• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় হেমন্ত সরখেল

মানবী সিং পরাণ পুং

‘— ও পরাণ দা, তোমায় পার্টি অফিসে দেখা করতে বলেছে, বিকেল চারটের মধ্যে…’ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সাইকেলে বসেই হাঁক দেয় পল্টু। তারপর প্যাডেলে চাপ দিয়েই উধাও। বিচুলী কাটতে বসা পঞ্চাশোর্ধ পরাণ কথাটা শুনতে পেয়ে হাতের বিচুলী রেখে গামছা বাঁধতে বাঁধতে যতক্ষণে উঠোনে এল, ততক্ষণে রাস্তায় চিল কাক ও নেই। রাস্তার ওপারের দস্তিদারের দোকানের কাজের ছেলেটা খ্যাক্ খ্যাক করে হেসে উঠল। ‘ আচ্ছা জ্বালাতন! কে যে চেঁচাল নাম ধরে, কি বলল, তাও বুঝলাম না। এই পাঁঠা! তুই খ্যাঁকশিয়ালের মতো হাসছিস কেন? কে ডাকল আমায়? কি বলল? শুনেছিস?’ ‘– পাতি অপিতে ডেতেতে,তালতের মড্ডে,হি হি’– পাঁঠার দাত মেলানো জবাব শুনে পরাণ বুঝতে পারল ওর ডাক পড়েছে। কিন্তু কেন সেটা বোঝা গেল না।
পরাণ মধ্যপন্থী। আর সকলের মতোই। যে রাজা আমরা তারই পৃষ্ঠপোষক। এই মাগ্গিগণ্ডার বাজারে সকলকেই চাল কলা প্রত্যাশী বামুন ঠাকুর হতে হয়, নইলে পেয়াদা, কোটাল, সেনাপতি… আর কলাটা মুলোটা হাতছাড়া হয়। তার থেকে ভালো স্রোতাভিমুখে নিঃশব্দে গমন। কে কার জন্য ভাবছে বাবা!! নিজেকে গুছাও, থলে ভরো। জয় মা। পরাণ বিচুলী কাটতে বসল।
সোয়া চারটে নাগাদ পরাণ পার্টি অফিসে ঢুকল। প্রায় চার ঘন্টার টানা অস্ত্রোপচারের পর নির্ধারিত হল যে যেহেতু পরাণবাবুর আধার কার্ডে বাবার নামের বানান ভুল আছে তাই সরকারী পায়খানাটা ওনার স্ত্রী মানবী সিংহের নামেই নিতে হবে। তাছাড়া জমির মালিকও নাকি তিনিই। তবে বারো হাজারে দস্তখত করলেও তিনি হাতে পাবেন সাড়ে ন’ হাজার। না বলার উপায় নেই। ছেলে, মেয়ে দুটোকে এরাই কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বড়ো মেয়েটা রেপ এন্ড মার্ডারের পর সরকারী দু লক্ষ টাকা এরাই অনুমোদন করিয়েছে,যদিও টেবিলে টেবিলে ঘুরে যেটা হাতে এসেছে সেটা বলতে নেই, এটা শিখেছে পরাণ, কাজেই সরকারী অনুদানের খাতায় আবারও ভাসছে পুরোনো ভোটার লিস্টের সেই নামটা মানবী সিং পরাণ পুং…..
টাকাটা পাওয়ার প্রায় বাইশ মাস পর হঠাৎ পরাণের বাড়িতে চারজন লোক এল। এনারা নাকি পরিদর্শক। পাকা পায়খানা দেখতে এসেছেন। মাটির দাওয়ায় খেজুর পাতার চাটাইটা বিছিয়ে দিয়ে বকুল বলল ‘– আপনারা বসুন,বাবা গেঁড়ি তুলতে গেছেন,খবর দিচ্ছি।’ এই বাইশ মাসে পরাণ শুধু নামের অর্থটুকুই যে বহন করে চলেছে তা বকুল জানে। গেঁড়িটুকু না তুললে দুপুরের খাওয়াও হবে না,শুধুই চাল পড়ে আছে ঘরে। মায়ের মুখের গড়াতে থাকা নালটা মুছে, পেছনের দরজা দিয়ে বকুল বেড়িয়ে এল যমুনার পারের দিকে। ভাইয়ের মামলাটা লড়তে গিয়ে ওদের বাড়িটা বিক্রি করে উঠে আসতে হয়েছে এই যমুনার জলা অঞ্চলে, যেখানে বানভাসি হওয়া এবং বন্যাত্রাণে মানবী সিং পরাণ পুং ওদের আজও অব্যাহত রয়েছে।তার উপর মায়ের প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়াটায় সবথেকে বেশী ক্ষতি করল বকুলের, সেকেন্ড ইয়ারের মুখ আর দেখা হল না। অজান্তেই বুকটা মোচড় মারে। ভুলতে চাইলেই কি ভোলা যায়!!!
‘—- আপনার স্ত্রীর নামে তো একটা পাকা পায়খানা রয়েছে,তাই না? আমরা দেখতে এসেছি সেটা আপনারা ঠিকঠাক বানিয়েছেন কি না।’- কথাটা পরাণের শিরদাঁড়াকে যেন ঠান্ডা করে দিল। মেয়ের দিকে ফিরে বলল ‘– একটু জল দে তো!’
দাওয়ার বাঁশটা ধরে উবু হয়ে বসল পরান, তারপর বলল ‘– টাকা আমি নিয়েছিলাম বটে,তবে সে আর করা হয়নি। আসলে,টাকাটা কম দিয়েছিল বলে ছেলেটা হঠাৎ মাথা গরম করে ফেলল। মেরে বসল পঞ্চায়েত প্রধানকে। নিজেও মার খেল বেদম, তার উপর থানা পুলিশ, মামলা মোকদ্দমায় সে টাকা, ভিটে সবই গেল। ছেলেটার ও যাবজ্জীবন হল, এসবে বৌটাও পঙ্গু হয়ে পড়ে রইল। এখন শুধু শালুক-শাপলা, গেঁড়ি-গুগলিতেই জীবন। টাকা তো নিয়েছিলাম হুজুর… ‘
স্তব্ধতা পরিব্যপ্ত চারিদিকে। দুটো ডাহুক কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে অনুচ্চ স্বরে ডাকছে। বকুল নিঃশব্দে হাতে ধরা গ্লাসটাকে পরাণের সামনে এগিয়ে ধরে। গ্লাসের জলের স্রোত গলা, পাঁজর কাঁপিয়ে ঢুকছে অন্ধকূপে। যার টানের আর শেষ নেই, নিচেও জানে না ঠিক কতোটা হলে সে নিজে টইটম্বুর হবে! ‘– তাহলে তো এ টাকাটা আপনাকে সরকারকে ফিরিয়ে দিতে হবে! এটা তো রাহাজানির সমতুল্য যে সরকারের খাতের টাকা সে খাতে আপনি সদব্যবহার করেন নি। হ্যাঁ, মানছি, আপনার সাথে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু সরকার তো শুধু কাগজ চেনে,তার তো আপনার পরিস্থিতিতে কোন ইন্টারেস্টই নেই! এই দেখুন, লেখা রয়েছে- মানবী সিংহ। দেখছেন?’ পরাণ আর বকুল দুজনেই কাগজটা ঝুঁকে পড়ে দেখল, সত্যিই লেখা আছে। ‘– কিন্তু আমি তো অপারগ স্যার! আমার আজ খাওয়ার ও সংস্থান নেই! রেশনের চাল আর মেয়েটার চারটে টিউশন – এছাড়া আর কিছুই নেই। এবার আপনারা সরকার, যা বোঝেন, করেন। চারজনের চোখে চোখে কথা চলে। পরাণ অধোবদনে, খেয়াল করে না, বকুল মায়ের গাল থেকে গড়ানো লালা মুছতে ব্যস্ত। একজন একটু ঝুঁকে পরাণের কানে কানে কি একটা বলল। ক্ষয়িষ্ণু পরাণ ধনুকের ছিলার মতো তিড়িং করে লাফিয় উঠেই আড়ার থেকে হেসো টান দিয়ে বের করে ‘— তবে রে! শুয়োরের বাচ্চা! সাঁট করে এসেছো! এবার এটা চাই? কেটে যমুনায় ভাসিয়ে দেব। আমি ওর বাপ, এখনো মরি নি…..’
প্রাণ মুঠো করে অপসৃয়মান চারটে জন্তু মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে, নিঃশব্দে বকুলের জলধারা মানবীর সারহীন হাতের উপর পড়তে থাকে। মনে মনে পলিটিক্যাল সাইন্সের সেই চ্যাপ্টারটা পড়ে বকুল— সমানতার অধিকার, রুল সিকস্টিন। পরাণ বিড়বিড় করে- ‘ আয়, আয়, এখনো মরিনি!!!’
যমুনায় কচুরিপানার মধ্যে বসে ডাহুক দুটো ডেকেই চলে, ডেকেই চলে। মানবী সিংহের চোখের জল অসহায় হাত গড়িয়ে টুপ টুপ করে পড়তে থাকে মেয়েটার পায়ের কাছে রাখা মাটির চালের হাঁড়ির সরার উপর, যেন ওর চোখের উষ্ণ জলেই চাল ফুটে আজ ভাত রান্না হবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।