে।
এখানে লক্ষ্য করব মীথ পুরাণের পুনর্ব্যবহারের নৈপুণ্য, আসলে মহাকাব্যের, পুরাণকথার, রূপকথার  পুনর্নির্মাণে,  বিনির্মাণে বাংলার মেয়েদের কবিতা ক্রমাগতই  নতুন নতুন মাইলফলক স্পর্শ করে চলেছে গত পঞ্চাশ বছর ধরে।
কবিতা সিংহের কবিতা কপটতা, আলতো প্রশস্তি, কুসুমপ্রস্তাব বিবর্জিত।  “সারা দেহ ফালাফালা,  ঢুকে গেছে জলের সোয়াদ/ টিনের তোবড়ানো মগে, কলকাতার কলঘরে/ উদোম সাগরে/ জলের নিকট হতে এ দেহের নিস্তার হল না/ জলে খালি দেহ মনে পড়ে  (পর্নোগ্রাফি) দেহবোধের এই অনাড়ম্বর গভীর উচ্চারণ কবিতা সিং হের নিজস্ব।
বয়সে বড় কবিতা সিংহের চেয়ে, রাজলক্ষ্মী দেবী (১৯২৭-২০০২) জীবনে ও লেখায় ছিলেন একইরকম আপোশহীন, আর নিজস্ব নারীসত্ত্বার নির্মিতিতে স্বয়ম্ভূ। সরাসরি যৌনতার কোন উল্লেখ অনেক নারীর মতই তারঁ লেখাতে আসেনি, নারীর কলমে অদৃশ্য পুরুষতন্ত্র অথবা নীতিবোধ রুচিবোধের চাপ থেকেই গেছে বরাবরের মত। কিন্তু প্রতীকে রূপকে তিনি বৈপ্লবিক, তাঁর সময়ের নিরিখে । তিনি অবশ্য-উল্লেখ্য , আমরা তাঁকে ভুললে খুব বড় ভুল করব। একটি একটি কবিতায় যে বিরাট বিস্ফোরণ তিনি রেখে গেছেন, সেটুকুর উদ্ধৃতিই যথেষ্ট তাঁর মননকে বোঝবার জন্য। হয়ত ফ্রয়েড পড়া শিক্ষিত মনন তাঁর, হয়ত বা আত্মদীপ হয়ে নিজেকে বুঝে নিতে পারার অলোকসামান্যতা তাঁর ছিল। তবু, ‘ঘোরানো সিঁড়ি’-র মত জটিল মনস্তাত্বিক কবিতা তার স্পষ্টতা নিয়ে আজো আমাদের স্তম্ভিত করে :
মনের পেছন দিকে ঘোরানো সিঁড়ির খোঁজ কাউকে দেবো না।
সেই সিঁড়ি বেয়ে শুধু রাতের কুটুম্বগুলি করে আনাগোনা।
মনের পশ্চিম কোণে চোর কুঠুরির খোঁজ পেয়ে গেছে তারা,
আর কেউ জানবে না, আর কেউ দেখবে না । সদরে পাহারা। …
মনের পেছনদিকে ঘোরানো সিঁড়িটা নামে কাণাগলি ঘেঁষে
রাতের কুটুম্বগুলি চুপি চুপি উঠে আসে কত ছদ্মবেশে –
নিয়ে যায় সোনাদানা, একদা যা-কিছু ছিলো মোটামুটি দামি।
আনন্দে অস্থির হয়ে রোমাঞ্চিত অন্ধকারে জেগে থাকি আমি ।
বাকি সখাদের প্রতি কবিতার মাঝামাঝি রাজলক্ষ্মীর উক্তি : “তোমরা রাত্রের এক বিশিষ্ট প্রহর এলে স্ব স্ব গৃহে যাবে,/ এবং যে যার দ্বারে হুড়কো এঁটে শুয়ে পড়বে সতর্ক স্বভাবে ।“
পুরুষ আর নারীর সম্পর্কজটিলতার এই আশ্চর্‌য অভিজ্ঞান এসেছে এমন এক কবির কবিতায়, যিনি বেঁচে থাকলে বয়স হত ৮৪! রাজলক্ষ্মী দেবী এসেছিলেন আমাদের চমকে দিতে। জীবইনযাপনেও তিনি প্রতিবাদিনী। লিখেছিলেন অদ্ভুত সব কবিতা, আত্মপ্রত্যয়ে ঋদ্ধ এবং জ্বাজ্যল্যমান।

৪০-৫০ পেরিয়ে এরপর আমরা চলে আসি ৭০- ৮০র দশকে। কারণ এই সময়ে কৃষ্ণা বসু, তসলিমা নাসরিন এবং মল্লিকা সেনগুপ্ত এই তিনটি মহিলা প্রতিবাদিনীর রূপে জেগে উঠলেন।
আমরা এখন কথা বলছি বাংলা কবিতা নিয়ে। এই নতুন মোড়কের নারীবাদ অনেকগুলি পুরনো ইস্যু বা চাপা পড়ে যাওয়া কর্মসূচীকে সামনে আনলেও যেটা এর ফলে ঘটল তা হচ্ছে নারী পুরুষ সম্পর্কের একটি মাত্র দিকের উপরেই আলোকপাত ঘটল বেশ কিছুদিন ধরে।
কবিতায় এই ভাষা শানিত ও তীক্ষ্ণ, কখনো বা রাজনৈতিকভাবে সঠিক নয়। কিন্তু উচ্চকিত এই কন্ঠ সহজেই নজর কাড়ে। তাঁর কবিতায় পুরুষ কেবলি অত্যাচারীর ভুমিকায়। প্রেমিকের ভূমিকা তাকে দেওয়া হয়নি।
‘মানুষ দেখো, মানুষ শোন চতুর্দিকে ঘিরে/ ওরা আমার সুডোল বাহু, কবজি কেটে নেবে/ ওরা আমার জিহবা কেটে উদর ফেঁড়ে উপড়ে নেবে চোখ/ কন্ঠনালী চেপে আমার শিরায় দেবে বিষ …/ বন্য মোষ, সাপ ও শার্দুলের ভয়ে নয়/ মানুষ হয়ে মানুষ ভয়ে দৌড়ে ফিরি ঘর ।‘ ( শাসন)
‘তাকে লাল রঙ জামা পরানো হয়/ কারণ লাল একটি চড়া রঙ, সহজে চোখে পড়ে। /… তার কান ছিদ্র করা হয় , একই সঙ্গে নাকও ।/ সেই নাক ও কানে পরানো হয় ধাতব পদার্থ/ নিজস্ব দ্যুতি কম বলে ধাতু অথবা পাথরের দ্যুতি যেন তাকে আলোকিত করে।/ তার হাতে চুড়ি পরানো হয়/ অনেকটা হাতবেড়ি, অনেকটা শিকলের মতো এর আকার।/ … তার মুখে রঙ লাগান হয়/ যেন কোন জড়বস্তুর উপর রং।/…একটি মানুষকে এভাবেই পণ্য করা হয়। ‘( চক্র)
একটি ছদ্ম নির্মাণপদ্ধতি বলার ছলে তীব্র শ্লেষের জন্ম দিয়ে কবিতাটি সফল নারীবাদী কবিতা। এই তীব্র অভিঘাত সৃষ্টিকারী বাচনের ফলেই ষাটের দশক পরবর্তী নতুন জোয়ারের নারীবাদের মার্কিনি মোড়কে মজে থাকা বাঙালি পাঠক (পড়ুন পাঠিকা) তসলিমাকে গ্রহণ করেছিলেন দু হাত বাড়িয়ে। সময়ের প্রয়োজনেই এই আমদানি। তাঁদের ততদিনে পড়া হয়েছিল,  সিমোন দ্য বভ্যোয়ারের দ্য সেকেন্ড সেক্স এর  কয়েকপাতা, অথবা রবিন  মর্গ্যানের পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল  স্লোগান। কিন্তু তাঁরা ভুলে গেছিলেন কবিতা সিংহ কে, রাজলক্ষ্মী দেবীকে। বিজয়া মুখোপাধ্যায়কে। রমা ঘোষকে।
অনস্বীকার্য এঁদের জোরালো অভিভাষণ। তাঁদের কিন্তু কখনো খুঁটিয়ে পড়া হয়নি বেগম রোকেয়া, অশোকা গুপ্তা রমা চৌধুরী। জানা হয়নি সওগাত পত্রিকার দীর্ঘ পরিক্রমা। অথবা জয়শ্রী, মন্দিরা, স্বাধীনতা, ঘরে বাইরে পত্রিকাগুলির ইতিবৃত্ত। স্বাধীনতাপূর্ব অবিভক্ত ভারতের যে সব নারীর রচনা আমাদের অলক্ষ্যে, আমাদেরই বিচরণভূমিটিকে কন্টকশূন্য করে তোলার নীরব চেষ্টায় ছিল। ধারাবাহিকতা কোনদিনই আমাদের প্রিয় অভ্যাস না । হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে চিত্ত ঝলমলিয়ে ওঠাটাই কাম্য। চিরদিন জনমানস তুবড়ির রোশনাইয়ে মেতেছে, কখনো দেখতে চায়নি সব চোখের অন্তরালে সলতে পাকাবার কাজটুকু। কাজেই নারীবাদকে এক নতুন হাউইয়ের মত ফেটে যেতে যখন আমরা দেখেছি নব্বই পরবর্তী আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ কল্পনার আকাশে, তার বহু আগে থেকেই জমি প্রস্তুতির ইতিহাসটুকু আমরা ভুলে যেতেই পারি।
এই ঘরানায় যে ভঙ্গিটি জোর পায় তা দোষারোপ, প্রতিবাদ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যায় অত্যাচার লাঞ্ছনার জন্য ব্যক্তিপুরুষকে দায়ী করা, চীৎকৃত বিরুদ্ধাচরণ।  এই দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে বিষয়ী করতে পারে না, সচরাচর বিষয় হিসেবেই মেয়েরা দৃষ্ট হয় : পুরুষের পণ্যায়ন, ভোগ, ধর্ষণ, অত্যাচারের বিষয়। অর্থাৎ আবার ঘটনার রাশ চলে যায় পুরুষের হাতে, নিয়ন্ত্রণের রশিটি থাকে পুরুষের জিম্মায়।
এখানে আমরা আলোচনা করছি না, বাস্তবে কী পরিস্থিতিতে মেয়েরা নিজেকে দেখতে পান , কত শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের হাতে জীবনের রাশ থাকে , কত শতাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের হাতে, সেই সংখ্যাতত্বটি। আমরা আলোচনা করছি বাংলা কবিতায় মেয়েরা নিজেদের কী ভাষাশব্দে প্রতিষ্ঠা দেন সেই “রূপায়ণ” বা “প্রতিনিধিত্ব” নিয়ে। লক্ষ্য করব, এখানে বাংলা কবিতার একটি বেগবতী ধারা বহু আলোচিত হয়েই সজোরে নিজেদের অস্তিত্ব বিস্তার করেছে। কৃষ্ণা বসু বা মল্লিকা সেনগুপ্ত সত্তরের শেষ থেকে আশির দশকের শুরুতেই এই কাজটি শুরু করে দিয়েছিলেন এবং এখনো নিষ্ঠাভরে করে চলেছেন ।  ব্যঙ্গ , তির্যকতা, শ্লেষ, বঙ্কিমতা সবকিছুর আধারে প্রতিবাদ ক্রমাগতই নারীর বিষয় মডেলকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে চলেছে।
“নারীর জরায়ুজমি লাঙল চাইছে
যদি অসমর্থ হই, ভাড়া করে, নিয়োজিত করে
অথবা যে কোনভাবে বীজ এনে দেব “
ছদ্ম পুরুষকথনে সীতায়ন-এর লেখক অন্যতম বলিষ্ঠ কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের এই “পান্ডুর পুত্রাকাংক্ষা”  তীব্র শ্লেষের সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের বয়ানটিকে স্পষ্ট করেছিল, একইসঙ্গে আমাদের সামনে এসেছিল সমাজতত্বের অধ্যাপিকা মল্লিকার সুসংহত পাঠ অভ্যাসের প্রমাণও। তাঁর মার্ক্স সাহেবকে উদ্দিষ্ট কবিতা,  পামেলা বর্ডেসের সঙ্গে পুরাণের বেশ্যাদের একীকৃত করা কবিতাটি, বা “ছেলেকে হিস্ট্রি পড়াতে গিয়ে “ কবিতায় “তাহলে হিজড়ে ছিল ইতিহাসবিদ ? “ অসামান্য কাজ।
কিন্তু এই কাজটি করতে গিয়ে একটা জিনিশ আমাদের অজান্তে ঘটে যায়। মেয়েকেন্দ্রিক যৌনতা নির্মাণের থেকে সরে গিয়ে আমরা মেয়েদের আবার দেখি পুরুষের অধিকৃত ও বিষয়ীভূত হতে। নিন্দাচ্ছলেও বার বার দাগা বুলনো হয় পুরুষের প্রাধান্যের উপরেই । আমরা পুনর্বার বঞ্চিত খন্ডিত ও বিষয়ীভূত বোধ করি।  মেয়েরা হারায় নিজের পায়ের তলের মাটি।  হয়ত তা আবার তাকে অধিকার করবার ছলেই…
“মশারি গুঁজে দিয়ে যেই সে শোয় তার
স্বামীর কালো হাত হাতড়ে খুঁজে নিল
দেহের সাপব্যাং, লাগছে ছাড় দেখি
ক্রোধে সে কালো হাত মুচড়ে দিল বুক
বলল, শোন শ্বেতা, ঢলানি করবে না…”(স্বামীর কালো হাত)
এই চিত্র বাস্তবোচিত, বলা যেতে পারে অতি রূঢ় বাস্তব,  ফিল গুড নয়। । তবু, আক্ষেপ একটাই, কবিতাটি স্বপ্ন কল্পনার কাছে নিজেকে সঁপে দেয় না , একইসঙ্গে, এ কবিতা নারীকে ক্ষমতায়িতও দেখতে চায়না। লিঙ্গরাজনীতির ভেতরেই প্রোথিত রাখে, কোন উত্তরণ দেয় না।
অথচ অন্যত্র উত্তরণের কবিতা লিখেছেন মল্লিকা সেনগুপ্ত। তাকে আমরা তথাকথিত প্রতিবাদের কবিতা বলব না। অথচ সেটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য কারণ তার ভেতর দিয়ে নারী ক্ষমতায়িত হয়, তার ভেতর দিয়েই নারীত্বের উদ্ভাসনের কথাটি অকপটে বলা যায়। অনুচ্চার, অনুচ্চকিত এক পলিটিক্স, যা খুবই ব্যক্তিগত, থাকেই এই সব কবিতা। বিষয়টি সন্তানের জন্মদান।নারীর মাতৃত্ব সক্ষমতার , এবং মাতৃত্ব অনুভূতির প্রসঙ্গটি, যদি ধরি, তাহলে মল্লিকা সেনগুপ্তের অসামান্য কিছু কবিতা রয়েছে কাচিজাতক সিরিজে, সন্তান জন্ম বিষয়ে এত অথেনটিক, সহজ এত গভীর অনুভূতির কবিতা বাংলা সাহিত্যে আগে আসেনি।

কেবল বাংলা ভাষার ভেতরেই কেন বা আটকে রাখবে নিজেদের। একটা ভাষা, একটা ভূখন্ডের ব্যাপার তো এ নয়। তা ছাড়া , একটু আগেই বলছিলাম রাজণীতির সর্বত্রগামিতার কথা। এই জীবনে পড়েছি হয়ত বা খুবই কম, কিন্তু তবু, কিছু কিছু পড়া মনের নানার স্তরে গিয়ে বাসা করেছে। তাদের অভিঘাত বড় তীব্র। প্রতিবাদ ও রাগের কিছু আরোপ ছিল সেইসব লেখায়, যেগুলো কিন্তু নিছক পোস্টারের বাইরে গিয়ে লেখাগুলিকে আরো অনেক বেশি অর্থপূর্ন করেছে। পাঠককে সহজে কবিতার সঙ্গে যেমন সংযুক্ত হতে সক্ষম করেছে, অলংকারের থেকেও বেশি করেই রাগ বা প্রতিবাদের অন্তঃসার কবিতাগুলোকে দহনময় ও অনস্বীকার্য করে তুলেছে।
বোর্খার ভেতরে নির্বাসিত পাকিস্তানি কবি ইশরাত আফরিনের “অসম্পূর্ণ পুরুষের সঙ্গে কথোপকথন” যেমন। প্রতবাদের ঘরানায় লিখিছ, তহছ কবিতাটি স্পর্শ করে এক প্রাগৈতিহাসিক আন্তঃসম্পর্ককে। একজন পুরুষের বড় হয়ে ওঠা ও একজন নারীর বড় হয়ে ওঠার মধ্যেকার বৈষম্যের  যুগবাহিত ট্র্যাডিশনের দিকে নির্দেশ করে কত সহজেঃ
শেষ পরীক্ষায় প্রমাণিত হলো
তোমার অঢেল গুণপনা
তোমার মর্যাদা
তোমার মহান ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও তুমি একটি খোকামাত্র যার কাছে
ক্রন্দনরত মেয়েরা শুধু
আহত ডানাছেঁড়া প্রজাপতির মত
তোমার সঙ্গে আমি কীভাবে ভাগ করে নেব আমার জ্ঞান, আমার বোধ?
তোমাকে আমি কী করে সঙ্গে নেব আমার জীবনের মানে খোঁজায়?
তুমি তো এখনও আমার চেয়ে বয়সে ছোট
তুমি তো চিরদিন আমার চেয়ে বয়সে ছোটই থেকে যাবে
কেননা আমি যে আমার পূর্বপুরুষদেরও মা।
মার্কিন কবি আদ্রিয়েন রীশ ইশরার আফরিনের থেকে ভৌগোলিক ও জাতিগতভাবে অনেক দূরের। তিনি শ্বেতাঙ্গিনী, তিনি প্রথম দুনিয়ার বাসিন্দা। অথচ তাঁর কবিতায় পাব নিরাপত্তাহীনতার ছবি, ঠিক যেভাবে পাই এশিয়ার মেয়েদের লেখায়। হয়ত স্বরটি আলাদা, ঈষত ব্যঙ্গবঙ্কিম, ঈষত বিচ্ছিন্নতায় মাখানো।
আমি ব্যাঙের ছাতা তুলতে গেছিলাম ভয়াবহতার ধার থেকে
কিন্তু না, তোমরা ঠকে যেও না
এটা কোন রুশ কবিতা নয়, এটা এখানেই, এখানেই, অন্য কোন জায়গা নাওয়
আমাদের দেশ , যা ক্রমশই নিজের সত্য আর ভয়াবহতার নিকটবর্তী হয়ে উঠছে
আর এর নিজস্ব পদ্ধতির – লোকজনকে হাপিস করে দেবার।
অথবা,
এই শহরের যেখানেই যাও, দেখবে দপদপ করছে স্ক্রিন
পর্নোগ্রাফিতে, সায়েন্সফিকশন থেকে উঠে আসা ভ্যাম্পায়ারে
ভাড়া করে অত্যাচারিতেরা চাবুকের তলায় দুমড়ে যাচ্ছে
তবু আমাকে হাঁটতেই হয়, আর হাঁটতে হাঁটতেই
আমরা বৃষ্টিভেজা জঞ্জাল দেখি, ট্যাবলয়েডের নিষ্ঠুরতা দেখি
আমাদের নিজেদেরই পাড়ায়
আমাদের আঁকড়ে ধরতে হয় আমাদেরই জীওন
যা অবিচ্ছেদ্য এই পচে ওঠা স্বপ্ন, ওই ধাতব উচ্ছ্বাস, ওই অবমাননাগুলির থেকে
যেখানে লাল ফুল বিপজ্জনকভাবে ঝলসে ওঠে
ছ তলা বাড়ির বারান্দায়।
য়াদ্রিয়েনের কবিতা পড়লে বুঝি, চাপা ধিকিধিকি আগুনের মতই, রোজকার জীবনেও, যুদ্ধ আর দাঙ্গা আর ধর্ষণের সরাসরি আঘাত ছাড়াও আরো কতরকমভাবে আমরা জ্বলছি। শ্লেষভরে একজন ধর্ষককে বলেছিলেন আদ্রিয়েন, সেই পুরুষ যার প্রাকৃতিক সম্পদ একটু অতিরিক্ত হয়ে গেছে।
এর পাশাপাশি অথচ, গুজরাতি কবির কবিতা, কন্যাভ্রূণহত্যা সম্পর্কে, কত না বেশি করেই তা আক্রান্ত করে আমাদেরঃ রীণা মেহেতার পাথর কবিতাটি যদি দেখি।
যখন আমার জন্ম হল, ঠাম্মা নাকি বলেছিলঃ
হায় রে, ঘরে একটা পাথর পয়দা হল।
মা আমাকে অনেকবার এ কথা বলেছে।
আমি মায়ের তিন নম্বর মেয়ে
পুত্রসন্তান একটাই।
ছেলে চোখের মণি, তাই দুটো না হলে
চলে না বুঝি?
চাটনির পাতা পিষি
মায়ের থেকে জোর করে টেনে নিয়ে কালো শিল নোড়া
আমার ছোট হাতে ঠিক করে ধরতে পারিনা পাথরটা
ধনেপাতার কোমল পাতা ডাঁটি পিষি কোনমতে।
আমিও পাথর? ধনেপাতা ধোওয়া জলের নিচে মাটি কিচকিচ করে
ঠাম্মার ভালবাসা
ওঁর তৈরি সিঙ্গাড়ার শক্ত খোলসের নিচের মিহিন পুরের মত
ঠান্ডা পাথরের ঠাকুরের ওপর ঢেকে দেওয়া
নরম পারিজাত ফুলের মত
শীতের রাতে আংটায় গরম কয়লার আগুনের সামনে
গল্প শুনতে শুনতে
ঠাম্মার কোমরে গরম সেঁক দিতাম
আর কয়লার ওপর আগুনের ফুলকি দেখতাম।
ওরে কী সেয়ানা রে তুই? পাথর হয়ে জন্মালি কেন?
দড়িলাফের এক এক লাফে
আমিও বড় হতে লাগলাম
ঠাম্মাও ছোট্ট আর কোমরভাঙা, বাঁকাচোরা।
“ছুটকি, তোকে শাড়িতে খুব মানায় রে। “
আমি নিচু হয়ে দেখি
বিছানায় শোয়া হাড়গোড়ের বাসার মত শরীরটাকে
ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার শাড়ির ফুরফুরে আঁচল।
মা বলত, তুই ঠাম্মার মত দেখতে।
ঠাম্মার কপালের উল্কিতে হাত বোলাই
সরু কবজি থেকে খসে পড়ে চুড়ি
তুবড়ে যাওয়া ফর্সা ছাতি দেখা যায়, স্পঞ্জ করতে করতে
“আমার একটা মেয়ে হয়েছিল, তোর বাবা জন্মানোর আগে
একবছর মাত্র বেঁচেছিল।“
সাদা চুলে চিরুণি বুলিয়ে বের করে আনা উকুন
না মেরেই আমি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিই
আমার আগের বোনটি ঠিক একুশদিন বেঁচেছিল
মাটিতে গর্ত খুঁড়ে নুন দিয়ে ওকে পুঁতে এসেছিল ওরা
মা বলত, ও কখনো জোরে কাঁদেনি
কম জোর হয়েই জন্মেছিল, আর…।
নুন দিয়ে কেন? আমি বার বার জিগ্যেস করতাম।
ঠাম্মার মলভর্তি প্যান নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামি
মায়ের কথাগুলো হেসে হেসে ঝাঁপিয়ে পড়ে –
পাথর পাথর বলতে তো, সেই দ্যাখো কেমন কাজে এল।
কমোডে প্যানটা উলটে দিয়ে আমাকে শ্বাস চেপে রাখতে হয়না
ফ্লাশের শব্দ হয় ঘড় ঘড় হুশ।
এখন তো পাথরগুলো আর জন্মায়ও না
বাইরে আসার আগেই ফ্ল্যাশ করে দেওয়া হয়
ঘড় ঘড় হুশ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।