• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় সঞ্জীবন হাটী

হ্যাপি ফাদার্স ডে

সাদা-কালো দৃশ্যপট। সামনে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, আকাশ মিশেছে দিগন্তরেখায়। মধ্যবয়সী অপু অপর্ণার বাড়ি থেকে ফিরে যাচ্ছে। অপুর চোখেমুখে অস্থিরতা, অপর্ণা বিয়োগের ব্যাথা এতো বছর পরেও। পেছনে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছে একরত্তি কাজল। বাবা? সে আবার কে? অপু নিজেকে ওর বন্ধু বলে পরিচয় দেয়। জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’ ছোট্ট কাজল সম্মতি জানায়। অপু আর কাজল, বাবা আর ছেলে নাকি দুই নিতান্ত ভাগ্যহীন মানুষ নিছক বন্ধুত্বই যাদের সম্পর্কের একমাত্র বল, হেঁটে চলে যায় দূরে। বিশ্বব্যাপী ছবিপ্রেমীদের কাছে এ এক খুব চেনা ছবি। অপুর সংসার-এর শেষ দৃশ্য। ভারতীয় ইতিহাসে দেখতে পাওয়া প্রথম ‘সিঙ্গেল ফাদার’, অপু, অপূর্ব কুমার রায়।
‘ফাদার্স ডে’ উদযাপন উপলক্ষে এই লেখা। ছবি বা বই-এর রেফারেন্স ছাড়াও এই লেখা হতো, সেক্ষেত্রে তার মধ্যে বৈচিত্র্য কতোটা থাকতো, সেটা নিয়ে আমার কিছুটা সংশয় আছে। কারণ মায়েদের ছবিটা যতটা সুস্পষ্ট ভাবে আমাদের চোখের সামনে বিকশিত হয়, বাবাদের ছবিটা অধিকাংশ সময়েই তা হয়না। রোজকার অফিস, বাজার, ইলেকট্রিকের বিল, বাড়ির ট্যাক্স আর খাবার টেবিলে নিত্য হাজিরার বাইরেও যে তার একটা সুবৃহৎ সামিয়ানা সর্বক্ষণ আমাদের রক্ষী রূপে বর্তমান, তা আমরা চেতনে অবচেতনে ভুলেই থাকি। তার মধ্যেও যে একটা নিস্পাপ অপত্য স্নেহ আছে, ছাদে বসে রামধনু দেখার কোমলতা আছে, দুঃখ পেয়ে কেঁদে ফেলার স্বাভাবিকতা আছে – এসব আড়াল করেই দিব্যি দিন কেটে যায় আমাদের। বহুবছর পরে, নিরালায়, তাদের অবর্তমানে কোনো অ্যালবাম বা ডাইরির পাতায় হঠাৎ খোঁজ পাওয়া যায় সেসব বাবাদের। কিন্তু ততদিনে তো বড্ড দেরী হয়ে গেছে।
ঝুম্পা লাহিড়ীর ইংরাজী উপন্যাস অবলম্বনে মীরা নায়ারের ছবি ‘দ্য নেমসেক’। উপন্যাসটারও ঐ একই নাম। গল্পের নায়ক গোগোল। প্রবাসী দম্পতি অশোক আর অসীমা-র বড় ছেলে গোগোল। একদিন বিকালে, তখন আমেরিকায় ঠাণ্ডা, ছোট্ট গোগোল বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের ধারে গেছে। পড়ে থাকা নুড়ি, পাথর বিছানো পথ বেয়ে গিয়ে পৌঁছেছে সাগরের ভেতরে একপ্রস্থ ডাঙায়। সামনে আর যাওয়ার রাস্তা নেই। অশোক হেসে বলে পুচকে গোগোলকে,
– Always remember it. Remember that you and I had made a journey and we had gone to a place where there was nowhere else to go further.
ঐ প্রবাসের সমুদ্র উপকূলে সেদিন ওদের ফিরে আসতে হয়েছিলো একই পথ ধরে। বহুবছর পরে, জীবনের অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেড়িয়ে কোনো এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় অশোক-বিহীন বাড়িতে এক পুরোনো চিঠি পড়তে পড়তে সেই কথা মনে পড়ে যায় গোগোলের। এক মন কেমন করা বিষণ্ণতা নেমে আসে ওর চোখ বেয়ে। সব অভিমান ম্লান হয়ে যায় অন্ধকারে। বাবাকে নতুন করে আবিস্কার করে গোগোল, উপলব্ধি করে যে ওর নিজের এই বর্ণাঢ্য, সুসজ্জিত জীবনবিন্যাসের বীজটা কতো সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একদিন বহন করে এনে সাদরে আমেরিকার মাটিতে বপন করে দিয়েছিলো ওর বাবা।
বাংলা সাহিত্যে এক বড়ো শ্রদ্ধার, স্নেহশীল, বড়ো হৃদয়ের বাবার ছবি ফুটে ওঠে রবি ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে। সেখানে সেই বাবা একজন সাহিত্যিক। তার মেয়ে মিনির বিয়ের দিন কত বছর পর আবার তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সেই কাবুলিওয়ালা। মিনিকে বিয়ের সাজে দেখে তার মনে পড়ে যায় নিজের মেয়ের কথা। এতোদিনে হয়তো তারও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে! মিনির বাবা নিজের জমানো টাকাপয়সা দিয়ে দেয় তাকে, যাতে দেশে ফিরে নিজের মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করতে পারে সে। এই গল্পে এক অদ্ভুত পবিত্র ছবি ফুটে ওঠে দুই বাবার মধ্যে। সেখানে মিনি কাবুলিওয়ালার কন্যাসম। আবার মিনির বাবার কাছেও কাবুলিওয়ালার কন্যা আন্তরিক স্নেহের। আমাদের এই বাংলাদেশের আর কোন দূর আফগানের দুই সমবয়সী প্রৌঢ় পুরুষ, যাদের মধ্যে দীর্ঘদিন কোনো যোগই থাকেনা, সহসা মেয়ের বিবাহ বাসরে তাদের অকস্মাৎ আলাপন কি এক প্রশস্ত পিতৃস্নেহের জন্ম দেয়, সেই স্নেহের সামনে দেশ-জাতি-ভাষার বিভিন্নতা নিতান্ত তুচ্ছ, অর্থহীন। এক অমৃতসম মানবিকতাই সেখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় সবকিছুকে ছাপিয়ে।
গত বছর মুক্তি পেয়েছিলো সোনালি বোসের ছবি ‘দ্য স্কাই ইজ পিঙ্ক’। অদিতি এবং নীরেন চৌধুরীর কন্যা আয়েশার অসুস্থতা এবং তাদের লড়াই নিয়ে এই ছবি। এখানে আয়েশার মা-বাবা যেন এক যোদ্ধা দম্পতি। মেয়ের মৃত্যুকে ঠেকানো সম্ভব নয় জেনে ওঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে প্রত্যেকটা দিন যেন আয়েশার জীবনে একটা করে উৎসব হয়। নাচ-গান-পার্টি-বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে ওঁরা চেষ্টা করেন আয়েশার জীবনের প্রতিটা দিনকে মুড়ে দিতে, ছেড়ে যাওয়ার হতাশা যেন একটা দিনও ছুঁতে না পারে ওকে। ঐ লড়াই-এর মধ্যেও ওঁরা ভেঙে পড়েন, কাঁদেন, আবার উঠে দাঁড়ান, আবার উৎসব করেন। ঐ ছবিতে বাবা একদম সৈনিকের মতন কঠিন আবার মায়ের মতনই কোমল।
ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘ফার্স্ট পার্সন’ পড়তে পড়তে আমাদের খুব চেনা বাবার ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বাবা মহাভারত পড়ে শোনাচ্ছেন, আর ছোট্ট ঋতু আর ওর বৃদ্ধা ঠাকুমা তা শুনছে। আমাদের মতন মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে ছোটোদের কাছে বাবার ছবিটা এরকমই নয় কি? আমি তখন খুব ছোট্ট, বই পড়তে ভালোবাসি। বাবা বাইরে চাকরি করে, পনেরো দিন পরপর বাড়ি আসে। প্রতিবার বাড়ি আসার সময় বাবা নিয়ে আসতো একটা করে চাঁদমামা। ট্রেন থেকে কিনে। কোনোবার না আনলে আমার সে কি কান্না! এরকমই কোনো একবার নিয়ে এসেছিলো ‘ক্ষীরের পুতুল’, তারপর ‘রাজকাহিনী’। আস্তে আস্তে পরিচয় হলো অবন ঠাকুরের সাথে। আমাদের সময়েও তো বাবারা বই কিনে আনতো, আঁকার খাতা-রং পেন্সিলও। গল্প পড়ে শোনাতো, গল্প করতো, তারপর শুরু হলো ইংরাজীতে গল্প করা, ভাষাটা শিখলাম একটু একটু করে। বাবার ক্যামেরায় প্রথম ছবি তোলা শিখলাম। তাইতো এখন ফলাও করে লিখতে পারছি। এখনকার বাবারা তো আর বই কিনে আনেনা, তার থেকে একটা ফোন বা ট্যাব এনে দেয়। বই আনলেও ইংরাজী বই, ছড়ার। আমাদের মতন রবি, অবন প্রভৃতি ঠাকুরদের সাহচর্যে থেকে বিস্ময়কর কল্পনার জগতে ঢুঁ মারার সৌভাগ্য কি তাতে সম্ভব!
ঋতুপর্ণর ‘আবহমান’ ছবিতে বাবা আর ছেলের এক নিবিড় সম্পর্ক মন ছুঁয়ে যায়। সেখানে কখনো তাদের মধ্যে চাপা অভিমান, ক্ষোভ, আবার কখনো ছেলেই বাবার অভিভাবক। কার্সিয়াং-এ কুয়াশা ঘেরা পার্কের বেঞ্চিতে বসে বৃদ্ধ অনিকেত। সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রতিম। সন্ধ্যে নেমে আসছে। বাবাকে ধরে ধরে কটেজে নিয়ে আসছে অপ্রতিম। ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছে। ভাত খাইয়ে মুখ ধুইয়ে দিচ্ছে। জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করছে ‘বীরপুরুষ’।
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চেপে
বাথরুম থেকে হেঁকে ওর ভুলটা সংশোধন করে দেয় অনিকেত।
পালকিতে মা চড়ে
তারপরেই আর অনিকেতের সাড়া নেই।
– বাবা? বাবা কি হয়েছে? – অপ্রতিম প্রশ্ন করে।
– পাজামার দড়িটা খুঁজে পাচ্ছিনা।
বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অপ্রতিমের দিকে। কি যেন এক ভূমিকা বদল!
বাবারাই তো ছেলেদের পাজামা’র দড়িটা বেঁধে দেয় চেনা ছবিতে! কিন্তু অনিকেতের তো বয়স হয়েছে। একটা সময় পর ছেলেমেয়েরাই তো অভিভাবক হয়ে যায়।
অপ্রতিম পাজামার দড়িটা ঠিক করতে থাকে।
অবাক চোখে ছেলেকে তাকিয়ে দেখে অসুস্থ অনিকেত। জিজ্ঞেস করে,
– তুমি কি আমার থেকে লম্বা?

পাহাড়ের কোলে কুয়াশা নেমে এসে আঁধার ঘনায় সেলুলয়েডে, আবহমান ভাবে।

একটা প্রশ্ন মাঝে মধ্যেই মাথা চাড়া দেয় মনের ভেতরে। বাবা মানে কি শুধুই অফিস করে, টাকা উপার্জন করে একটা আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা? তার থেকে গভীরে গিয়ে যে অন্ধ সন্তানপ্রেম, আত্মত্যাগ সেটা কি কেবলই মায়েদের? মাতৃত্ব আর পিতৃত্ব কি এতোটাই লিঙ্গভিত্তিক, এতোটাই ক্ষুদ্র? অন্তর থেকে তো তাতে সায় পাইনা। এতোটা বাহ্যিক শারীরিক বৈষম্যের ওপর তো মনুষ্যত্বকে সঁপে দেওয়া যায়না!
সুস্মিতা সেন একদিন সগৌরবে সাড়া বিশ্বের সামনে এসে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর রেনে আর আলিশাকে। কানায় কানায় উদযাপন করেছিলেন প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ। এখন তাঁর দুইকন্যাই অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে, মায়ের সঙ্গে দিব্যি জীবনকে উপভোগ করছে ওরা। ঠিক তেমনই, ক’বছর আগে এক পুত্রসন্তান দত্তক নিয়ে আমাদের দেশের প্রথম ‘সিঙ্গেল ফাদার’ হয়েছেন বাণিজ্যনগরীর প্রযুক্তিবিদ আদিত্য তিওয়ারি। সেদিন টিভির পর্দায় আদিত্য-র চোখমুখটাও উজ্জ্বল ছিলো সুস্মিতার মতন। প্রথম পিতৃত্ব-র স্বাদকে চেটেপুটে উপভোগ করছিলেন তিনি।
আমাদের বস্তাপচা ধারণাগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এক নতুন ভারতবর্ষে নিজেদের জীবন দিয়ে সব সংজ্ঞাগুলো ওলটপালট করে দিয়েছেন সুস্মিতা, আদিত্যরা।
এই যাত্রাটা এগিয়ে চলুক।
এরকমই অদম্য সাহস, লড়াই আর জীবন নিয়ে এগিয়ে চলুক আমাদের চেনা-অচেনা সব বাবারা।
Happy Father’s Day!!!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।