সাপ্তাহিক প্রকল্পশ্রীরিয়্যাল ধারাবাহিকে প্রকল্প ভট্টাচার্য (পর্ব – ৭ ।। দ্বিতীয় ভাগ)
by
·
Published
· Updated
নাম: পরিমলবাবুর পরিবারকথা
পর্ব ৭: ছেলেবেলা
(আগে যা ঘটেছেঃ নাতি প্রিয়মের খেলাধুলো হচ্ছে না, এই নিয়ে পরিমলবাবু বিশেষ উদ্বিগ্ন। তাই তিনিই নাতিকে বিকেলে খেলার জন্য মাঠে নিয়ে গেছেন। তারপর-) (পরিমলবাবু এবং প্রিয়ম বাড়ি ফেরার পর) জুঁই- আপনারা ফিরেছেন? হলো খেলাধুলো? প্রিয়ম, আগে স্নান করে পোষাক বদলে ফেলো, যাও! (প্রিয়ম ভিতরে যায়) পরিমল- খেলা আর কই হলো, শুধু ধুলোই হলো। প্রসূন- কেন বাবা, কোনো অসুবিধা হয়েছে খেলতে? পরিমল- তাহলে বলি। প্রথমে তো আমি মাঠটাকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না! তিনদিকে দোকান হয়ে গেছে, একদিকে বাড়ি উঠছে, মাঝখানে একচিলতে জমি। তারমধ্যে দোলনা, ঢেঁকিকল, স্লিপ। সেখানেই বাচ্চারা ব্যস্ত। ভীড়ে ভীড়। পরমা- ও মা, ওই দোলনা স্লিপ সব তো এই কমপ্লেক্সের ভিতরেও ছিল! তার জন্য আবার অতদূর… পরিমল– সেটাই তো! প্রীতি– ওহ কাম অন, মাঠে যাওয়ার নাম করে অ্যাট লিস্ট বাবার কিছুটা হাঁটাও হলো, অন্যদের সঙ্গে কিন্তু আড্ডাও হলো, তাই না বাবা? পরিমল– আড্ডার কথা আর বলিসনা রে! পরমা– সেকি! তোমার আড্ডা দিতেও ভালো লাগলো না! পরিমল– কী করে লাগবে! প্রথমে দেখা হলো নরেশবাবুর সঙ্গে। নরেশবাবুকে মনে আছে তো? পরমা– হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইতো ইংরিজির প্রফেসর, সবসময় মুখ গোমড়া করে থাকে… পরিমল– সে তোমায় দেখে উনি মুখ গোমড়া করেন হয়তো। আমার সঙ্গে হেসেই কথা বলেন। প্রসূন– আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। কী বললেন বলবে তো! পরিমল– উনিও দেখলাম নাতিকে নিয়ে এসেছেন। সে আর প্রিয়ম একসঙ্গে হৈ-হৈ করে স্লিপ আর দোলনায় চড়লো। প্রীতি– যাক, তাহলে ওরা কিছুটা তো খেলেছে! পরমা– সত্যি বাবা, এমন করছিলে যেন তোমরা শুধু হেঁটে হেঁটে গেলে, আর হেঁটে হেঁটে ফিরে এলে! খেলাধুলো হয়নি কিছুই! পরিমল– আরে ওকে কি আর খেলা বলে! খেলা মানে মাঠ দাপিয়ে ফুটবল, নয়তো খো-খো, কবাডি… প্রীতি– আচ্ছা, নরেশকাকু কী বললেন বাবা? পরিমল– নরেশবাবু বললেন এই একই সমস্যার কথা। নাতি মোটেই খেলাধুলো করছেনা। তার ওপর, প্রতিদিনই বিকেলে ট্যুশন যায়। জুঁই– ওঁর নাতির বয়স কতো? পরিমল– এই প্রিয়মেরই বয়সী, ছয়-সাত বছর। প্রীতি– এই বয়স থেকেই ট্যুশন!! তাও আবার প্রতিদিন! পরিমল– হ্যাঁ রে। শুনে আমারও খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু উনি বললেন… জুঁই– স্কুলে প্রচণ্ড প্রেশার, বাড়িতে গাইড করবার তেমন কেউ নেই, আজকাল যুগটাই খুব কম্পিটিশনের… পরিমল– হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক এগুলোই বললেন! প্রসূন– জুঁই কী করে জানলে? জুঁই– বললাম যে, সকলেরই এক অবস্থা। এখানে আমি তুমি আলাদা কিছু করবো কী করে! পরমা– বলো কী? সব বাচ্চাদেরই এই অবস্থা! পরিমল– তাই তো দেখলাম! খেলার জন্য মাঠও কমে যাচ্ছে, আর সময়ও থাকছে না। সারাদিনের মধ্যে আমাদের সবথেকে প্রিয় সময় ছিল বিকেলবেলা, তো প্রজেক্ট ওয়ার্ক আর অ্যাসাইনমেন্টের চাপে সেই বিকেলবেলাটাই হারিয়ে যাচ্ছে ছোটদের জীবন থেকে! প্রসূন– সেদিন অফিসে আমার এক কলিগের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। উনি তো বলেই দিলেন, উনি চান ওঁর ছেলে অলরাউণ্ডার হোক, তাই গানের ক্লাস, দাবা খেলার ক্লাস, ক্রিকেট কোচিং, সবকিছুতে ঢুকিয়েছেন। প্রীতি– তো ছেলেটা কি মুটিয়ে পুরো গোল, মানে অল রাউণ্ড হয়ে গেছে? প্রসূন– সেইরকমই অবস্থা! জুঁই– তোমরা তো হেসেই খালাস, এদিকে মায়েদের অবস্থাটা ভাবো। বুঝতে পারছি কী হতে চলেছে কিন্তু আটকাতে পারছি না!! পরিমল– সত্যজিত রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দী’ সিনেমাটা দেখেছ? পরমা– তুমি আবার এর মধ্যে সিনেমা আনলে কেন! পরিমল– আহা শোনোই না! কারণ আছে। ওই সিনেমায় একটা ডায়ালগ ছিল এই রকম। নায়ক তার এক বন্ধুকে বলছে, “তুই বড্ড নীচে নেমে গেছিস!” জবাবে বন্ধু বলছে, “উপায় কী! গোটা দুনিয়া যদি নীচে নেমে যায়, তো আমি কি ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকবো!” পরমা– তোমার কোনোদিন কি আক্কেল হবে না? জুঁইয়ের কথা শুনে তোমার এই ডায়ালগটা মনে পড়লো? প্রসূন– মা, বাবা কিন্তু ঠিকই বলেছে। সত্যিই অসহায় হয়ে আমাদের পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারি কি? প্রীতি– সাউণ্ডস সো স্যাড! প্রসূন– স্যাড তো বটেই! ইনফ্রাস্ট্রাকচর নেই, খেলার সময় নেই, এই অবস্থায় জোর করে ‘খেলতে যা’ বললে কোন ছেলেটা খেলতে শিখবেই বা! পরমা– কিন্তু এই যে এত ক্রিকেটার, ফুটবলার সব বেরোচ্ছে তো নতুন নতুন! প্রীতি– মা, কিন্তু বাংলা থেকে কই আর তেমন! অন্য স্টেটে তবু… জুঁই– আচ্ছা মা, এই যে আপনার ছেলে প্রিয়মের খেলাধুলো নিয়ে এত চিন্তিত, প্রিয়ম যদি আজ বলে যে ও বড়ো হয়ে ফুটবলার হবে, শুধু সেই খেলাই অভ্যাস করবে, তাহলে কি আপনার ছেলে রাজী হবে? জিগ্যেস করে দেখুন তো! প্রসূন- যাব্বাবা, তা আবার হয় নাকি! শুধু ফুটবল খেললে কি চলবে? জুঁই- এই। এটাই আসল কথা। আমাদের মতো বাবা-মায়েদেরই এই ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ড। আমরা চাই দ্য বেস্ট অফ বোথ ওয়ার্ল্ডস… ছেলে পড়াশোনাতে মেঘনাদ সাহা, ফুটবেল মারাদোনা, ক্রিকেটে শচিন! প্রসূন- ওয়াও, তুমি মারাদোনার নাম জানো! প্রীতি- দাদা, জোক্স অ্যাপার্ট, বৌদির কথাটা কিন্তু ঠিক। প্রেশারটা বাবা মা-ই দিচ্ছে। জুঁই– হ্যাঁ, স্বীকার করছি তো! প্রেশার দিতে বাধ্য হচ্ছি! পরমা– নিজেদের না মেটা ইচ্ছাগুলো ছেলেমেয়েদের ওপর না চাপালেই এই সমস্যা হয় না। প্রসূন– কিছুটা ঠিক বলেছ মা। কিন্তু একটা লক্ষ্য স্থির না করে দিলে ওরা সাক্সেসফুলি বড় হবে কী করে! পরিমল– এই কথাটাই সব নষ্টের গোড়া। সাক্সেস!! আরে, সাক্সেসের মাপকাঠি কী, কেউ বলতে পারিস? যারা অনেক টাকা কামায়, তারা বলে বেড়ায় টাকা কামানোটাই সাক্সেস। পরমা– তুমি কোনোদিন সেটা বলতেই পারবে না। পরিমল– পারবো না তো! আর আমি আবার আমার জীবনকেই সাক্সেস বলি। এই যে আমি রিটায়ার করেও গোটা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাই, একসাথে হাসি আড্ডা বেড়ানো খাওয়াদাওয়া, এটাই আজকাল খুব দুর্লভ! সকলে যে যার জগতে এমনই ব্যস্ত, যে পরিবার বলে কিছু আর তারা জানতেই পারছে না। তাদের দেখেই পরের প্রজন্ম শিখছে। আজকাল কটা ছেলেমেয়েই বা তাদের ঠাকুর্দা-ঠাকুমাকে কাছে পায়! তো আমি কেন নিজেকে সাক্সেসফুল বলব না, বলতে পারো? প্রীতি– বাবা, এই যে তোমার পজিটিভ আউটলুক, এটার জন্যই তোমাকে আমরা সবাই এত রেস্পেক্ট করি! জুঁই– প্রীতি ঠিক বলেছে বাবা। এইভাবে ভাবাটা খুব কঠিন। প্রসূন– আচ্ছা, আমরা কিন্তু এখনো প্রিয়মকে জিগ্যেস করিনি যে ও কেমন এঞ্জয় করলো। পরমা– সত্যি। ওঁকে জিগ্যেস করা হয়নি তো! বাবা প্রিয়ম! প্রিয়ম– হ্যাঁ দিদু, এই যে আমি! পরমা– আজ তুমি খেলতে পারোনি? প্রিয়ম– নাতো! খুব খেলেছি! নতুন একটা বন্ধুও হয়েছে, তার সঙ্গে… প্রসূন– সেকি! খেলেছিস? কী খেললি, স্লিপ আর দোলনা চড়া? প্রিয়ম– না বাবা, ফুটবল খেলছিলাম আমরা অনেকক্ষণ। আমি জিতেছি, ৪-৩! জুঁই– ফুটবল খেলেছিস? কোথায়! প্রিয়ম– কেন, ওই মাঠে, দাদু নিয়ে গেল! পরমা– দাদু যে বলল মাঠে খেলার জায়গাই নেই? প্রিয়ম– বেশী জায়গা নেই, তবে ফুটবল খেলার মত জায়গা ছিল। পরিমল– কী সব বলছিস রে! কোথায়, কখন আবার ফুটবল খেললি তোরা! প্রসূন– তাও আবার ৪-৩ রেজাল্ট! প্রিয়ম– কেন দাদু, ওই বন্ধুটা তো তার বাবার মোবাইল ফোনটা এনেছিল, তার মধ্যেই একটা ফুটবল গেম ছিল। আমরা একটা বেঞ্চে বসে খেলছিলাম তো, দেখোনি তুমি!! পরিমল– হাঃ হাঃ হাঃ!! পরমা– হায় পোড়া কপাল আমার! শেষে সেই আবার মোবাইল গেম!!