“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় অদিতি ঘোষদস্তিদার
by
·
Published June 21, 2020
· Updated June 21, 2020
হাসি
দরজার পাল্লাদুটো আধ ভেজানো । ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো । বাইরে দাঁড়িয়েই মুখটা ভেতরে একটু বাড়িয়ে অমলেন্দু ডাকলেন ঘরের বাসিন্দার নাম ধরে । সাড়া পেলেন না । জুতো পরে ঢুকবেন কিনা একটু ভাবলেন । তারপর কি ভেবে জুতোজোড়া বাইরে রেখে ভেতরে ঢুকতে লাগলেন এক পা এক পা করে । চোখে পড়লো না কাউকে । একটু জোরে আবার ডাকলেন ,
“ ছায়া ! ছায়া !”
জীবনে কি কোনদিন এর আগে এমন একটা ঘরে ঢুকেছেন অমলেন্দু ? গাড়িটাকেও বড় রাস্তার মোড়ে ছেড়ে আসতে হোল । এলাকার লোকজনের কাছে ছায়ার খোঁজ করতে একটু চমকেই গেলো তারা । দোষ নেই ওদের । এই বস্তিতে এমন ঝকঝকে চেহারার লোক তো বড় একটা আসে না !
সত্যি বলতে কি অমলেন্দুর মত বিখ্যাত ছবি আঁকিয়ে নেহাত দায়ে না পড়লে এই এঁদো গলিতে আসতেন না ।
আগে যদি জানা থাকত ছায়া এই রকম একটা ঘরে থাকে তাহলে না হয় একতলার একটা ঘরে ওকে রেখে দেওয়া যেত ! ইস, এই বুদ্ধিটা যে কেন মাথায় আগে আসেনি ! অবশ্য গত একটা বছরের বেশি সময় ধরে ছায়াকে তো দরকারও পড়েনি তাঁর । বেশির ভাগ সময়টাই ছিলেন বিদেশে একজিবিশনের কাজে । ফিরে এসেও তো মন বসাতে পারেন নি কতদিন ।
অবশ্য যা হয়েছে ভালই হয়েছে । পল্টু যা বললো , তাতে ছায়া থাকলে ঝামেলা কম বই বেশি হোত না ।
জায়গার অভাব নেই অমলেন্দুর বাড়িতে । তিনতলা ছাড়া গোটা বাড়িটা তো খালিই পড়ে থাকে বাবা চলে যাবার পর । মা চলে গেছেন আরো আগে । নিজে বিয়ে থা করেন নি । তবে ঘরবাড়ি দেখাশোনা , রান্নাবান্না এসব ব্যাপারে এখনও মাথা ঘামাতে হয় না । বাবার আমলের রতনদা আর মিনতিমাসিই সেসব সামলে নেয় ।
আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউই নেই , পিসিমণি ছাড়া । খারাপ লাগে না আসলে । পাতে ভালোমন্দ পড়ে । কিন্তু পিসিমণি বড্ড ঘ্যানঘ্যান করেন একলা থাকা নিয়ে । মাঝেমাঝে তাতে বড্ড বিরক্ত লাগে ।
তিনপুরুষের ব্যবসায় না বসে অমলেন্দু যখন শিল্পী হতে চাইলেন বাবা আপত্তি করেন নি । ছেলের দেশজোড়া খ্যাতি তিনি দেখেই গেছেন । তবে আক্ষেপ ছিল মনে । একমাত্র সন্তান সংসারী হলো না ।
বিয়ে মানেই অমলেন্দুর কাছে ঝুটঝামেলা । আজ বিয়ে, কাল ছেলেপুলে । দুধের বোতল , ডায়াপার । ধুত্তেরি ।
মেয়ে তো কম দেখলেন না জীবনে । সেদিক থেকে দেখতে গেলে একেবারে ব্রহ্মচারীটিও তিনি কিছু নন । নারীরা আসে জীবনে স্রোতের মত । এই মধ্য চল্লিশেও মেয়েরা পাগল তাঁর জন্যে । মন্দ লাগে না সেটা । তবে সব কিছুর মধ্যেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন । ফেঁসে যেতে রাজি নন একেবারেই ।
গোটা তিনতলাটা জুড়ে ষ্টুডিও । সেখানে পুরুষ একজনই । বাকি সবাই নারী !
ছোট বড় নানান ক্যানভাসে অপরূপ ভঙ্গিমায় তারা কখনো চারকোলে , কখনো তেলরঙে আবার কখনো বা শুধু পেনসিলের আঁচড়েই প্রাণ পেয়ে সারা ঘরে পসরা সাজিয়েছে । আর পাশে পাশে শোভা পাচ্ছে রাশি রাশি প্রাইজ আর ফ্রেমে বন্দী খবরের কাগজের কাটিং , সগর্বে তারা ঘোষণা করছে শিল্পীর জয়যাত্রা ।
জীবনে একটিমাত্রই চাহিদা অমলেন্দুর । মনের মত একটা সুন্দর সুঠাম নারী শরীর । জ্যান্ত মডেল । যে শুধু নীরস পোজই দেবে না , বুঝবে শিল্পী ঠিক কি চায় । তবেই তো শিল্পীর তুলির সুর আর মডেলের শরীরের ছন্দ ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলবে যুগলবন্দী । সার্থক হবে ছবি ।
মডেল নিয়ে তাই বড্ড খুঁতখুঁতানি । আর্ট কলেজের মডেলদের নিয়ে কাজ করা ছেড়েছেন বহুদিন । বড্ড একঘেয়ে । বেশির ভাগেরই বয়েস হয়ে গেছে । মেকআপে আর কত ঢাকা যায় !
কাজের খ্যাতি ছড়ালেও মনে বড় অদ্ভুত অতৃপ্তি অমলেন্দুর ! বেশিরভাগ সময়ই মনে হয় একজন মনের মত মডেলের অভাবে ভাবনার ঠিকঠাক প্রতিফলন যেন ক্যানভাসে পড়লোই না ।
খুঁজতে খুঁজতে বছর দুই আড়াই আগে হঠাৎ ক্ষ্যাপার কপালে জুটলো পরশপাথর!
ছায়া! ছায়াকে নিয়ে প্রথম ছবি আঁকার দিনটা এখনো মনে পড়ে। শিশুর মত উচ্ছ্বসিত তিনি। আবেগ যেন বাঁধ মানে না ! শিল্পীমনে এতদিন যে হাহাকার ছিল ছায়া যেন তা ভ’রে দেবার জন্যেই এলো ।
তাই ছায়াকে একটু বেশি রেট দিয়েই বাঁধলেন একটানা কাজের শর্তে।
একের পর এক স্কেচ। তারপর তারা ক্যানভাসে প্রাণ পাচ্ছে।
একটা সিরিজ আঁকার বায়না এলো। নামকরা ব্যবসায়ী মিস্টার মেহতার অর্ডার। লোভনীয় সব দিক থেকেই। মহাভারতের আটটি নারীচরিত্র। তবে পৌরাণিক হলেও ছবিতে যেন থাকে আধুনিকতার ছাপ। সানন্দে রাজি অমলেন্দু।
শুরুতেই পরপর সব ক’টির ই স্কেচ ছায়াকে নিয়ে করে ফেললেন । দুটো ছবি কমপ্লিট করে ডেলিভারিও হয়ে গেলো। শিল্পী আর তার সমঝদার দুজনেই মহা খুশি।
তিন নম্বর ছবি শুরু করার মুখেই হঠাৎ অমলেন্দুর ডাক পড়ে গেলো বিদেশে একজিবিশনের।
এ সুযোগ কি ছাড়া যায় !
নতুন ছবি আঁকা বন্ধ করে শুরু হল বিদেশ যাওয়ার তোড়জোড় ।মিঃ মেহতা সবটা জানলেন। রাজি হলেন অপেক্ষা করতে। । ছায়াকে ছুটি দেওয়া হলো হাতে কিছু পয়সাকড়ি দিয়ে। ঠিক হল দেশে ফিরেই শুরু হবে বাকি ছটা ছবির কাজ।
জোগাড়যন্ত্র , বিদেশসফর কিছুটা বেড়ানো সব মিলে কেটে গেলো প্রায় ছ ‘ মাস । দেশে ফিরতে না ফিরতেই একটা জোর ধাক্কা । খবর এলো প্রাণের বন্ধু রথীনের কঠিন অসুখ । লাগবে অনেক অনেক টাকা । জীবনে যে কয়েকটি লোক অমলেন্দুর খুব কাছের , রথীন তাদের একজন । তাই রথীনকে ভালো করে তোলা ছাড়া আর সবকিছুই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো তখন । পর পর অনেকগুলো একজিবিশন হলো পুরোনো ছবি দিয়েই । নতুন করে ছবি আঁকার মতো মানসিক অবস্থাই ছিল না তখন অমলেন্দুর । ঝড়ের মত কেটে গেলো আরো বেশ কয়েকমাস ।
এর মধ্যে বাকি ছ’টি ছবির জন্যে বেশ কয়েকবার তাগাদা এসেছে মিঃ মেহতার কাছ থেকে। প্রতিবারেই অমলেন্দু সময় চেয়ে নিয়েছেন।
চেষ্টা সার্থক হয়েছে। রথীন এখন আস্তে আস্তে সেরে উঠছে।
অমলেন্দুর তিনতলার ঘর আবার দেখতে পাচ্ছে হারানো মালিককে।
টাকাপয়সা গত একবছরের বেশি সময় ধরে জলের মত খরচ হয়েছে । এবার কাজে মন দিতেই হবে । সবার প্রথম শেষ করতে হবে পড়ে থাকা ছটি ছবি । মিঃ মেহতাকে আর অপেক্ষা করানো ঠিক নয় । স্কেচ করা আছে , তাই প্রাথমিক ভাবনাটা শেষ । এখন শুধু ছায়াকে ডেকে বেশ কয়েকটা সিটিং নেওয়ার দরকার ।
অনেকদিন পর আবার ছায়াকে নিয়ে ছবি আঁকবেন ভাবতেই মনটা কেমন ভালো হয়ে গেলো । ছায়ার মত মডেল যেকোন শিল্পীর কাছে পরম পাওয়া । শেষ দুটো ছবি আঁকার দিনগুলো সত্যিই বড্ড আনন্দের ছিল ।
ফোনে ধরতে চাইলেন ছায়াকে । একটানা অনেকদিন কাজ করতে হবে ওকে নিয়ে ।
ফোন করতেই মধুর গলায় উত্তর এলো ,” আপনি যে নম্বরে ফোন করছেন , সেটির বর্তমানে কোন অস্তিত্ব নেই । ”
যাহ ! এই নম্বরেই তো বরাবর যোগাযোগ ছিল । আবার , দুবার , চারবার চেষ্টা । মিলল সেই একই উত্তর । মাথা ভন ভন করতে লাগলো ।
ছায়াকে না পাওয়া গেলে কি হবে ? যদিও তাঁ স্কেচবুকে ছায়ার অনেক ভঙ্গিমা আছে ধরা । কাজের ক্যামেরা বন্দী করেছে আবরণহীনা ছায়ার অনেক অনেক পোজ । কিন্তু সেগুলো শুধু আইডিয়া নেবার জন্যে । ছবি অমলেন্দু আঁকতেই পারেন । সত্যি বলতে কি হয়তো সাধারণের চোখে সহজে ধরাও পড়বে না কাজের তফাৎ ! কিন্তু সমস্যা তো নিজের ভেতরে । মডেল নিজে এসে না দাঁড়ালে কি অমলেন্দুর ছবির প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় ?
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আবার চেষ্টা করলেন নম্বরটায় । আগের মতোই ফল ।
ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো একাডেমির ঠিক সামনেই যে চায়ের দোকান , তার মালিক পল্টু দিয়েছিলো ছায়ার খোঁজ ।
ফোনের কললিষ্টে পেলেন না পল্টুর নম্বর । কতদিন আগের কথা । তবে দোকানে গেলে হয়তো পল্টুকে পাওয়া যাবে । তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লেন গাড়ি নিয়ে ।
দোকানে গিয়ে পল্টুকে পাওয়া গেলো না । দেশের বাড়িতে গেছে মামাতো বোনের বিয়ে খেতে । তবে পল্টুর নম্বর পাওয়া গেলো ।
ফোনে ধরলেন অমলেন্দু পল্টুকে ।
“ আমার সাথেও অনেকদিন যোগাযোগ নেই স্যার ছায়ার । তবে মাস আষ্টেক আগে একবার আমার দোকানে এসেছিলো । কাজ খুঁজছিলো একটা । আপনাকে খুব ভক্তি করে স্যার ও । বললো ওর বাড়ি গিয়ে দুটো ডালভাত খেয়ে আসতে । আমি রাজি হয়নি প্রথমটা । কিন্তু কিছুতেই ছাড়লো না । আমার জন্যেই ও আপনার মতো লোকের সন্ধান পেয়েছে তাই আমাকে খাওয়াবেই । গেলাম ওর বাড়ি । খুব অভাব দেখলাম স্যার । তারমধ্যেই আমাকে কত যত্ন করলো । বললো ওর নাকি বাচ্চা হবে । ওর বরকে কিন্তু দেখিনি । কলকাতায় ফিরেই আমি খোঁজ এনে দেব স্যার ! দিন সাতেক পরেই ফিরছি । ”
আরো সাত দিন !
অমলেন্দুর আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করলো না । এর মধ্যে ছায়াকে পেলে কাজ অনেকটা এগিয়ে নেওয়া যাবে । তবে মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো অমলেন্দুর ।
বেশ তো ছিল , আবার মা হতে গেলো কেন ? আর কি শরীরে সেই বাঁকগুলো থাকবে ? অনন্তযৌবনা রাধার রূপ কি কোনো মায়ের শরীরে ফোটানো যায় ?
তবুও সাতপাঁচ ভেবে পল্টুর কাছ থেকে ঠিকানাটা নিয়েই নিলেন অমলেন্দু । দক্ষিণ কলকাতার একটা বস্তি অঞ্চল । বাড়ির নাম্বার টাম্বার থাকে না ওসব জায়গার । তবে পল্টু বললো ছায়ার নাম করলে আশপাশের লোক দেখিয়ে দেবে ।
দেরি না করে সোজা চলে গেলেন ছায়াকে খুঁজতে ।
আবার ডাকলেন অমলেন্দু , ” ছায়া ! ছায়া ! আমি অমলেন্দু !”
সাড়া মিললো না । একটাই ঘর । একপাশে কিছু বাক্স পেঁটরা । আরেকটু এগিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো দৃশ্যটা !
মাটিতে ছায়া শুয়ে আছে । চোখ বোজা । কাপড়চোপড় এলোমেলো । বুকের কাপড় সরানো । তাতে মাথা রেখে শুয়ে আছে একটা শিশু ।
“ ছায়া , এই ছায়া !”
ছায়ার সাড়া মিলল না । কিন্তু শিশুটি অমলেন্দুর দিকে তাকিয়ে হাসল ।
কি হতে পারে সেই হাসির তুলনা! সদ্য ফোটা ফুল? জ্যোৎস্না মাখানো ধূ ধূ মাঠ নাকি চন্দনের গন্ধ!
অমলেন্দু কি একমুহূর্তের জন্যে পাথর হয়ে গেলেন ! পরমুহূর্তেই মনে হল এই হাসিটাকে ধরে রাখতেই হবে তাঁর ক্যানভাসে । তাই তাড়াতাড়ি ফোনটা পকেট থেকে বের করতে গেলেন আর বাচ্চাটা কে জানে কেন ভীষণ জোরে কেঁদে উঠলো ।
বাইরে বেশ ভিড় জমেছিলো । কান্না শুনে দু একজন কৌতূহলী মহিলা ঘরে ঢুকে পড়লো । অপ্রস্তুত অমলেন্দুকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসে একজন বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো আর একজন ধাক্কা দিয়ে ডাকলো ছায়াকে ।
” ওমা এযে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে গো ! দুদিন আগে ঘরে একটা দানা নেই বলে আমার কাছে চাল চাইতে গেছিলো , তখনি দেখছিলুম খুব দুব্বল !”
বাচ্চাটা ততক্ষণে কান্না থামিয়েছে । হাসি দেখার জন্যে অমলেন্দু তাকালেন আবার শিশুটির মুখে । কিন্তু কেমন যেন ভয়ের ছাপ সেখানে ।
চিরকালের ঝুটঝামেলা এড়ানো অমলেন্দুর ওপর কি জানি কি ভর করল । এম্বুলেন্স ডেকে ছায়াকে হাসপাতালে পাঠিয়ে পাশের ঘরের বৌটিকে কিছু টাকা দিয়ে এলেন বাচ্চাটাকে দেখার জন্যে । মহিলাটি অমলেন্দুর ফোন নম্বর রেখে দিলেন ।
হাসপাতালে ভর্তির দুদিন পর জ্ঞান এসেছিলো ছায়ার । চিনতে পেরেছিলো অমলেন্দুকে । অমলেন্দু একটা কথাই শুধু জানতে চেয়েছিলেন । বাচ্চার বাবার খোঁজ । ছায়া উত্তর দেয় নি । হয়তো উত্তর ছায়ার কাছেও অস্পষ্টই ছিল । তবে কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল ছায়া ।
“ ছেলেটা পেটে আসার পর সব্বাই বলেছিলো ওকে শেষ করে দিতে । পারিনি । এক্কেবারে আমি লোপাট হয়ে যাবো মরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একথা ভাবতে পারিনি স্যার । ওই তো আমার একমাত্তর চিহ্ন । কিন্তু এখন বুঝেছি ভুল করেছি , কে দেখবে ওকে ! আপনার তো কত্ত চেনাজানা ! একটা ভালো বাপ্ মা দেখে ওকে দিয়ে দেবেন স্যার ! ওর যেন অযত্ন না হয় ! এইটুকু করবেন স্যার ! নইলে আমি মরেও যে শান্তি পাবো না !”
ছায়াকে মুখে সান্ত্বনা দিলেও সত্যিটা জানা ছিল অমলেন্দুর । ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন । দীর্ঘদিনের অভাব আর অপুষ্টি । তার ওপর বাচ্চাটাও টেনে নিয়েছে শরীরের সবটুকু সুধারস । সব মিলে ছায়ার ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে । বাসা বেঁধেছে আরো নানা রকম রোগ । ছায়ার দিন হাতে গোনা ।
প্রথম দুটো দিন খুবই চিন্তায় ছিলেন অমলেন্দু ছায়াকে নিয়ে । কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে বারে বারে মনে ভেসে উঠেছে ছায়ার ছেলের সেই হাসি ।
তিন চারদিন পর ছেলেটার খোঁজ নিতে পাশের মহিলার বাড়ি গেলেন অমলেন্দু । ফোন করে খোঁজ নিতে পারতেন তবুও গেলেন । যদি সেই হাসি আবার দেখা যায় । সেই লোভ ।
মহিলাটি কিন্তু আর বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন না । দোষ নেই , খেটে খাওয়া মানুষ । ক ‘ দিন কাজ কামাই করে ছোট বাচ্চা সামলেছেন । অমলেন্দু না এলে তিনি নিজেই জানাতেন ।
অমলেন্দুর ছায়ার কথা মনে পড়লো । বাচ্চাটাকে যদি কোন নিঃসন্তান দম্পতির হাতে দেওয়া যায় ! কিন্তু সময় লাগবে সে কাজের । কিন্তু ততদিন রাখবেন কোথায় একে ? কি যে ঝামেলা জুটলো ! তারপর ভাবলেন যে বাড়িতে নিয়ে গেলে ভালো হয় । ওই ছবিটা আঁকতেই হবে তাঁকে ! মায়ের ছবি তিনি ম্যানেজ করে নেবেন কিন্তু শিশুর ওই হাসি !
যদি আর একবার দেখতে পেতেন !
ফোন করে আনলেন পিসিমণিকে । মিনতিমাসিকে বললেন সেই রাতটা ম্যানেজ করতে । পরের দিন থেকে যে কটা দিন বাচ্চাটা থাকবে কাছের সেন্টার থেকে আয়া এসে দেখবে ।
পিসিমণি এসে ছেলেটাকে দেখে আনন্দে অস্থির । তাঁর কেমন যেন ধারণা হলো এ ছেলে তাঁর অমলেরই । হাবভাবে যেন অনেক মিল । অমলেন্দু একফুঁয়ে ওড়ালেন সেই ভাবনা । জানালেন ছেলেটা ছায়ার , বাবা অজানা । তিনি খুঁজছেন এমন কাউকে যারা বাচ্চা দত্তক নেবেন । ভালো ফ্যামিলি না পাওয়া পর্যন্ত ছেলেটা থাকবে এখানে ।
একুশ দিনের মাথায় ছায়া চলে গেলো। জানাই ছিল থাকবে না। তাও পিসিমণি যখন ছেলেটাকে কোলে করে বললেন,
“তুই জানলিও না সোনা, আজ তোর কত আপনার জন অনন্তে মিলিয়ে গেলো “
শুনে কাঠখোট্টা অমলেন্দুর বুকেও কেমন যেন মোচড় দিলো।
মাস দুয়েক কেটে গেছে এর পর । অমলেন্দু আরো দুটো ছবি এঁকে মিঃ মেহতাকে দিয়েছেন । চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেছে । আরো কাজের অর্ডার এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে । অমলেন্দু সময় চেয়ে নিয়েছেন । ভালো মডেলের খোঁজ পেতে হবে তাঁকে ।
ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকেই কিন্তু অনেকবার সেই হাসি মুখ ভেসে উঠেছে অমলেন্দুর মানসচক্ষে । বাচ্চাটা তো কতবার হেসেছে এর মধ্যে , কিন্তু কোনোটাই যেন সেদিনের হাসি নয় ।
দু চারটে সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে অমলেন্দুর । খুব তাড়াতাড়িই হয়তো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে অনাথের । হ্যাঁ ওই নামই দিয়েছেন পিসিমণি ছেলেটার । বাবার খোঁজ না পাওয়া, মা হারা ছেলের আর কি নামই বা হতে পারে !
অনাথকে খুব যত্ন করেন পিসিমণি । আয়ারা তো আছেই । কিন্তু পিসিমণি সদা ব্যস্ত একরত্তি ছেলেটাকে নিয়ে । এখন হামা দিচ্ছে অনাথ । কোথা থেকে যেন বের করে অমলেন্দুর ছোটবেলার কোমরের রুপোর গোট পরিয়ে দিয়েছেন পিসিমণি । পায়ে রুপোর মল । দু – আড়াই মাসের যত্নে অনাথের এখন জেল্লাও এসেছে চেহারায় ।
দিনতিনেক আগে সকালে জলখাবার দিতে দিতে পিসিমণি এমন একটা কথা বললেন যে একটু হলেই বিষম খাচ্ছিলেন অমলেন্দু ।
“ আমি বলি কি অমল , তুই ছেলেটাকে লেখাপড়া করে দত্তক নে । এমন সোনার গোপাল যেচে যখন তোর কাছে এসেছে ওকে তুই মানুষ কর “
“ তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে পিসিমণি ! আমি বিয়ে করলাম না ঝামেলা এড়ানোর জন্যে আর তুমি বলছো …”
” তাতে কি ? সে যুগে যশোদা না বিইয়ে কানাইয়ের মা হয়ে ছিল , তুই না হয় এযুগে অনাথের বাপ্ হবি !”
” কিন্তু ও তো আমার কেউ নয় পিসিমণি । “
“ নয় কে হয় করতে কতটুকু সময় লাগে রে ? আর নিজের পরের আবার কি ? এই যে এতো জমজমাট রায় বংশ , চারপুরুষ ধরে জ্বলজ্বল করছে , সেই বংশের উপেন্দ্রবাবু তো দত্তক পুত্র তা কি জানিস না ? ইতিহাসে এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে ”
পিসিমণি এবার উত্তেজিত । একটু দম নিয়েই আবার বলে চললেন ,” আমি এখনো শক্ত পোক্ত আছি আর প্রথম দু তিনটে বছর একটু ঝামেলা হয় । তারপর ইস্কুল যাবে , সব নিজে নিজে করতে শিখে যাবে । এতো বড় বাড়ি তোর । একটা ছেলের জায়গা হবে না ? তোর যা যা বিদ্যে সব দিয়ে যাবি ওকে ! তোর তো তবু একটা চিহ্ন থাকবে রে !’
চিহ্ন কথাটা ধক করে বুকে এসে লাগলো অমলেন্দুর । একজন শুধু চিহ্নটুকু রাখবে বলে কত কষ্ট অপমান সহ্য করে মা হয়েছিল !
চুপ করে টেবিল থেকে উঠে পড়লেন অমলেন্দু ।
দুদিন ভীষণ কাজের চাপ ছিল । সারাদিন বাইরে বাইরেই কেটেছে অমলেন্দুর । বাড়িতে খাওয়াদাওয়ারও সময় ছিল না ।
আজও খুব সকালে বেরিয়ে গেছেন । দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে প্রায় । অনাথ ঘুম থেকে উঠে পিসিমণির কোলে ফলের রস খাচ্ছে ।
অমলেন্দু ঘরে ঢুকলেন । পিসিমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন ,
“ আজ রাত্তিরে পোলাও আর মাংস রাঁধবে ! অনেকদিন খাইনি !”
সেদিনের পর পিসি ভাইপোতে তেমন বাক্যালাপ হয় নি । পিসিমণি একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ভাইপোর দিকে ।
” হাঁ করে দেখছো কি ! এই দ্যাখো কাগজ । আজ থেকে আমি ছেলের বাপ্ !’
নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হলো না পিসিমণির । অনাথের খাওয়া হয়ে গেছিলো । আঁচল দিয়ে তার মুখটা মুছিয়ে তাই সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করলেন ,
“ তার মানে ? তুই সত্যি সত্যি অনাথকে দত্তক নিলি ?”
“ অনাথ নয় , আমার ছেলের নাম শ্রীযুক্ত সৌমেন্দুবিকাশ মিত্র ।”
বলার সাথে সাথে শ্রীযুক্ত সৌমেন্দুবিকাশ কি বুঝলো কে জানে , একগাল হাসলো ।
সেই হাসি । সদ্য ফোটা ফুল , জোৎস্না মাখানো ধূ ধূ মাঠ নাকি চন্দনের গন্ধ, কে হতে পারে তুলনা সেই হাসির ?
মুঠোফোনটা হাতেই ছিল । তবুও ছবি না তুলে ছেলেকে কোলে নিলেন অমলেন্দু ।
জানেন ও হাসি এবার থেকে তিনি বার বার দেখতে পাবেন ।