• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় অর্পিতা আচার্য

আমাদের বাবারা

ঠিক দুপুরে স্কুল বাস থেকে নামার সময় মোড়ের বাঁধানো গাছটার পাশে সাইকেলটা দেখতে পেতাম । একটা অবধারিত সাইকেল । শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বারো মাস । আলাদা করে দেখতামও না তেমন আসলে । দেখার মতো কী ছিলো তাতে? ওতো আছেই! হাতের পাঁচ। আমাকে দেখলেই বাবা চায়ের দোকানের রক ছেড়ে সোজা সাইকেলের হ্যান্ডেলে, আর আমিও লাফ দিয়ে রডের ওপর! তারপর, সেই অনন্ত সাইকেল চলছে তো চলছেই… মাঠ ঘাট কাদা গর্ত জঙ্গল পাহাড় সমুদ্র কেমন অনায়াসে ডিঙিয়ে সে সাইকেল যেন যাচ্ছে আর যাচ্ছে… বিরামহীন ।
এ গল্প পুরোনো । আমাদের বেশির ভাগেরই ঘটনাবর্তহীন জীবনে এই বাবাটির উপস্থিতি প্রায় ধ্রুবের মতো । কিন্তু অদ্ভুত হলো , এই উপস্থিতি প্রায়সময়ই খুব নীরব , অত্যন্ত আন্ডাররেটেড । পৃথিবীর প্রচলিত কথামালা, সংগীত ও শিল্প, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র কোথাও বাবার এই থাকা না থাকা নিয়ে তেমন কথা নেই, যতটা আছে মাকে নিয়ে , ম্যাটারনাল ইন্স্টিংক্টকে নিয়ে। মা জীবনের অপরিহার্য প্রশ্বাস বায়ু, কিন্তু বাবাও কী আসলে কম কিছু?
স্তন্যপায়ী প্রাণীজগতের মাত্র পাঁচ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবারা বাচ্চাকে বড় করছে আগলে রাখছে, বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ করছে । আর এই পাঁচ শতাংশের মধ্যে মানুষ অন্যতম । একটা সময়ে ইভোলিউশ্যনারি সাইকোলজি বলেছিলো , বাবার সন্তানের প্রতি টান কম , কারণ ইনভেস্টমেন্ট কম । প্রতিদিন অসংখ্য শুক্রাণু উৎপাদনে সক্ষম পুরুষের কাছে একটি সফল নিষিক্তকারী শুক্রাণুর দাম যতটা , প্রতি মাসে একটিমাত্র ডিম্বস্ফোটন সক্ষম নারীর কাছে নিশ্চয়ই এই উৎপাদিত অস্তিত্ব অনেক বেশি দামী? আর এছাড়াও দীর্ঘ প্রায় এক বৎসর ধরে নারী একটি সন্তানই লালন করতে পারে দেহে, অন্যদিকে পুরুষ দেহ এই একবছরে অগনন সন্তান জন্মদানে সক্ষম । এ কারণেই নারীদের সন্তানকে আগলে রাখার , জীবনের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে ফেলার এতো তাড়না । তার ইনভেস্টমেন্ট বেশি , তাই উৎপাদিত বস্তুকে সংরক্ষণের প্রেষণাও বেশি ।
কিন্তু এই ধারণা কি আদৌ বাস্তব সম্মত ? আর একটু ভালো করে দেখলে , আর একটু স্টিরিওটাইপড ধারণা থেকে সরে গিয়ে তাকালে, আমরা কি স্পষ্টই দেখিনা, প্রজন্মের বহমান উত্তরণে পিতার ভূমিকাও খুব একটা কম নয়? নিরানব্বই শতাংশ পাখির স্পিসিস মনোগেমাস। পুরুষ পাখিরা একইভাবে খাদ্য আর নিরাপত্তা ভাগভাগি করে , যেমন করে মেয়ে পাখিরা । যেসব পাখির বাচ্চারা বাবার যত্ন তেমন পায় না, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম, বেঁচে থাকলেও পরিপুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম, এমনই বলেন জীববিদরা। এক ধরনের বাদুড় তো আরও এগিয়ে । তাদের ক্ষেত্রে , শিশুর জন্মের পর বাবা বাদুড়ের শরীরে স্তন্যউৎপাদন শুরু হয়ে যায় । নেকড়ে, শেয়াল , বন্য কুকুরেরা নারী পুরুষ মিলে শিকার করে , নারী পুরুষ মিলে বাচ্চার খাবার জোগাড় করে, বাবা নিয়মিত খেলাধুলা করে বাচ্চাদের সঙ্গে । মারমোসেট, তামারিন ও ক্যাপুচিন বানর বাবারা বাচ্চাদের পিঠে বহন করে ঘুরে বেড়ায়, খাবার জোগাড় করে। এমন উদাহরণ অজস্র ।
প্রাণী জগতেই যদি জন্মদাতা তার সন্তানের এতটুকু যত্নআত্তি করে তবে মানুষের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে না এটাই স্বাভাবিক । ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক জার্নাল পেপারে Joshua A.Krisch বলেন, আধুনিক নিউরোবিজ্ঞানের ধারনা পিতৃত্ব সম্পর্কে পুরোনো চিন্তা ভাবনার অনেকটাই অবসান ঘটিয়েছে । উত্তর আমেরিকার তৃণাচ্ছাদিত অরণ্যের ইঁদুরদের (priarie vole) মস্তিষ্ক সংগঠন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যখন তাদের ঘরে সদ্যজাত শিশু আসে তখন বাবা ইঁদুরের হিপ্পোক্যাম্পাসে বেশ কিছু নতুন নিউরন তৈরি হয় । হিপ্পোক্যাম্পাস হলো প্রাণীর শিখন ও স্মৃতির উৎস ও আবাসস্থল । এসব নিউরন থেকে উদ্ভূত অতিরিক্ত ডেণ্ড্রাইটিক স্পাইন তাদের সাহায্য করে নিজের বাচ্চাকে আলাদা করে চিনতে, আলাদা করে মনে রেখে পরিচর্যা করতে ।
২০১৪ সালের একটি গবেষণায় একদল পুরুষ যাদের সন্তান আছে, আর একদল পুরুষ যাদের সন্তান হয় নি–তাদের একসাথে কিছু শিশুর ছবি দেখানো হয় এবং ওইসময় তাদের fMRI করা হয় । দেখা গেছে, বাবাদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সেই অংশ উদ্দীপিত হয়েছে , যে অংশ ‘ রিওয়ার্ড ‘ পেলে উদ্দীপ্ত হয় । সন্তানহীনদের ক্ষেত্রে কিন্তু এটা ঘটে নি । অর্থাৎ শিশুর ছবি বেশির ভাগ পিতার কাছেই ‘রিওয়ারডিং’ কারণ তা তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত সুখকর অভিজ্ঞতার স্মৃতিকে জাগ্রত করে । অন্যদিকে যৌন উদ্দীপনাময় ছবি আবার সন্তানহীনদের মস্তিষ্ককে তুলনায় উদ্দীপ্ত করেছে বেশি । অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে পুরুষও যে যৌনতার চাইতে বাৎসল্যকে কম গুরুত্ব দেয় না , এই ফলাফল হয়তো তারই প্রমাণ ।
তৃণভূমির ইঁদুরদের নিয়ে আর একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে , নবজাত ঘরে এলেই পিতার মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায় । মানুষের ক্ষেত্রে ২০১০ সালে একটি গবেষণায় নবজাত সন্তানদের বাবাদের শরীরে অক্সিটোসিন প্রয়োগ করে দেখা গেছে, এসব বাবারা বাচ্চার প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হয়ে উঠেছে । “People traditionally thought oxytocin was just a maternal hormone. Now, it is becoming clear that its involved in paternal care giving as well.(Rilling,প্রখ্যাত স্নায়ুবিজ্ঞানী)।
আর একটি বিশেষ হরমোন হলো টেস্টেস্টেরোন, যা পুরুষের যৌনতার সঙ্গে যুক্ত । অবিবাহিত , যৌন সম্পর্করহিত পুরুষদের মধ্যে এই হরমোনের আধিক্য কমে যায় । আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যায় , সদ্যজাত শিশুর বাবা হওয়ার সময়, এমনকি যখন তার মায়ের প্রেগন্যান্সির খবর আসে, তখন থেকেই বহু পুরুষের ক্ষেত্রে এই টেস্টেস্টেরোনের লেভেল কমে যাচ্ছে। অনেক পুরুষেরই এ সময় টেস্টেস্টেরোনের মাত্রা সাময়িক কমে গিয়ে প্রোলেকটোরিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং যাদের এই ঘটনা ঘটে , তারা বাচ্চাকে যত্ন করা, কান্নাকাটি করলে থামানো, রাত জেগে ন্যাপি পাল্টানো, দুধের বোতল মুখে তুলে দেওয়া এসব কাজে বেশি বেশি অগ্রসর হতে থাকে । টেস্টেস্টেরোনের লেভেল অতিরিক্ত কমে গেলে আবার ডিপ্রেশন আসে আর সে ক্ষেত্রে বাচ্চার যত্ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে । নিউরোসায়েন্টিস্ট Gettler তাই বলেছেন,
“There is a sweet spot in the middle for dad’s testerone that helps facilitate nurturant sensitive caregiving”
বাবা হওয়া আসলে এক মধুর অভিজ্ঞতা । মনোবিদরা বলেন , একজন পুরুষের সম্পূর্ণ আইডেন্টিটি, তার দায়িত্ববোধ, সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ধরণ ইত্যাদি সবই পাল্টে যায় বাবা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ।
ফ্রয়েডীয়ান ধারণার ‘অডিপাস জট ‘ সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই জানি । লিঙ্গ স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হওয়ার সময় শিশু এই দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয় । বাবার প্রতি ঈর্ষা বোধ থেকেই তখন তার বাবাকে অনুকরণের প্রচেষ্টা আর তখন বাবারও দায়িত্ব , তার ইমেজকে এমন ভাবে প্রতিফলিত করা যাতে বাচ্চা তাকে অনুকরণ করে এক সার্থক পুরুষ হয়ে উঠতে পারে । এখানে কোনো ব্যত্যয় , কোনো চাপ, কোনো বিকৃতি পুরো ব্যক্তিত্বকেই করে দিতে পারে বিনষ্ট । অন্যদিকে ইয়ুঙ আবার ‘ফাদার কমপ্লেক্স’ এর আওতায় শুধু অডিপাস নয় ইলেক্ট্রাকেও এনেছেন যেখানে মেয়ে শিশু বাবাকে ভালবাসে প্রেমিকের মতো, বাবার ভালবাসা পাওয়ার জন্যই ক্রমে হয়ে উঠতে চায় মায়ের প্রতিমূর্তি । মনোসমীক্ষকদের মতে বাবা এক ইমেজ , এক আর্কিটাইপ…যাকে মানুষ খোঁজে অনন্তকাল । কখনো ঈশ্বরে, কখনো গুরুবাদে, কখনো থেরাপিস্টের কাছে । বাবা হলেন শৈশব ইমেজ …নির্ভরতার, নিরাপত্তার, শক্তি ও আশ্রয়ের । বাবার জন্য এক অসীম ক্ষিদে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে, যাকে James Herzog বলেছেন ‘Father Hunger ‘। এই ক্ষিদে যদি জীবন গড়ে ওঠার পথে ইতিবাচক ভাবে পূরণ হয় তবে ব্যক্তিত্বের বিকাশ হবে ঠিকঠাক আর অভিজ্ঞতা নেতিবাচক হলেই ব্যক্তিত্বের গভীরে প্রোথিত হবে নিরপত্তাহীনতা, বিষাদ ও বিকৃতি ।
শুধু যে সন্তানের মনে বাবার জন্য ক্ষিদে তাও তো নয়, বাবারও থাকে সন্তানধারণের স্পৃহা । এই স্পৃহা এমনই প্রবল যে, নারীকে ঈর্ষা করে পুরুষ , কারণ নারীর মতো সে গর্ভ ধারণ করতে পারে না । মনোবিদ্যায় ফেমিনিজমের চূড়ান্ত মুখ ক্যারেন হর্নি ‘womb envy’ র তত্ত্ব এনেছেন ফ্রয়েডের কাস্ট্রেশান ধারণার বিপরীতে, আর বলেছেন প্রতিটি পুরুষই গর্ভধারণের ক্ষমতাহীনতার জন্য মানসিক দৌর্বল্যে ভোগে, তার ভিতরেও নাকি রয়েছে অপার ঈর্ষা, ধারণ অক্ষমতার ঈর্ষা !
আধুনিক পুরুষ ক্রমশঃ আদি পলিগ্যামি থেকে মনোগ্যামির দিকে ঝুঁকছে …অন্তত প্রজন্ম তৈরির ক্ষেত্রে, আর এর ফলে সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ববোধ, তাকে সুস্থ ভাবে বড় করার আকাঙ্খাও বাড়ছে । মনোবিদ বাউলবাই তার প্রখ্যাত অ্যাটাচমেন্ট থিওরিতে বলেছেন , বাবার সঙ্গে সম্পর্ক সবসময়ই উষ্ণ, রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারময়… বাবার কাছেও সন্তানের কাছেও । আত্মবিশ্বাস, সাহস আর কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে তার মোকাবিলা করতে শেখান পিতা। দুবছর বয়স থেকেই তাই মায়ের চাইতেও বাবার সঙ্গ নাকি বেশি উপভোগ করতে শুরু করে, বিশেষ করে ছেলে শিশুরা । আর মেয়েদের তো বাবাই প্রথম পুরুষ, প্রথম নায়ক, প্রথম বিস্ময়!
সেই সম্পর্ক এতোটাই ডেলিকেট যে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি একটা জীবনকে ছুঁড়ে দিতে পারে হতাশার গভীর গর্তে । সিলভিয়া প্লাথের ‘ড্যাডি’ কবিতার সেই বালিকার তীব্র ভালবাসা আর ততোধিক ঘৃণা আবর্তিত তার বাবাকে ঘিরে, চিরন্তন পিতৃমূর্তির ইমেজকে ঘিরে ।
এভাবেই বাবারা জড়িয়ে থাকেন প্রত্যেক মানুষের জীবনে । সুখ হলে তিনি শ্রেষ্ঠ সুখ, দুঃখ হলেও সেই দুঃখের গভীর আকর ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।