সেই এক রাজা কুন্তীভোজ এবং তাঁর পালিতা কন্যার বহুশ্রুত গল্প, সবার জানা..
বার্তা পৌঁছল হঠাৎ ,দুর্বাসা আসছেন, রাজ আতিথ্যে
প্রাসাদে সাজ সাজ রব , অথচ রাজার মনে শঙ্কার মেঘ !
রাজা শক্তিমান,তবে সর্বশক্তিমান মহর্ষি,
মহর্ষি দুর্বাসা , যাঁর খ্যাতি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল ত্রিভুবনে৷
অবশ্য মন্দ লোকে বলে কুখ্যাতি ৷
তাঁর আঙুলের ডগায় অভিশাপ, দৃষ্টিতে রোষ, জিহ্বায় কঠোর শব্দের ঝঙ্কার !
এহেন ব্যাক্তির সেবার ভার নিলেন সদ্য তরুণী কুন্তী ৷
‘রাজকন্যা’ কুন্তী? নাকি ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’ এক সামান্যা নারী ? যার থাকা না থাকায় পিতৃকুলের বংশরক্ষা আটকায় না ৷
তদুপরি, কুন্তী পালিতা কন্যা বই তো নন!
দুইজন পিতা , তবু কই বটবৃক্ষের নিশ্চিন্ত স্নেহচ্ছায়া?
শূরকন্যা পৃথা ,জন্মলগ্নেই জন্মদাতার স্নেহবঞ্চিতা,
কোন এক পূর্বশর্ত অনুযায়ী ৷
প্রশ্ন স্বাভাবিক , পালক পিতা বলেই কী কুন্তীকে মহাক্রোধী দুর্বাশার দিকে ঠেলে দেওয়া?
কুন্তীভোজের মনের গোপন কথাটি কবি বলেননি ৷
আমরা তর্ক করতে পারি পিতা বনাম কন্যার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে ! যদিও —
মহাভারতকার এঁকেছেন এক স্নেহপরায়ণা কন্যার ছবি , যে পিতার দুঃশ্চিন্তা লাঘবে বধ্যপরিকর !
যথাসময়ে দুর্বাসার আগমন ৷
মহা তেজস্বী, উগ্রচন্ডা, প্রচন্ড এক ব্যাক্তিত্ত্ব ৷
মাসের পর মাস কাটে খামখেয়ালে ৷
মিষ্টভাষী , সর্বকর্মপটিয়সী কুন্তী তপস্বিনীর নিষ্ঠায় পূজা সামগ্রী ,পঞ্চব্যাঞ্জন সাজিয়ে ভোর থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত, রাত থেকে আবার ভোর সেবাকর্মে !
অবশেষে বৎসর অতিক্রান্ত হলে দুর্বাসা তৃপ্ত হন ৷
বলেন , ‘নারী, মন্ত্র দিব এমন , দেবতারে আহ্বানে পাবি চিরকাল ৷’ বরদান শেষে হৃষ্টচিত্তে দুর্বাসার প্রস্থান ৷
সদ্য যৌবনা কুন্তী কৌতুহলী হন ….আবার মনের লাগাম টানেন অজানা আশঙ্কায় ৷
শেষে ক্ষণিকের চপলতায় স্মরণ করেন সূর্যদেবকে…
আসেন স্বয়ম্প্রভ দেব , কুমারী নারীর আহ্বানে ৷
নারী সম্বিত ফিরে পান তৎক্ষনাৎ , এ কী উভয়সঙ্কট !
একদিকে পিতৃকুলের সম্মাণ অন্যদিকে দেবতাকে প্রত্যাখানের স্পর্ধা ! ভেসে যান কুন্তী….
অদম্য রতিসুখে যথাসময়ে আসে কানীনপুত্র কর্ণ ৷
জন্মমাত্রই নাড়ীছেঁড়া ধনের গোপন বিসর্জন মায়ের,
কবচ কুন্ডলেই পিতার দায়িত্বমুক্ত প্রেমিক সূর্য ! অবশ্য, নারী ভোগী দেবতাকে প্রেমিক বলা যায় কিনা সন্দেহ ৷
ঘটনা প্রবাহে শিশু কর্ণ বড় হয়ে ওঠে অধিরথ এবং রাধার আশ্রয়ে ৷ কুন্তী- সূর্যপুত্র, সূতপুত্র পরিচয়ে ৷
কুমারী কুন্তীর বুক ফাটে তবু মুখ ফোটেনা ৷
এরপর আসেন পান্ডু , স্বামী হয়ে ৷
পিতৃসুখ বিধাতা লেখেন নি, বোধকরি স্বামীসুখ- বঞ্চনার ইতিহাসও আঁতুড়েই লেখা হয়েছিল তাঁর ৷
সপত্নী মাদ্রী আর এক অক্ষম পুরুষের ভার !
কুন্তীর ডাকে পর পর আসেন ধর্ম, পবন,ইন্দ্রদেব
সন্তান না হলে পান্ডুর রাজ্যপাট যায় যে !
নিজের তিন সন্তানের পর মন্ত্রের ভাগ দেন মাদ্রীকেও ;
আসেন অশ্বিনীকুমারদ্বয় !
সম্ভোগ এবং পুত্রপ্রাপ্তি ৷ সহজেই লিখে ফেলা যায় ৷
বহুগামিনী কুন্তীর মনের খবর কেউ রাখেননি !
অবশ্য দেবতা ছুঁলে নাকি নারী এঁটো হয়না ! প্রসাদ হয়
তবুও কিছু প্রশ্ন থেকে যায় ….
কুন্তীর দুর্দশার দায় কার ?
দুই পিতার? মহর্ষি দুর্বাশার ? প্রথম পুরুষ সূর্যের?
নাকি কামার্ত পান্ডুর ? যাঁর পান্ডুরোগেই হঠাৎ মৃত্যু ?
নাকি ধর্মের, পবনের, ইন্দ্রের ? যাঁরা শুধু যন্ত্রের মতো গর্ভে বীজ বপন করেই খালাস ?
একাধিক পুরুষ কুন্তীর জীবন ভাঙাগড়ায় , সঙ্গতে আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়া বিধাতাপুরুষ !
বিধাতাপুরুষ , তুমি নারী হলেও কী এমনই হতো?
কুন্তীদের কী একফোঁটাও সুখ দিতে নেই ?
যুদ্ধক্ষেত্রে এক সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে আরএক সন্তান ভিক্ষা ! এ কেমন নির্মম বিনিময় , হে ঈশ্বর !
কুরুক্ষেত্রের শেষে তাই বুঝি অরণ্যেই আশ্রয় ৷
সকলের অগোচরে প্রাণ বিসর্জন ৷
হে মহাভারতকার , এ কী লিখে গেছেন ?
এতটুকুও শান্তি দিতে নেই শেষবেলাতেও !
ধিক্ আপনার কলমকে !
যে কলম মহাকাব্যের কুন্তী, গান্ধারী, দৌপদীকে আগুন ছাড়া কিছু দিতে জানেনা , তাঁকে সহস্রবার ধিক্ !