ঋষি অরবিন্দের কথায়- ‘ সমগ্র ভারতের হৃদয়ভূমি বঙ্গদেশ, বাংলার হৃদয়স্পন্দন ধ্বনিত হয় হুগলী জেলায়।’ এই হুগলি জেলার, শ্রীরামপুর মহকুমার, জাঙ্গিপাড়া থানার একটি অতি প্রসিদ্ধ গ্রামের নাম হল ‘আঁটপুর’। আগে এই গ্রামে আসতে হলে ‘তড়া’ গ্রাম পেরিয়ে আসতে হোতো। সেজন্য এই গ্রামকে বলা হোতো- ‘তড়া আঁটপুর।’ আরও আগে নাম ছিল ‘বিশাখালা’ বা ‘বিষখালি।’ বৈষ্ণবগ্রন্থ ‘ভক্তি রত্নাকর’এ তড়া-আঁটপুর এবং ‘বৈষ্ণবাচারদর্পণ’এ বিশাখালা নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
লোককথা অনুসারে এই বিশাখালাতে মুসলমান আমলে আঁটুর খাঁ ও আনুর খাঁ নামে দুজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। ক্রমে ক্রমে আঁটূর খাঁ’র জমিদারি আঁটপুর গ্রাম নামে এবং আনুর খাঁ’র জমিদারি ‘আনারবাটি’ গ্রাম নামে পরিচিত হোলো।
হাওড়া-হরিপাল-তারকেশ্বর-আরামবাগ-গোঘাট রেলপথে হরিপাল স্টেশনে নেমে বাসযোগে, ১৩ কিমি দূরের এই আঁটপুরে আসা যায়। আগে এই আঁটপুরে হাওড়া ময়দান-চাঁপাডাঙ্গা মার্টিন রেলের স্টেশন ছিলো। এই গ্রামের মিত্র বংশ ও ঘোষ বংশ খুব প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত। এঁদের স্থাপিত নানা টেরাকোটা শোভিত মন্দির এই গ্রামে আছে। আঁটপুরের, হাতে চালানো তাঁতের ধুতি, শাড়ি বিখ্যাত ছিলো। আঁটপুর কাঠ-খোদাই শিল্পের জন্যও বিখ্যাত ছিলো। মিত্র বংশের প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো কাঁঠাল কাঠের দুর্গামণ্ডপে এই তক্ষণশিল্পের অপূর্ব নিদর্শন আছে। মণ্ডপটির গঠন উল্টানো নৌকোর মতো।
আঁটপুর থেকে ৪ মাইল দূরে দামোদর নদের পূবতীরে রাজবলহাট গ্রামে অতি বিখ্যাত রাজবল্লভী দেবীর মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ভূরসুট পরগণার রাজা সদানন্দ মুখোপাধ্যায়। ১৭৯০ খ্রিসৃটাব্দ পর্যন্ত এই গ্রামে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘কমার্শিয়াল রেসিডেন্সী’ ছিলো। এই গ্রামেই স্থানীয় পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের স্মৃতিতে গড়ে উঠেছে ‘অমূল্যচরণ প্রত্নশালা।’ এই গ্রামেই আছে কবি হেমচন্দ্রের স্মৃতিতে – ‘হেমচন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার।’ রাজবলহাট গ্রামের পাশের গ্রাম গুলিটা বা গুলাটিয়াতে (১৮৩৮ – ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ) কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
আঁটপুরের দক্ষিণ-পশ্চিমে আনারবাটী গ্রামে আছে, দ্বাদশ শ্রীপাটের অন্যতম, শ্রীশ্রীপরমেশ্বরদাস ঠাকুরের শ্রীপাট। প্রভু নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবাদেবীর আদেশে, বর্ধনান জেলার কেতুগ্রাম থেকে এসে, পরমেশ্বরদাস এখানে নিত্যানন্দ প্রতিষ্ঠিত ও সেবিত শ্রীশ্রীরাধা-গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে পরমেশ্বর ঠাকুর এখানে নিত্যানন্দরূপী বলরাম বিগ্রহ স্থাপন করেন। বিগ্রহটি ষোড়শ শতকের। জাহ্নবাদেবীও পরে এই মন্দিরে এসেছিলেন। এখানে নিত্যানন্দ প্রদত্ত একটি খুন্তি রক্ষিত আছে।
আঁটপুরের কাছে যে তড়া গ্রাম সেখানে জন্মগ্রহণ করেন ‘ফার্স্ট বুক’ রচয়িতা প্যারীচরণ সরকার। তিনি ‘এডুকেশন গেজেট’ নামক একটি বিখ্যাত পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এই গ্রামেই জন্মেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পদ্যোগী স্যার বীরেন্দ্রনাথ সরকার। চলচিত্র শিল্পে তাঁর স্থাপিত ‘নিউ থিয়েটার্স লিমিটেড’ ভারতখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান।
আঁটপুরে, মাতুলালয়ে, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ই ডিসেম্বর, শুক্লা নবমী তিথিতে, বাবুরাম ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম মাতঙ্গিনীদেবী ও বাবার নাম তারাপদ ঘোষ। ইনিই পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সর্বজনপ্রিয় স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজ। তাঁর জন্মের আগেই, এই গ্রামের কালীপ্রসন্ন মিত্র (কালু) ও উমাচরণ মিত্রের (ভুলু) বাড়িতে, ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এসেছিলেন স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। মাতঙ্গিনী দেবী ছিলেন ঠাকুরের একান্ত ভক্ত ও প্রিয়পাত্রী। ঠাকুর বলতেন – ইনি দেবী, আমার কাজের জন্য আসিয়াছেন।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ই আগষ্ট ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের মহাসমাধি হয়। কাশীপুর উদ্যানবাটি ছেড়ে দিতে হয়। ফলে ঠাকুরের শিষ্যরা সব ছন্নছাড়া হয়ে পড়েন। তখন ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে মাতঙ্গিনীদেবী বড়ছেলে তুলসীরামকে পাঠিয়ে নরেন্দ্রনাথ প্রমুখকে আঁটপুরে আমন্ত্রণ জানান। পরেরদিনই নরেন্দ্রনাথ ও আরও আটজন তুলসীরামের সাথে ট্রেনে হরিপালে এসে, ঘোড়ার গাড়িতে আঁটপুর আসেন। ২৪ শে ডিসেম্বর সন্ধ্যেবেলা ধুনি জ্বালিয়ে নরেন্দ্রনাথ, নিত্য নিরঞ্জন ঘোষ, বাবুরাম ঘোষ, তারকনাথ ঘোষাল, শশীভূষণ চক্রবর্তী, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী, কালীচন্দ্র চন্দ্র, গঙ্গাধর গঙ্গোপাধ্যায়, সারদাচরণ মিত্র- এই নয়জন বৈরাগ্য অবলম্বন করে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণের সংকল্প করেন। পরে ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের শুরুতেই নরেন্দ্রনাথ, রাখালচন্দ্র ঘোষ ও গোপালচন্দ্র ঘোষকে নিয়ে পুনরায় আঁটপুর আসেন। এই এগারোজনই, ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দেই, বরাহনগর মঠে বিরজা হোম অনুষ্ঠান করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এই বাড়িতেই ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ই ফেব্রুয়ারি মা সারদা বিবেকানন্দ, সারদানন্দ, যোগানন্দ, অদ্ভুতানন্দ, প্রেমানন্দ ( বাবুরাম মহারাজ ), শ্রীম, সান্যাল মহাশয় প্রভৃতি আরও অনেককে নিয়ে আসেন ও এক সপ্তাহ থাকেন। পরেরবার ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে, মা সারদা দুর্গাপূজা ও লক্ষ্মীপূজা দর্শনের জন্য এই বাড়িতে আসেন।
মাতঙ্গিনীদেবীর কন্যা, বাবুরাম মহারাজের দিদি, কৃষ্ণভাবিনীর সাথে ঠাকুরের রসদদার, স্বনামধন্য বলরাম বসুর বিয়ে হয়। ঠাকুর কৃষ্ণভাবিনী দেবী সম্পর্কে বলেছিলেন- শ্রীমতীর (রাধারাণী) অষ্টসখীর প্রধানা।
সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্কল্প স্মরণে রেখে বাবুরাম মহারাজের বসতবাটিতেই শ্রীরামকৃষ্ণ-প্রেমানন্দ আশ্রম স্থাপিত হয়। বেলুড় মঠ মিশনের অধ্যক্ষ শ্রীমদ্ বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজ এই আশ্রম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ রা ডিসেম্বর, পূজ্যপাদ স্বামী নির্বাণানন্দজী মহারাজ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কার্য সম্পন্ন করেন।
এই আশ্রমে মা সারদা ও বিবেকানন্দের ব্যবহৃত ঘরদুটি পরম শ্রদ্ধার সাথে সংরক্ষিত আছে। স্বামীজীর ব্যবহৃত ঘরে ঠাকুরের পাদুকা, মোজা ও দাঁতনকাঠি আজও শোকেসে সাজানো আছে।
আঁটপুর উচ্চ বিদ্যালয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ঠাকুরের মানসপুত্র ব্রহ্মানন্দ মহারাজ। বাবুরাম মহারাজের জ্ঞাতিভাই ডাক্তার বিপিনবিহারী ঘোষের উদ্যোগে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
ঠাকুর মা ও স্বামীজীর চরণধূলায় ধন্য, বাবুরাম মহারাজের স্মৃতিপূতঃ এই আঁটপুর গ্রামের খ্যাতি আজ ক্রমবর্ধমান।