• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় অঙ্কিতা দাস

 শিকড়

কোনো এক শীতের বিকেলের ঝরা পাতাদের মত আমাদের পরিবার টাও এক নিমিষে ঝড়ে গেছিল। ভাবিনি কখনো এমনটা হবে, মনে হয়েছিল না চাইতেই যেন এক অন্ধকার কূপ আমাকে গ্রাস করতে চাইছে। এক মুহূর্তে এই সাহসী মনটাও ভিতগ্রস্ত হয়ে গেছিল। আর হবে নাই বা কেন? গাছের শিকড়কে যখন এমনভাবে উপড়ে ফেলে হয় তখন তার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা সামান্য প্রাণীর কথা যখন কারোর মাথায় থাকেনা তখন আমরা কি? আমরা তো নগন্য মানুষ মাত্র। যা এই চিরাচরিত সমাজের বাদের খাতায় পড়ে।
সাল ২০১৭, ৭ ই ফেব্রুয়ারি, এমন একটি ঘটনার সম্মুখীন হবো কখনো আশাই করিনি। তুমি যে আমায় ছেড়ে এত দূরে চলে যাবে কখনো এই অবুঝ মনটা মানতেও চায়নি। আজ father’s day সবাই সবার বাবাকে নিয়ে লিখছে। কিন্তু আজ আমি আমাদের পরিবারের সবার বাবা মানে আমার বাবারও বাবা অর্থাৎ আমার দাদুর কথা বলছি। ছোটবেলায় আমাদের সবার কাছে দাদু ঠাকুমা ছিল সবচেয়ে আদরের জায়গা। মা বাবার বকুনি , মার সব কিছু থেকে বাঁচার ঢাল হয়ে থাকতেন এরা। ভোর চারটে বাজতেই ঘুম থেকে উঠে ফুল তুলতে যাওয়া থেকে শুরু করে রাতে দেশ বিদেশের গল্পো শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো সব কিছুর সঙ্গী হলেন তারা। সত্যি আজ ওই কথাটা খুব বিশ্বাস করি যে, ‘মা বাবার ভালোবাসার থেকেও দাদু ঠাকুমার ভালোবাসা অন্য রকমের’।
সত্যি সেই দিন গুলো কখনো ভোলার মত নয়। স্কুল থেকে এসেই সারাদিনের গল্পের ঝুলি নিয়ে তোমার কাছে বসা, বিকেলে তোমার সাথে হাটতে বেরিয়ে Texmaco মোড় থেকে বাদাম ভাজা খাওয়া, রবিবার হলে বাগান পরিষ্কার করা, গাছ লাগানো – এগুলোর মধ্যে হঠাৎ করে যেন তালা পড়ে গেল। রবিবারের দিন গুলো আমার কাছে খুব স্মরণীয় হয়ে আছে, আর থাকবেই না কেন? রবিবার হলেই আমি তোমার সাথে বাজার ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পেতাম যে, আমার খুব ভালো লাগতো যখন তুমি বাজারে সবার কাছে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে আর বলতে, ‘ এই যে আমার নাতনি, বড্ড লক্ষী মেয়ে, ভাগ্য করলে এমন মেয়ে আসে পরিবারে, আমাদের বাড়ির একটি মাত্র মেয়ে’। লজ্জা পেয়ে তোমায় ঠিক চুপ করিয়ে দিতাম ঠিকই কিন্তু মনে মনে খুব ভালো লাগত আমার। এমন গর্বের সুরে তুমি বলতে আমার মন ছুঁয়ে যেত। বেশ মজা পেতাম যখন বাবা আর কাকার ঝগড়া তোমার এক ধমকেই শান্ত হয়ে যেত, মনে মনে বলতাম বেশ হয়েছে আরও করো এমন। কিন্তু, সেদিন বুঝলাম তোমার ধমকে ওরা সাময়িক ভাবে চুপ করে গেলেও তোমায় কখনোই মান্য করেনি। নাহলে, আমাদের সেই একান্নবর্তী পরিবারও তোমার চলে যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত না। সত্যি তুমি যেন শিকড় হয়ে সবাইকে এক সূত্রে বেধে রেখেছিলে। এখন আর কারেন্ট চলে যাওয়ার মধ্যে কোনো আনন্দ খুঁজে পাই না। আর পাবো কি করে এখন তো আগের মতো আর গানের লড়াই খেলা হয় না আর সেই রবিবার আসলেই ‘ বৌমা আজকে মাংস টা একটু কষিয়ে করো তো, সবাই একসাথে বসে জমিয়ে খাই ‘- এসব সবই যেন আজ স্বপ্নে রূপান্তরিত হয়েছে।
আর আমি? আমি আজ বড়োদের কোঠায় পড়ি। যেখানে আমায় আমার সিদ্ধান্ত নিজেরই নিতে হয়।তাই কেউ বোঝেই না আমি কি চায় আর চাইনা।মুখ ফুটে কিছু না বললে আর না চাইলে কেউ বোঝেই না আমায়। সবাই কি আর তোমার মতো বুদ্ধিমান? যে মুখ দেখলেই বুঝে যাবে আমার কি হয়েছে। খুব অসহায় লাগে যখন আমি কিছু পারছিনা বা কিছু সিদ্ধান্ত নিতে আমার ভয় লাগছে, এই কাজটা কি আঁদেও আমার দ্বারা সম্ভব – এত প্রশ্ন নিয়ে যখন মন বিচলিত হয়ে যায় তখন তোমার সেই কথা গুলো আমার আজও কানে বাজে – ‘ তুই পারবি। তোকে যে পারতেই হবে দিদিভাই ‘। তুমি বলতে তুমি চলে গেলে আমার কি হবে? সত্যি আজ আমার এই কথা টা মনে পড়ে। রাতে পড়ার অভ্যাস আর আগের মতো নেই। কেননা, তোমার মতো করে এখন যে আর কেউ বলে না -‘ অনেক রাত হলো দিদিভাই, এবার ঘুমিয়ে পড়, সকালে উঠে পড়িস আবার ‘।আমার ডাকনাম মিমি হলেও কোনোদিনও তুমি আমায় মিমি বলে ডাকো নি। সব সময় মিনি বলে ডাকতে। আজও খুব জানতে ইচ্ছে করে কেন এই নামে ডাকতে! তুমি যাওয়ার সাথে সাথে এই নামটাও যেন হারিয়ে গেছে আজ। রাস্তায় যখন কোনো বাচ্চাকে দেখি তার দাদুর হাত ধরে যেতে আমার মনটা কেদে ওঠে। আজ সমস্যা বলার মত অনেক মানুষ আছে কিন্তু সমস্যা সমাধানের মানুষের অভাব বোধকরি। সত্যি যদি তুমি সব সময় আমার কাছে থাকতে! আবার তোমার হাত ধরে ফিরে যেতাম সেই সব দিন গুলোর কাছে।
আমরা সব সময় মায়েদের কথা বলি যে, একটা সংসার গড়ে তোলার পিছনে মায়ের অবদান সত্যি অনস্বীকার্য। যা, আমরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন চাক্ষুষ দর্শন পাই কিন্তু সব কিছুর আড়াল থেকে আমার দাদুর মত বাবারা গাছের শিকড়ের মত শক্ত করে একটি পরিবারকে টেনে বেড়ে তুলতে সাহায্য করে যা আমরা কখনোই টের পাই না কিন্তু যখন আমরা বুঝতে পারি তখন অনেক টাই সময় পেরিয়ে যায় আর কিছুই করার মত থাকেনা আমাদের হাতে।
(আমার দাদুকে দেওয়া আমার ছোট্ট উপহার। কখনো বলার সুযোগ পাইনি তোমায়, যে বড্ড ভালোবাসি তোমায়। তুমি আমার জীবনের প্রথম পুরুষ যাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসি আমার বাবার থেকেও বেশি। যেখানেই থেকো ভালো থেকো আমার পাশে থেকো সব সময়।
ইতি,
তোমার মিনি)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।