“পাঠগ্রহণের দিনগুলি” সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অমিতাভ দাস (পর্ব – ৬)

পাঠ গ্রহণের দিনগুলি 

পর্ব – ৬

“রাতের জার্নাল ” প্রকাশের পর সেই বইটি দিতে গিয়েছিলাম আনন্দদার বাড়ি প্রসূনের সঙ্গে । সেই আলাপের সূত্রপাত ।আমার এক প্রিয়জন আর অত্যন্ত কাছের মানুষ তিনি । এই বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী চারু খান । আনন্দদা বইটির প্রচ্ছদ ও কবিতার প্রশংসা করে অনেক কথা বলেছিলেন ফোনে । যা আজ কিছুই মনে নেই । তবে তাঁর কথায় খুব-ই উৎসাহ পেয়েছিলাম । পরে যখন রাতের জার্নাল ” বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ  পুরস্কার”  পায় আমার কাব্য-কবিতার প্রতি তাঁর আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পায় । বহুজনের কাছে আমার প্রশংসা করতেন তিনি ।
আনন্দদা ওরফে অরবিন্দ দাস । অতি সজ্জন মানুষ । পড়তে ভালোবাসেন । তাঁর বাড়িতে প্রথম দিন আমি বিশাল লাইব্রেরি আর গ্রন্থসম্ভার দেখে অবাক হয়েছিলাম ।এত বই ! রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় বিষয় ।
একদিন বললেন ,তুমি শরদিন্দু পড়েছো ?পড়িনি শুনে শরদিন্দু অমনিবাস তৃতীয় খন্ডটি পড়তে দিলেন ।বললেন ,  তুমি কবিমানুষ , তুঙ্গভদ্রার তীরে পড়ো ,ভালো লাগবে । সেই শরদিন্দু-পাঠ শুরু । খুব মন দিয়ে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাস গৌড়মল্লার ,কুমারসম্ভবের কবি সহ প্রায় সব গল্পই পড়েছি । একটা একটা করে শরদিন্দু অমনিবাসের পুরো সেটটাই কিনে ফেলেছি । চুয়াচন্দন ,বিষকন্যা , অমিতাভ মারাত্মক সব গল্প ।  শিবাজীকে নিয়ে লেখা গল্পগুলো অনন্য সাধারণ । তাঁর কিশোর সাহিত্য নিয়ে আমার একটা প্রবন্ধ পুরুলিয়া থেকে প্রকাশিত ‘ জাগরণ ‘ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল । সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করেছি । রিমঝিম– তাঁর চমৎকার একটি প্রেমের উপন্যাস । আর ভূতের গল্পগুলো তো বারবার পড়তেই হয় । ব্যোমকেশ সবার মতো আমিও পড়েছি । তাঁর ‘ মালকোষ ‘ দুর্দান্ত একটা ভূতের গল্প । তুঙ্গভদ্রার তীরে পড়ে এত আচ্ছন্ন ছিলাম , যে তার ঘোর মাথায় ছিল বহুদিন । একটা কবিতাও লিখেছিলাম । যেটা ‘সেতার ভিজছে জলে’ -তে আছে ।
সম্প্রতি অরবিন্দ দাসের বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে । পাঠক ধীরে ধীরে লেখক হয়ে উঠলেন । ‘রবীন্দ্রনাথ:বিনি সুতোর মালা’ আর’ জগদীশ চন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ: সখ্যে ও সামীপ্যে ।’ দুটো বই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলেই মনে করি। কিছুদিন আগে তাঁর ‘ গাজিপুরে রবীন্দ্রনাথ পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল । তথ্য সমৃদ্ধ লেখা । তিনি অবগুন্ঠনের নিয়মিত লেখক ।তাঁর প্রথম লেখা ২০০৩ সালের অবগুণ্ঠনে মে সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় ললিতকলা ও সংগীতের স্থান ।’ এই লেখাটিও আমার মনোজগতে ভাবনা চিন্তাকে আন্দোলিত করেছিল ।
সম্ভোবত ৯৮ তে সৌরভ চট্টোপাধ্যায় ” কবিজন্ম ” কাগজটি সম্পাদনা করতে শুরু করে । সেখানে বড়ো বড়ো নামজাদা কবিরা লিখতেন । যদিও প্রথম সংখ্যায় সম্পাদক হিসেবে আমার নামও ছিল । প্রথম সংখ্যাটি ছিল হাতে লেখা কবিতা দিয়ে । সব কবির নিজের হাতে লেখা– তারপর জেরক্স করে ফোল্ডার পত্রিকা ।   যে সংখ্যাটা থেকে যাবার মত কাজ , সেটা ‘অণুকবিতা সংখ্যা ।’ মনে আছে সুজিত সরকার আর মঞ্জুষ দাশগুপ্তের প্রবন্ধ দুটির কথা । মঞ্জুষ দাশগুপ্তের  এক পংক্তির একটি কবিতা মনে পড়ছে  ‘হলুদ চিঠির মতো উড়ে যায় সমস্ত প্রেমিকা ।’ অণুকবিতার বিস্তারিত ইতিহাস পাওয়া যাবে এখানে ।
সৌরভের কিছু আগে ,সম্ভোবত ‘৯৮তে সুব্রত সিনহা একটা অণুকবিতা সংখ্যা করেছিল । পত্রিকার নাম ছিল , ‘অন্বয় ‘ । সংখ্যাটি  দীর্ঘদিন যত্নে ছিল । ইদানীং খুঁজে পাচ্ছি না । বারবার বাড়ি বদলের কারণে কত যে পত্রিকা হারিয়ে ফেলেছি । সেও দুর্দান্ত কাজ করেছিল । মনে পড়ছে–
দেওয়াল তুললেই ঘর
ভেঙে ফেললেই পৃথিবী ।–সুজিত সরকার ।
‘প্রণাম ঝুঁকে আছে প্রণামের দীর্ঘ ছায়ায়’–সৌরভ চট্টোপাধ্যায় ।
‘পা রেখেছেন পরম
আমার
ঘরে তাঁর ই খড়ম-চিহ্ন আঁকা ।
দ্বিপ্রহরে সদ্য
স্নান সমাপন ।
মেঝেয় আসন…
প্রস্ফুটিত পদ্যে
ভিতর জুড়ে প্রণাম আছে রাখা ।’
আমার ভীষণ প্রিয় একজন কবি । জানিনা কবে কোথায় তাঁর কবিতা পড়ে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে ,অনেক খুঁজে-টুজে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম । তাঁকে একবার দেখবো বলে , প্রণাম করবো বলে ।তিনি কবি বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় ।
প্রথমে ‘কহে বিশ্বমুখ’ পড়ে দারুণ মোহিত হয়েছিলাম । আবহমান বাঙালির যাপনের কথা লিখেছেন তিনি ।  ‘বাহিরে বেলা ,ভিতরে ভরা সাঁঝে/দেহ ও মনে বিবাদ লেগে আছে ।’ রহস্যময় সৌন্দর্যের ছবি আঁকেন তিনি । যা পড়ে মধ্যযুগীয় বঙ্গভূমি ও বাঙালিকে চেনা যায় নতুন রূপে । অন্তরে অনুভব করি আমাদের দেশজ সনাতন রীতি-নীতি ও সংস্কার ।
এরপর একে একে পড়ি–পা রেখেছেন পরম ,ঢেঁকিঘর ,ব্রহ্মান্ড ডাকঘর জেলা বীরভূম ,পীরিতি মাধুর্য গাথা । সম্প্রতি পড়লাম ‘আর্যার বঙ্গরস ।’
ছন্দের অতুল ঐশ্বর্য তাঁর সম্পদ । তৎসম শব্দ ,  সমাসবদ্ধ শব্দ আর শব্দজোট তাঁর কবিতার এক বিশেষ দিক । সঙ্গে মিশে আছে অপূর্ব আধ্যাত্ম চেতনা ।
বিশ্বদেব দার প্রথম ইন্টারভিউ আমরা নিয়েছিলাম । সেজন্য আজো গর্ব হয় ।অবগুণ্ঠনের নভেম্বর ২০০৮ সংখ্যায়  যাঁরা সাক্ষাৎকারটি পড়েছেন তাঁরা জানেন যে ,সাক্ষাত্কারটি বাংলা সাহিত্যের এক সম্পদ । কেবল কাব্য বা আপন জীবন কথাই নয় ,আধ্যাত্মিক দর্শনকে অত্যন্ত সরল ভাষায় বিশ্লেষণ করেছেন তিনি ।
অবগুণ্ঠন সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর স্নেহ ও কবিতা পেয়ে । আমার ‘রাধিকা অথবা কুসুম’ বিশ্বদেবদার ভালো লেগেছিল । সেই অনুভূতি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন ।সামান্য অংশ কোট করছি–
‘তোমার সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘রাধিকা অথবা কুসুম’ পড়ে মুগ্ধ হলাম ।বইটি রাধাভাবে আবিষ্ট ,যা সঞ্চারিত হবে পাঠকের মনে । বিরহের ঐশ্বর্য তোমার সর্ব কাব্য অবয়বকে শুদ্ধ ,সুন্দর ,সঞ্জীবিত করেছে । পুরনো ,প্রায় অবলুপ্ত শব্দের সন্ধানে তোমার অবগাহন তোমার ভাষাকে প্রাচীন ভাবানুষঙ্গের যোগ্য করে তুলেছে ।'(২৯|১০|২০০৮)
তাঁর কাছে অনেক শিখেছি; পেয়েছি তাঁর অন্তরের অমৃতের স্বাদ । একদিন ফোনে বললেন , ” এক ভক্ত আসবে আরেক ভক্তের কাছে , এ তো আমার পরম পাওয়া । ” তিনি নিজেকে এবং আমাকেও পরমের ভক্ত বলাটাই পছন্দ করতেন । কত যে বিকেল , সন্ধ্যা তাঁর স্নেহ- সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছি । ছিল সে’সব দিন । তাঁর বাড়ি যাওয়ার  রাস্তাটির নাম ছিল তারাশঙ্কর সরণি । এই নামেও একটি কবিতা আছে আমার । যা পরে অহর্নিশ পত্রিকার একটি সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল । তিনি পাঠ করে বড় খুশি হয়েছিলেন ।  বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবি বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় । তাঁর আরো একটি কবিতা ,মগ্ন পাঠকের জন্য দিলাম–

‘দুপুর গড়ায় ।
গুটি ধরেছে আমগাছে ।
ঘরের দাওয়ায়
দাশরথি রায়
পাঁচালি ছড়ায় বাংলাতে ।’

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।