“পাঠগ্রহণের দিনগুলি” সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অমিতাভ দাস (পর্ব – ২)

পাঠ গ্রহণের দিনগুলি

পর্ব ২

স্মৃতি কখন যে জেগে ওঠে বোঝা কঠিন ।ধুলো-ঝুল মুছে কথা বলতে বসে টের পাওয়া যায় না ।আজ যেমন সে কেবল বকে যাবে ,আর আমাকে তা শুনে যেতে হবে ।আমি জানি আমার এই ব্যক্তিগত কথাগুলি জেনে কারো কোনো উপকার সাধিত হবার নয় ।তবু কিছু কিছু বন্ধু আছে যাঁরা ,এসব গল্প শুনতে চায় ।এ লেখা তাদেরকে ভালোবেসে ।যাঁদের স্নেহ ,প্রশ্রয় আর ভালোবাসা আমার পাথেয় ।
সে সময়ে মানে কলেজ জীবনে একটা বই সুধেন্দু মল্লিকের ‘সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ’ আমার মনোজগতে প্রচন্ড আলোড়ন তুলেছিল । এক ভক্ত কবির আত্ম নিবেদনের কবিতা ।
‘তোকে ভালোবাসি বলে কারো কাছে নত হতে পারবো না–‘
আজ ও মনে আছে ।বিজয়(সিংহ) স্যার দিয়েছিলেন পড়তে ।আমি সে বইটা স্যারকে আজো ফেরৎ দিইনি । স্যার আবার দশটাকা দিয়ে পুরনো বইটা কিনেছিলেন কলকাতার ফুটপাথ থেকে ।আজো পরম যত্নে সেটা আমার কাছে রক্ষিত । পড়েছিলাম” অন্য যুগের সখা “,–বীতশোক ভট্টাচার্যের লেখা ।বইমেলায় স্যারের দেওয়া অমূল্য উপহার । ছন্দ আর মেধাবী কবিতার সে জগত ।অক্ষরবৃত্তের মায়া । যাকে চট করে ভোলা যাবে না ।লেগে আছে মনে সে অক্ষরশিল্প ।
প্রাণকৃষ্ণ ব্যানার্জি । আমাদের কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্যার ।আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র না হলেও ছাত্র ।একলব্যের মত ।তিনি আমাকে ছাত্র বলতেন আর অসম্ভর স্নেহ করতেন ।এর একটাই কারণ আমার কবিতা লেখা আর জ্ঞানতৃষ্ণা । উনি বলতেন ,”তোর সঙ্গে আলোচনা করে সারা সপ্তাহের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় ।” সপ্তাহে একবার সেসময় আমি সন্ধেবেলা তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতাম ।সেটা সম্ভবত শনিবার ছিল । খুব যত্ন করে চা করে খাওয়াতেন তিনি ।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়েছিলাম আমি স্যারের থেকে ।ছিলেন জীবনানন্দের ভক্ত । তাঁর পাল্লায় পরে আমাকে পড়তে হয়েছিল জীবনানন্দ বিষয়ক বেশ কিছু বই । ” একটি নক্ষত্র আসে “— অম্বুজ বসু । ” আমার জীবনানন্দ আবিস্কার ও অন্যান্য”–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়  ,” জীবনানন্দের কবিতায় পাশ্চাত্য প্রভাব”—কৃষ্ণগোপাল রায়  ,” আলেখ্য জীবনানন্দ ” —ভূমেন্দ্র গুহের লেখা ,আরো কিছু বই ।এছাড়াও “কবি মানসী “,জগদীশ ভট্টাচার্যের । দুই খন্ডে লেখা ।ভারবির বই ।অসম্ভব ভালো লেগেছিল সেই বই ।আমি তখন থেকেই নোট রাখতাম এইসব পাঠের গুরুত্বপূর্ণ অংশের ।
কবি বিনয় মজুমদারের  সঙ্গে আলাপ ‘৯৬ সালেই ।আমাদের কাগজের দ্বিতীয় সংখ্যাতেই লেখা দিয়েছিলেন । তখন তাঁর বাড়িতে মাঝে মাঝেই চলে যেতাম । অনেক কথা হ’ত । সে’সব কিছু কিছু ডায়েরিতে লেখা আছে । সেসময় তাঁর ‘ফিরে এসো চাকা’ আর’অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ পড়ে ফেলেছিলাম ।

–একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে/
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে/
পুনরায় ডুবে গেলো— এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে/
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ব রক্তিম হ’লো ফল.”..এই লেখাটা তিনি বারবার নিজে আবৃত্তি করে শোনাতেন ।  যদিও সে সময় বোধ এত কম ছিল যে ,  সেভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি । অবিশ্যি আজো কী  পেরেছি সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে  !
কবি পংকজ মন্ডলের ‘অসংপৃক্ত অনুভব’ মারাত্মক মেধাবী রচনা । আমাদের সামনে একটা মাইলস্টোন যেন ।এ মুগ্ধতার কোনো ব্যাখ্যা হয় না । এর পাশেই পড়ে চলেছি অর্ধেন্দু চক্রবর্তীর কবিতাগুচ্ছ । গল্পের মত করে সহজ সরল ভাষায় কবিতা লিখতেন তিনি ।  নিজ হাতে বানীপুর মেলায় কবি সম্মেলনে এসে উপহার দিলেন ‘স্বনির্বাচিত কবিতা ‘ ।
কবিবন্ধু রাজীব মিত্র প্রকাশ করেছে তখন গৌতম বসুর ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ ।কিনে পড়ে ফেললাম তাও । পরিচয় হয়েছে কবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্রের সঙ্গে । তাঁর বাড়ি গিয়েছি । অনুবর্তনের রবিবারের আড্ডায় কবিতা পড়েছি ।অনুবর্তনে লিখেছি ।অগাধ পান্ডিত্য তাঁর । “মন্থরতা বিষয়ক “–বইটি আজো আমায় এক ভালোলাগার অনুভূতি দেয় ।বারবার পড়তে ইচ্ছে করে ।ছন্দ ,লোকাচার ,মিথ ,প্রকৃতি আর প্রেম মিশে আছে তাতে ।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।