প্রদীপ্ত গুপ্তর প্রবন্ধ

জন্ম কলকাতায় - এক বসন্তের দিনে ; বাংলাদেশের বরিশাল থেকে দেশভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে ভারতে চলে আসা এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বেড়ে ওঠা দক্ষিণ কলকাতার গার্ডেনরীচ অঞ্চলের এক ভাড়া বাড়িতে, আরও চারটি পরিবারের সাথে। স্কুল থেকে সায়েন্স নিয়ে পাশ করার পর টেকনো ইন্ডিয়া থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক । একটি প্রাইভেট এম.এন.সি-তে বছর দেড়েক চাকরি করছেন এবং বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনা করছেন। ছোটো থেকেই আর্টের প্রতি একটা টান অনুভব করেন। অনেকগুলো বছর ছবি এঁকেছেন। সেই টান থেকেই লিখতে আসা। তবে লেখালেখি ভালোবেসেই, এর সাথে কোনো স্বার্থ বা প্রত্যাশা জড়িয়ে নেই বলেই লেখকের অভিমত।

বৈজ্ঞানিক যখন মিশরতত্ত্ববিদ

একটা অস্বচ্ছ প্রতিবন্ধকের উপর  পরস্পর সমান্তরাল ও খুব সরু দুটি রেখাছিদ্র আছে। রেখাছিদ্র দুটি একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। প্রতিবন্ধকটিকে একটি একবর্ণী আলোক উৎসের সামনে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যেন রেখাছিদ্র দুটি আলোক উৎস থেকে সুনির্দিষ্ট দূরত্বে থাকে। এখন আলোর উৎস যেহেতু একটিই, তাই উৎস থেকে নির্গত আলো প্রতিবন্ধকের উপরের দুটি ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে ছিদ্র দুটি থেকে নির্গত আলোকরশ্মির মধ্যে দশা সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ রেখাছিদ্র দুটি সুসংগত গৌণ উৎস হিসেবে আচরণ করে। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগারটি যথেষ্ট অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলে প্রতিবন্ধকের সামনে রাখা একটি পর্দার উপর পর্যায়ক্রমে উজ্জ্বল রেখা ও অন্ধকার রেখার (যেখানে শক্তি বিনষ্ট হচ্ছে) একটি সুস্পষ্ট সমান্তরাল ঝালর দেখতে পাওয়া যাবে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় একে ব্যতিচার (Interference) ঝালর বলে।
এই ঝালরখানা দেখতে বড়ো সুন্দর হয় ! পরপর উজ্জ্বল ও অন্ধকার রেখা বসে বেশ একটা সুন্দর দ্বিমাত্রিক সজ্জা গঠন করে। যে পর্দায় এই সজ্জা গঠিত হয় সেটিকে একটু গভীরতা দিলে মনে হবে একটা কয়েদিহীন ফাঁকা জেলখানা – যার দেওয়ালটা সাদা রঙ করা, আর সামনে লোহার কালো কালো দন্ড। সাদা দেওয়ালটাতে মিশরের থীবস্ থেকে পাওয়া একটি মমির আবরণের উৎকীর্ণলিপি কালো রঙের কালিতে ফুটে উঠছে যেন! আগ্রহ জাগছে মনে, কিন্তু দেওয়ালের কাছে পৌঁছে লিপির পাঠোদ্ধার করতে হলে আগে সামনের লোহার কালো দন্ডের প্রতিরোধ ভাঙতেই হবে।
এইভাবে হয়তো কেউ কখনো ভাবেনি ; কিন্তু বৈজ্ঞানিক টমাস ইয়ং প্রথম সেই অবরোধ-প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে এক দুর্বোধ্য, জটিল, রহস্যময় লিপির পাঠোদ্ধারে আলো ফেলেছিলেন। লিপির নাম হিয়ারোগ্লিফিক। ১৭৭৩ এর ১৩ ই জুন ইংল্যান্ডের সমারসেটসায়ারের মিলভারটনে টমাস ইয়ং জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দুই বছর বয়সেই তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারতেন। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ বাইবেল দু’বার পড়ে ফেলেন। সাত-সাতটি প্রাচীন ভাষায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময়ে মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি ভার্জিল, হোরেস ও অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যিকদের রচনা, সম্পূর্ণ গ্রিক ও ল্যাটিন টেষ্টামেন্ট, ইলিয়াডের প্রথম সাতটি খন্ড, প্রাকৃতিক দর্শন প্রভৃতি বিষয় পড়ে ফেলেন। এক‌ই সময়ে তিনি হিব্রু বাইবেলের ছয়টি অধ্যায় আয়ত্ত করে ফেলেন।
লেদের প্রযুক্তি, টেলিস্কোপ ও মাইক্রোস্কোপ তৈরি থেকে শুরু করে লন্ডন ও এডিনবার্গে ঔষধ ও শারীরবিদ্যা শিক্ষা, এফ.আর.এস ডিগ্রি অর্জন- এ সব‌ই তাঁর কীর্তি। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে তিনি পদার্থবিদ্যায় আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। শুরুতে যে ব্যতিচার ঝালর সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা ইয়ং-এর দ্বিরেখাছিদ্র পরীক্ষা (Double slit experiment) নামে পরিচিত।
হিয়ারোগ্লিফিকের পাঠোদ্ধারে ড: টমাস ইয়ং-এর অবদান অপরিসীম। রসেটা পাথরে মোট তিনটি ভাষা উৎকীর্ণ ছিল – হিয়ারোগ্লিফিক, ডেমোটিক ও গ্রিক, যার পাঠোদ্ধার প্রক্রিয়া ১৮১৪ পর্যন্ত প্রায় অন্ধকারে‌ই ছিল। ইয়ং প্রথম রসেটা পাথরের ডেমোটিক অংশের অনুবাদ তৈরি করেন। তিনি সর্বপ্রথম সিদ্ধান্তে আসেন যে, মিশরীয়রা তাদের পাঠ্যে বর্ণগত ও অবর্ণগত চিহ্ন ব্যবহার করতো। ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবিষ্কার করলেন, ডেমোটিক ও হিয়ারোগ্লিফিক পদ্ধতি নিবিড়ভাবে যুক্ত এবং ডেমোটিক ভাষা ছিয়াশিটি শব্দদলে বিভক্ত। টলেমীর স্ত্রী বেরেনিস ও অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও তৃতীয় খুটমেস-এর কার্তুজ থেকে খোদিত নাম শনাক্তকরণ এবং ইংরেজি ‘F’, ‘T’ ও মৃত্যুত্তীর্ণ প্যাপিরাস থেকে সমধ্বনির ধারণা তাঁরই মহামূল্যবান কীর্তি। এই পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়ে‌‌ই পরবর্তীকালে জঁ ফ্র্যান্সোয়া শাপোলিয়ঁ-র  হিয়ারোগ্লিফিকের পাঠোদ্ধারের কাজ অনেকাংশে সহজ হয়েছে।
ড: ইয়ং আরও তিনটি ব্যাঞ্জনবর্ণের মূল্যায়ন করেন। হিয়ারোগ্লিফিকের ধ্বনি অনুযায়ী পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও আবশ্যিকতা তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন। ঐতিহাসিক ওয়ালিশ বাজের মতে, ড: টমাস ইয়ং হিয়ারোগ্লিফিকের পাঠোদ্ধারের পথিকৃৎ, এ সম্মান তাঁরই প্রাপ্য। বৈজ্ঞানিক ইয়ং মিশর সম্বন্ধীয় মোট ষোলোটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে ১৮১৫ এ প্রকাশিত “রিমার্কস্ অন্ ইজিপশিয়ান প্যাপিরাই অ্যান্ড অন্ দ্য ইনস্ক্রিপশন্ অব্ রসেটা” উল্লেখযোগ্য। এরপর তিনি রসেটার পাঠোদ্ধারে আর অগ্রসর হননি। হিয়ারোগ্লিফিক বর্ণের পাঠোদ্ধার সম্বন্ধে ব্রিটানিকা বিশ্বকোষে তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখে গেছেন।
১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ই মে লন্ডনে মহান বৈজ্ঞানিক, মিশরতত্ত্ববিদ, সাহিত্যপ্রেমি ড: টমাস ইয়ং-এর মৃত্যু হয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ড: ইয়ং-এর কথা পড়লে জানা যায় যে, পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা অবশ্যই বহুমাত্রিক।
তথ্য ঋণ : শ্যামলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের লেখা গ্রন্থ “প্রাচীন মিশর”।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।