যেভাবে একটি ফুল তার গাছের কাছে প্রশ্নহীন এবং একইসাথে উৎপ্রেক্ষায় জর্জরিত—আমি কি তেমনই স্মৃতির কাছে? স্মৃতির গহীনে? নাকি সেই স্মৃতির অন্তরালে যে নির্জনতম মানুষটি তার দিকে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছি?
আমি তাকিয়ে থাকি বা আমার তাকিয়ে থাকার মধ্যে যেভাবে আমি একটা আগুনের শিখা হয়ে উঠি; যেমনটা একটা মোমবাতির ক্ষেত্রে যা অন্ধকারের কাঁচে বর্ণের চ্ছটা।
একটা মৃত মানুষ জীবন্ত পৃথিবীতে কিছু বাষ্পীয় স্বর রেখে যায় আর সবাই কেমন জাপটে ধ’রে শোকের উচ্ছ্বাস বিলি করে।
বাবার কথা মনে পড়লে ওই মোমবাতির কাঁপতে থাকা আগুনটাকে মনে পড়ে কিন্তু কখনোই গলে যাওয়া মোমের কথা আমার মনে পড়ে না! বহু যুগ আগের ধূসর তালিকা থেকে একটি অবাঞ্চিত ছবি মাছের ঘাই হয়ে গাঢ় সবুজ জলের উপরিতলে ভেসে
ওঠে, এক খণ্ড বিধ্বস্ত আকাশের পটভূমি— বহু বহু যুগের ; একজন মঙ্গোলয়েড চেহারার মানুষ গুচ্ছ ধানের শীষ ধরে আছে তিন আঙুলের শাস্ত্রীয় মুদ্রায় ; সদ্যোজাত এক রক্তমাখা শিশু কেঁদে উঠবার আগ মুহূর্তে, বেড়ে উঠবার প্রাককালে মায়াময় তাকিয়ে সেই ভাস্করের চোখে– যে তাকে ভূমি দেবে, তার ভূমিষ্ঠ হবার একটা বহুকৌণিক রেখা অঙ্কন করবে। একজন মানুষ যে তার স্বোপার্জিত পরিচয়ের একটা পর্ব রচনা করছে, একটা চিহ্নিতকরণের আলেখ্যে মৃন্ময় হয়ে উঠছে।
আমি যখন একটা গাছের সম্মুখবর্তী সত্তা থেকে বিষাদের চিত্রকল্পে উত্তীর্ণ হই তখন বাবার কণ্ঠস্বর শুনি। আমি প্রকৃতই তখন একটা পাখির হৃদয়ের কম্পন হয়ে উঠি। এবং আমার মধ্যে অসংখ্য সময়সীমার বিস্মরণের জারন শুরু হয়। আমি যেন সত্যিই ইতিহাসের হরফ থেকে গলিত মোমের পারম্পর্যকে অস্বীকার করতে চাই! নাকি সত্যিই সেই পূর্বপুরুষের স্তব্ধ দৃষ্টির অন্তর্জালে ডুবে যাই!
যখন আমার বয়ঃসন্ধি, আমাদের বাড়িতে একটা খাঁচায় মোড়া শুক পাখি এল; আমার নির্বাক পর্বের সমারোহে একটি কলকাকলিমুখর অধ্যায় পর্যবসিত হয় বাড়িতে। আমি ভাবতুম এই সেই পাখি যা আমারই কথা ব’লে চলে অনর্গল অথচ আমি তার একটাও শব্দের আকার দিতে অক্ষম— এই হলো ইতিহাস। আর সেই পাখি যখন কিছু বলেনা তখন আমার ভেতরটা কী প্রবল কুঁকড়ে যেতে থাকে, একটা আ্যলুমিনিয়াম পাত্রের মতো দুমড়ে যেতে থাকে, দম বন্ধ হয়ে আসে ; সেই পাখি যেন শ্বাসরোধী নিভৃত হত্যাকারীর মতো আমার সমস্ত অস্তিত্বকে শেষ করে দিতে চায়। অথচ আমি যখন
সেই পাখির দিকে দৃষ্টি রাখি দেখি আসলে পাখিটির মুখ আমারই মুখ, তার শরীরটা একটা মানবিক ক্রুর উল্লাসময় আর তখন দূর থেকে ডাক ভেসে আসে- মিঠু……মিঠু…….
পুরুষ পাখির নাম মিঠু।
বাবার কথা মনে পড়েনা। এমন ভাবনা আছে ব’লেই প্রকৃত অর্থে তিনি সার্বিক ভাবে আছেন অর্থাৎ মনে পড়ে। এবং তিনি জীবন্ত হয়ে ওঠেন। শেষ পাঁচ কি ছয় বছর তাঁ্র সাথে আমার কথা হয়নি। কথা যে হতে পারতো তা আমরা দুজনেই জানতাম, তেমনই, আকথা যে হবার নয় তাও আমরা জেনে গিয়েছিলাম। তাই দুঃখবোধ থেকে ধীরে ধীরে দিনের পর দিন আমরা প্রস্তরীভূত হচ্ছিলাম। আমার বয়ঃসন্ধি জুড়ে আমি নিজেই একটা প্রেম হয়ে উঠছিলাম— যা ছিলো বস্তুর যা ছিলো কল্পনার যা বিষাদের।
মৃত মানুষের উত্তাপ কিঞ্চিৎ রয়ে যায় জীবিতের বেঁচে থাকার ওপর। একটা আগুন জ্বলে–তুষার ঝড়ের মধ্যে ফরফর শব্দে জ্বলতেই থাকে। কিন্তু তবুও নিঃশব্দ তুষার পতনের ধ্বনি তার মাংসল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে হৃদয়ের অন্তরালবর্তী স্মৃতির মায়ায়, রক্তের স্রোতে।
আমার বাবা শব্দের ওপর এক অমোঘ পার্থিব সুপ্রাচীন ধ্রুব আকর্ষন রয়ে গেছে। অথচ আমি……অথচ আমি আমার নীল কৈশোরের পুঞ্জীভূত স্নেহময় অবয়ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটা ধূমকেতুর মতো— একটা প্রাসঙ্গিক হাতের স্পর্শ থেকে শত যোজন দূরত্বে বাঁশির ঢেউ হয়ে যৌবনের প্রারম্ভিক বালিয়াড়িতে আছড়ে পড়েছি। নক্ষত্রের ক্ষতের মতো আক্ষরিক বুক নিয়ে প্রবল কৌতুকে লোনা জলে আমগ্ন নিমজ্জিত থেকেছি। আর এক দুঃসাহসিক স্বপ্নিল খাদের ধারে গিয়ে স্বর বিভাজনে খুঁজে নিতে চেয়েছি আমার সেই জন্মদাতাকে; যিনি কোটি কোষ ভেদ করে একটা জান্তব শিলার নীচে উন্মুক্ত আকাশের মতো ঘুমিয়ে আছেন। আমার বাদামী জীবনের উপত্যকা বেয়ে নামতে থাকা এক ভীত সরীসৃপের দেহে আমি দেখেছি তাঁকে। কিম্বদন্তীর মতো এক আয়াসহীন শিশির ঝরা ভোরে যার কঠিন শিরায় খোদিত হয়ে এসেছে হতাশার দীর্ঘ লিপি- সেই পিতা ; আমার বাবা ; আমাদের তোরঙ্গের ডালা অথবা বর্ষামুখর রাতের দুর্ভেদ্য শামিয়ানা। আমার স্মৃতির হলুদ অসুস্থতার ওপর যার শীতল করস্পর্শ পাবার বাসনায় দীর্ঘ দীর্ঘ অনুলিপি রাতের কোটরে একটা পোষ্যের মতো অপেক্ষমান থেকে গেছি, একটা আলাপী গাঢ় নীল অন্ধকারের গহ্বরে ফ্র্যান্সিস বেকনের নির্মম বিষাদময় চিত্রের মতো স্থির হয়ে থেকেছি।
আমার নিষ্ফল চলমানতার কুহকে ফসলের উন্মুখ যে বাসনা ; যা আমার নির্মোহ আচ্ছন্নতার আভ্যন্তরীণ উচ্ছাস— যা কর্তব্যের ধাতব মৌখিক মগ্নতা থেকে ছিটকে এসে কামনার, স্নেহের প্রিজমের মধ্যে দিয়ে বিক্ষিপ্ত হতে হতে একটা ভায়োলেট অনুশোচনাজাত অথচ চৌম্বক শরীরের অঙ্কুর ; সেই অদৃশ্য আকাঙখার ‘মনীষী’ কর্ষন করে গেছেন আমারই ভেতরে বিশাল এক ভূমি, কিংবা আমাকে একটা মৃত্তিকাকণার মহাজাগতিক প্রাণ দিয়ে গেছেন। যাতে আমি নিজেই হয়ে উঠি একটি সরল বহুকৌণিক প্রিজম কিংবা সামান্য আলোর বিন্দু— যা সূর্যের অথবা প্রতিফলনের।