প্রবন্ধে উত্তম দত্ত

কাদিস : এলেন গিন্সবার্গের কাব্যিক প্রণাম : মা নাওমিকে 

O mother
farewell
with a long black shoe
farewell
with Communist Party and a broken stocking
farewell
with six dark hairs on the wen of your breast
farewell
with your old dress and a long black beard around the vagina
মৃত মাকে প্রণাম জানিয়ে লেখা এই কবিতা । ছেলে সেই বাউন্ডুলে কবি এলেন গিন্সবার্গ। কিছুকাল আগেই তাঁর বিপুল সাড়া জাগানো কবিতার বই ‘হাউল’ বেরিয়ে গেছে । অশ্লীলতার অভিযোগে সানফ্রানসিসকোতে নিষিদ্ধ হয়েছে সে বই। তাতে অবশ্য বিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ। আর রাতারাতি জনপ্রিয় এই প্রথাবিরোধী কবি আমেরিকার বাইরে বিভিন্ন সভায় নিজের কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন প্রিয় শ্রোতাদের। সমকামী এই কবি তখন পিটার অর্লোভস্কির প্রেমে মগ্ন হয়ে আছেন । দাদা ইউজিনের সঙ্গে কিংবা মানসিক রোগের হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে শায়িত মা নাওমির সঙ্গে তাঁর  কোনও ঘনিষ্ঠ সংযোগসূত্র নেই । মায়ের কাছে তিনি  শুধু পাঠিয়ে দিয়েছিলেন  হাউলের একটি কপি।
একদিন অত্যন্ত অবহেলার মধ্যে মারা যান প্যারানইয়ায় আক্রান্ত নাওমি, যিনি একদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কম্যুনিষ্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন । দুই শিশুকে নিয়ে তিনি প্রায়ই উপস্থিত হতেন পার্টি অফিসে। রাতে বিছানায় শুয়ে বাচ্চাদের গল্প শোনাতেন , রাজার চাবুক কীভাবে রাস্তার পাশের নিরীহ শ্রমিকদের শরীর রক্তাক্ত করে দেয়। এসবেরই হয়ত প্রভাব পড়েছিল শিশু এলেনের মনে । ভিয়েতনাম-যুদ্ধের সময় এলেনের তীব্র আমেরিকা-বিরোধী মনোভাবের পেছনে হয়ত শৈশবে শোনা মায়ের মুখের সেই গল্পগুলোই অবচেতন থেকে বেরিয়ে এসেছিল আরও বলিষ্ঠভাবে ।
১৯৫৬ র জুন মাসের গোড়ার দিকে নাওমি মারা যান  । ছেলে এলেনের কাছে সে খবর পৌঁছোয় না । ইহুদীদের মধ্যে একটা পারলৌকিক সংস্কার আছে । অন্তত দশ জন পুরুষ মৃত ব্যক্তির জন্য প্রার্থনা করবেন । দশজনের কম হলে সে প্রার্থনা গ্রাহ্য ও ফলবতী হবে না । অনেক দিন পর এলেন গিন্সবার্গ খবর পেলেন তাঁর মায়ের শেষকৃত্যে দশ জন লোকও আসে নি । এতে চরম মর্মাহত হন তিনি। বিবেক-দংশনে পুড়ে যেতে থাকেন এক একা । এক বন্ধুকে জানান সেকথা । সেই বন্ধু  তার লাইব্রেরী থেকে প্রার্থনা-মন্ত্র  ‘কাদিসে’র একটি কপি বের করে দুজনে মিলে পাঠ করেন । কিন্তু তাতেও পুত্র এলেনের অশান্ত মন শান্তি খুঁজে পায় না ।
এর পরেই তিনি লিখতে শুরু করেন তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা Kaddish . এই হল মৃত মায়ের উদ্দেশ্যে শোকার্ত পুত্রের প্রার্থনা । এই কবিতায় মা নাওমি আর তাঁর সমকালীন দেশ কাল মানুষ ও বিপ্লব একাকার হয়ে গেছে । সুদীর্ঘ এই কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক বিস্মিত হয়ে দেখেন মা নাওমির স্তনের জড়ুল , তার উপরে গজিয়ে ওঠা ছ টি কালো চুল , মায়ের যৌনরোম , ছেঁড়া মোজা , শীর্ণ আঙুল , কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতি নিবেদিত সত্তা সমস্তই কেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে এসেছে –
with your eyes of Russia
with your eyes of no money
with your eyes of false China
with your eyes of Aunt Elanor
with your eyes of starving India
with your eyes pissing in the park
with your eyes of America taking a fall
with your eyes of your failure at the piano
with your eyes of your relatives in California…..
প্রায় দু বছর সময় লেগেছিল এ কবিতা লিখতে । কাদিস জনপ্রিয়তায় এবং আন্তরিক ঐশ্বর্যে হাউলকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল । এ কবিতা লেখার নেপথ্যে আর একটা আশ্চর্য ও গোপন কারণ ছিল । সেটা বলি । হাউল পাঠ করে মা কী ভেবেছিলেন সেকথা একটি চিঠিতে তিনি ছেলেকে লিখে যান । মায়ের মৃত্যুর পর সে চিঠি ছেলের হাতে আসে । তাতে মা পুত্র এলেনকে লিখেছিলেন : ‘জানালার কাছে রোদ এসে পড়েছে । ঐখানে উজ্জ্বল হলুদ আলোর মধ্যে একটা চাবি আছে । সেই অলৌকিক চাবি দিয়ে লৌকিক জীবনের সব বন্ধ দরজা খোলা যায় । …… বিয়ে করো এলেন , ড্রাগ নিও না আর কখনো । স্বাভাবিক সুন্দর সুস্থ জীবনে ফিরে এস । ( উফ , এ চিঠি পড়ে মনে হয় , এমন মাকে পাগল আর অসুস্থ বলে কোন আহাম্মক চিকিত্‍সক?)
আর পাঁচজন মানুষের মত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয় নি তাঁর কখনো। একের পর এক পুরুষ যৌনসঙ্গী বদলেছেন তিনি । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘অর্ধেক জীবনে’ উল্লেখ করেছেন : বন্ধু এলেন তাঁকেও একবার যৌনসঙ্গী হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন । নানা নেশায় আচ্ছন্ন হয়েছেন । কলকাতায় এসে এ বঙ্গে ও বহির্বঙ্গের বিভিন্ন শ্মশানে খোলা আকাশের নিচে তরুণ কবিদের নিয়ে রাত্রিবাস করেছেন , ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর রোডের অসহায় উদ্বাস্তুদের জন্য কাজ করেছেন , তাদের দুঃখ কষ্ট ক্ষুধা ও কান্না নিয়ে গান বেঁধেছেন। সে গানের আর্থিক মূল্য তুলে দেওয়া হয়েছে ওই অসহায় মানুষগুলোর জন্য। সারা জীবন নির্ভয়ে লড়াই করেছেন মানবাধিকারের সপক্ষে । নিজের আপাত উদ্ভট জীবন যাপন দিয়ে তথাকথিত ভদ্রলোকের জীবনকে সপাটে লাথি মেরেছেন বারবার । কিন্তু মায়ের ওই চিঠি এমন বাউন্ডুলে ছেলেকেও ভিত শুদ্ধ নাড়িয়ে দিয়েছিল । তা না হলে এমন মর্ম তোলপাড় করা শোকগাথা লেখাই হত না —–
Caw caw caw crows shriek in the white sun over grave stones in Long Island
Lord Lord Lord Naomi underneath this grass my halflife and my own as hers
caw caw my eye be buried in the same Ground where I stand in Angel
Lord Lord great Eye that stares on All and moves in a black cloud
সমাধি-ফলকের উপরে দুপুরের সাদা রোদ এসে পড়েছে । ক্রমাগত কাক ডাকছে । মা শায়িত আছেন মাটির নিচে । প্রকৃতি ও পাখির শব্দে তিনি কথা বলছেন , বেঁচে আছেন তিনি —
Caw caw the call of Time rent out of foot and wing an instant in the universe
Lord Lord an echo in the sky the wind through ragged leaves the roar of memory…….
( Kaddish
By Allen Ginsberg
For Naomi Ginsberg, 1894—1956)
পাঁচটি স্তবকে বিন্যস্ত এই এলিজি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে ।
(এলেনের জন্ম ৩ জুন ১৯২৬ । মারা যান ৫ এপ্রিল ১৯৯৭)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।