• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় প্রদীপ্ত দে

ইজিচেয়ার

‘পনেরো হাজার টাকা ?!! কি বলছো গো নারান দা ! মাথা ফাথা ঠিক আছে তো ? “
প্রৌঢ় কাঠমিস্ত্রি নারায়ণ বালা ওরফে নারান ব্যস্ত কাজে । কানে একটা চার ইঞ্চির পেনসিল গুঁজে রাখা । ঠোঁটের একটা কোণে বিড়ি জ্বলছে ধিকিধিকি। এক টুকরো শিরীষ কাগজ নিয়ে ঘষে ঘষে মসৃণ থেকে মসৃণতর বানাচ্ছে একটা ঠাকুরের সিংহাসনের পায়া। চোখ না তুলেই ঠোঁটে রাখা বিড়ির একটা টান নিয়ে বিড়িটা দাঁতে চেপে বলল
– ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ গো বাবু। তবুও তো রদ্দা মাল দিতে পারছি না খদ্দেরকে।
কথাটা শুনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো পলাশ । পলাশ মজুমদার। বয়স সবে চল্লিশের দোরগোড়ায় পা রেখেছে। প্রায় রোজ‌ই যাতায়াতের পথে সে দেখছে একটা ইজিচেয়ার। যতবারই দেখে ততবারই একটা অপরাধবোধ মুচড়ে ওঠে বুকের বাঁদিকে। অফিস থেকে ফেরার পথে মেট্রো স্টেশন থেকে অটোতে চেপে বাড়ি ফেরে । আজ হেঁটে যাবে মনস্থির করাই ছিল এই কারণে। তবুও কার্যসিদ্ধির আশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হ‌ওয়ায় একটা আপ্ত দীর্ঘশ্বাস বাইরে বেরিয়ে আসে তাঁর। নিজেই বোঝায় নিজের মনকে, সব আশা তো আর পূরণ হয় না! তবুও তৃপ্ত হতে পারে না সে। বাবার রোগজর্জর চেহারাখানা যেন চিন্তার স্রোতের ওপরে ভাসতেই থাকে বিসর্জনের মূর্তির মতো। অথচ তাঁর বাবা তো মুখ ফুটে কোনদিন তাকে কিছু বলেননি। তাঁর কেবল মনে পড়ে ছোটবেলার এক স্মৃতি । পুরনো কিন্তু স্পষ্ট। তখন ক্লাস এইট হবে। অফিসের বিমল কাকুর পরিবারের সাথে বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল সেবার ডায়মন্ড হারবারে। সেখানে গেস্ট হাউসে একটা ইজি চেয়ারে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কথাটা বলেছিল বাবা
– বুঝলে বিমল, রিটায়ার করার পর এইরকম একটা ইজিচেয়ার বানাবো। বড় শখ, বারান্দায় বসে বসে খবরের কাগজ পড়বো আর চা খাবো।
অদূরে সেদিন পলাশ‌ও দাঁড়িয়ে ছিল। কথাটা সেদিন থেকেই যেন অকারণেই সে আত্মস্থ করে নেয়। তার আগে বা পরে কখনো তার বাবাকে কোনো শখের কথা উল্লেখ করতে দেখা যায়নি। অবশ্য সংসারে তার শখ দেখার যে খুব কারো ইচ্ছে বা দৃষ্টি ছিল, সে কথাও বুক বাজিয়ে বলা যায় না। এই যেমন আজ হাটতে হাটতে পলাশের মনে হচ্ছে মেট্রো স্টেশন থেকে তার বাড়ির দূরত্ব অনেকটাই। অথচ বাবা তো রোজ হেঁটেই আসাযাওয়া করতো। আজ হেঁটে বুঝতে পারছে যে কতটা কষ্টসাধ্য ! বাবাকে মা জিজ্ঞেস করায় একবার হিসেব করে বুঝিয়েও দিয়েছিল
– অটোর ভাড়া পাঁচ টাকা। বলি রোজ দশ টাকা বাঁচলে কতো হয় পঁচিশ দিনে ? তাতাই আর ঝুমুরের এক মাসের হেলথ ড্রিংক হয়ে যাবে ।
আচ্ছা, বাবা কোনদিন হেলথ ড্রিংক নিতো ? হঠাৎই মনে আসে পলাশের। মনে হয় না। সারাদিন তো লাল চা খেয়েই কাটাতো লোকটা। কি অদ্ভুত ! এতটা হাঁটা যায় রোজ !! পায়ে নরম জুতো পরেও পায়ের পাতা গরম হয়ে যাচ্ছে। অথচ লোকটার তো একটাই চটি থাকতো সারাবছর পায়ে। ছোটবেলার পুজোর বাজারের কথা মনে পড়লে ইদানিং অনুশোচনায় মাথা হেঁট হয়ে আসে পলাশের। তখন বাবার বোনাসের টাকায় পলাশ‌ ও তাঁর বোনের‌ই ঠিক মনপুঃত বাজার হতো না। প্রায় একরকম জোর করেই আদায় করা হতো তার দামি জিন্স, বোনের হাল ফ্যাশনের ড্রেস। বন্ধুদের সাথে নাহলে পাল্লায় কম পড়ে যাবে যে !
এরপর তাঁর মা একখানা শাড়ি নিতো হয়তো কারোর থেকে ছমাসের ইনস্টলমেন্টে। আর বাবা ?!! বাবার জন্য কিছুই নেই। শুধু ষষ্ঠীর দিন বাবা পরিচিত দোকান থেকে একখানা নতুন চটি কিনতেন কম দামে। আর পুরনো চটিজোড়া সেখানেই রাস্তার পাশে ফেলে আসতেন। শুকতলা ক্ষয়ে যাওয়া, মুচির বারবার পেরেক মারা সেই জুতো তার অনেক আগেই পড়ার অযোগ্য হয়ে উঠতো। তবুও বাবা সেটাকে ষষ্ঠী অবধি টানতেন। কারণটা এখন আন্দাজ করতে পারে পলাশ। পরিবারের সবার হয়ে যদি অবশিষ্ট থাকে, তবেই সে কিনবে। শত হোক , সেও তো এখন বাবা ! খানিকটা হিসেব তাকেও এখন রাখতে হয় সবার। তবে এখন বাবাদের‌ও মনেহয় সেই দিন নেই। কর্পোরেট বাবারা অফিসে বসে আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় কিনে নেয় পছন্দের শার্ট। অথবা উইকেন্ডে শপিং মলে ঢু মেরে ডিসকাউন্টে পছন্দের জিনস্ তুলে নেয়। এখন বাজেটের চিন্তা নেই। ক্রেডিট কার্ডের আস্কারা পেয়ে সে যেন মাত্রা ছাড়ানোতেই খুশি। তবুও হলো না ! এতো সুযোগ সুবিধা থাকতেও সে বাবার শখপূরণে অপারগ ।
একবার ইজিচেয়ারের কথাটা পেড়েছিল মায়ের কাছে। মায়ের গলায় অবজ্ঞাময় শব্দেরা এসে দ্বিধাহীন ভাবে ভিড় করেছিল
– ইজিচেয়ার !! তুই কি পাগল হয়েছিস ? বুড়োটার কথা ছাড় তো ! পাত্তা দিবি না । টাকার গাছ আছে নাকি ? যত সব ভীমরতি !!
বাবাকে নিয়ে মায়ের কথার ঝাঁজ এখন বাড়তির দিকে । যদিও ছোটবেলা থেকেই মায়ের নালিশের পাহাড় জমে আছে। বাবার অকর্মণ্যতার ভুরিভুরি উদাহরণ শুনিয়ে শুনিয়ে মা আমাদের বয়স বাড়িয়েছে । বড় করেছে কথাটা আজকাল আর প্রয়োগ করি না। বুকে বড় বাঁধে ! তবুও ইদানিং বাবার প্রতি মায়ের শব্দচয়নের ধার বাড়ন্ত। তাতে যে কোনো মানুষের মতোই বাবারও বুকে নিশ্চয়ই আচড় কাটে। বাবা তবু মুখে কিছু বলে না ! অদ্ভুত এই সংসার! বলিহারি মানুষের অভ্যাস !
বাবার রিটায়ার করার পর প্রথমে তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা থেকে গড়ানো হলো মায়ের নেকলেস । আমার বৌয়ের‌ও কপালে জুটলো একখানা লকেট সমেত হার। আমিও সুযোগ বুঝে একখানা ল্যাপটপ নিয়ে নিলাম। বোনের জুটলো মোবাইল। আমার পাঁচ বছরের ছেলের জন্য বাবা নিজে পছন্দ করে আনলো সাইকেল। বাবাই মনেহয় একটি মাত্র মানুষ যার জন্য কিছু জুটলো না। বা বলা ভালো, বাবা নিজেকে জোটালো না।
বাবাকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল
– খরচা করে কি করবো ? থাকলে তোদের‌ই কাজে লাগবে।
আশ্চর্য মানুষ এই বাবারা ! নিজের কষ্টের রোজগারে নিজের অধিকার বলে কিছু নেই ! বাবাদের যেন শখ করে কিছু কিনতে নেই। অথবা সংসারে না কেনাটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে । বাবাকে কিছু দেবার কথা ভাবতেই তাই মনেহয় নিষেধাজ্ঞার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখে মা। প্রতিবাদ করবো ভেবেও করতে পারিনি কোনদিন। সংসারে মায়ের অবদান‌ও তো কোনো অংশে কম নয় ! তবে একদিন মনে খুব আঘাত লেগেছিল। বাবার রিটায়ার হ‌ওয়ার মাস দুই হয়তো সবে পূর্ণ হয়েছে। দুপুরের ভাতের থালা মা যখন এগিয়ে দিলো বাবাকে। থালাখানা খানিকটা ছুড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে টেবিলে ঘষ্টে গিয়ে থামে বাবার সামনে। ঠিক যে ভঙ্গিতে নীচের ফ্ল্যাটে বুবাইয়ের মা তাদের পোষা কুকুর গোল্ডিকে খেতে দেয়। অদ্ভুত সাদৃশ্য পেয়েছিলাম ! আর দেখেছিলাম বাবার চোখের সেই নীরব অসহায় চাহনি। বুকটা ফালাফালা হয়ে গেছিল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। মনে হয়েছিল, পুরুষমানুষ বাড়ির সেই উপার্জনক্ষম সদস্য, যার উপার্জনের ক্ষমতা হারালেই সে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। কথাগুলো বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে মনের ভেতরে। আর চোখে ভাসছে বাবার সেই ইজিচেয়ার। বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করেওছিলাম
– একটা ইজিচেয়ার এনে দেবো বাবা ? পিঠের ব্যথার জন্য তোমার তো বিছানায় বসতে অসুবিধা হয় । ইজিচেয়ারে বেশ হেলান দিয়ে বসতে পারবে । কাগজ পড়বে। গান শুনবে।
কথাটা শুনে বাবার চোখে একটা বেশ চাপা কৌতূহল দেখেছিলাম । মুখে বলেছিল
– ইজিচেয়ার ? কোথায় পাবি ? কাঠের যা দাম এখন ! অনেকগুলো টাকা খরচ হবে। কমের মধ্যে পাবি ?
কথাতেই বুঝেছিলাম বাবার ইচ্ছে ষোলো আনার মধ্যে আঠেরো আনা।
কিন্তু মায়ের যে সায় নেই। সাত বছরের বিবাহিত বৌ রুনা আবার সোজাসুজি বলে না কিছুই। ইজিচেয়ারের কথাটা শোনা ইস্তক ইঙ্গিতবাহী কয়েকটা শব্দ খরচ করেছিল
– ইজিচেয়ার রাখবে কোথায় ? এইটুকু ফ্ল্যাটের ওই তো একফালি বারান্দা ! গাপ্পুর সামনের বছর ক্লাস টু হবে। অনেকেই বলছে বাড়িতে একটা কম্পিউটার হলে ভালো। সবকিছু বুঝে খরচা করো ।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে পলাশ। ওপরে নিজের ফ্ল্যাটে যেতে আজকাল আর ভালো লাগে না পলাশের। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই চোখ গিয়ে পড়বে বাবার ঘরে। খাটে বিছানার সাথে লেগে গেছে প্রায়। গত তিনমাস ধরে দুটো কিডনি বিকল হয়ে পড়ে আছে । অপারেশনের ধকল পরিপন্থী শরীর ও বয়স । ডাক্তার‌ জবাব দিয়েই দিয়েছেন। এখন শুধুই অপেক্ষা ! তার‌ই মাঝে পলাশ ভেবে চলে এসব। যদি মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে একটু সুখ দেওয়া যায়। কিন্তু পেরে আর ওঠে ক‌ই ! বৌ,মায়ের আপত্তি-ওজর কাটিয়েও যদি সে জোর করে এগিয়ে যায়, পথ আগলায় ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স।মাসের প্রথমেই ফ্ল্যাট আর গাড়ির ই.এম. আই মাইনেতে ভাগ বসায়। বাচ্চার স্কুল, ইলেকট্রিসিটি বিল আরো কতো কী খরচ !! নাগরিক কর্পোরেট জীবনের বাহুল্যের কি শেষ আছে ! সব দিয়েথুয়ে ব্যা‌ঙ্ক ব্যালেন্স মাসের কুড়ি তারিখের পর শূন্যে এসে ঠেকে। তারপর নেগেটিভ দিকে বাড়তে থাকে ক্রেডিট কার্ডের সৌজন্যে। সময় বয়ে যায়।
ছমাস পর আবার নারানের দোকানে গিয়ে দাঁড়ায় পলাশ। বাবা গত হয়েছে তিনমাস আগে। সাময়িক শোক কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠেছে পরিবারের সবাই। ছেলে ক্লাস টুতে পড়ছে। কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তা বাড়িতে আরো উর্ধ্বমুখী। কদিন আগেই একটা মানিব্যাক ইনসিওরেন্স পলিসির টাকা ঢুকেছে পলাশের অ্যাকাউন্টে। বেশ কয়েকদিন ধরে মানসিক দোলাচলে ছিল পলাশ। আর কানে বাজতো বাবার সেই উক্তি
“ খরচ করে কি করবো ? থাকলে তোদের‌ই কাজে লাগবে।“
এতদিনে সে একটা মধ্যস্থতা করতে পেরেছে মনের সাথে।
পকেট থেকে একগোছা টাকা বের করে নারান মিস্ত্রির দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল
– এই নাও।চোদ্দ হাজার পাঁচশো আছে। কাল রোববার আছে। সকালে বাড়িতে পালিশ করে পাঠিয়ে দিও ।
টাকাটা গুনে জামার পকেটে রেখে একটা দেঁতো হাসি দিয়ে বলল নারান
– চেয়ারখানা আপনার জন্যই বানানো ছিল। কতোবার যে দরদাম করে গেছেন !
কথাটা শুনে ইজিচেয়ারের গায়ে চোখ বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগোয় পলাশ। ইনসিওরেন্সের টাকাটা যদি কয়েক মাস আগে পেত তাহলে বাবার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করতে পারতো। বিধি বাম হলে যা হয় ! তবে এতদিনে ইজিচেয়ারটার কথা ভাবতে ভাবতে তার মনেও যেন তার বাবার ইচ্ছে চারিত হয়ে গেছে। শত হলেও সেও তো তার বাবার‌ই অংশ ! তাছাড়া পরবর্তীকালে তো বয়স্ক মা-বাবাদের‌ নিজেদের শ্রাদ্ধ-শান্তির ব্যবস্থাও মনেহয় নিজেদেরকেই করে যেতে হবে। সন্তান-সন্ততিরা সবাই তো দূরেই থাকে এখন। তাই নিজের শখপূরণের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়াই ভালো। সাথে বাবার কথাও ভুলে যায়নি। এখন সে হেঁটেই মেট্রো স্টেশন থেকে যাতায়াত করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এতে আগামী বছরের মধ্যে তার বাড়িতে একটা কম্পিউটার‌ও সে কিনে নিতে পারবে। শ্যাম ও কুল দুইই রাখতে শিখে গেছে এখন সে।
পরের দিন বিকেলে চায়ের কাপ নিয়ে ইজিচেয়ারে বসলো পলাশ। গোধূলির আলো মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।মনে মনে ভাবলো, বাবা কি দেখতে পাবে আমায় আকাশের কোনো আড়াল থেকে ? চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠলো রাঙা আলোয়। তারপর ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।
সামনে অনেক দায়িত্ব সংসারের বহন করতে হবে । তার আগেই পিঠের একটু আরাম প্রয়োজন। মেরুদণ্ডের বিশ্রাম প্রয়োজন। জীবন, সংসার এসব নিয়ে ভাবার সময় আছে বিস্তর।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।