“তোকে প্রথম যখন দেখেছিলাম, আমি ভেবেছিলাম তুই হিন্দু”
“হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা”
“ক্যানো রে, হিন্দু -মুসলিম সবাই তো মানুষ”
উহুঁ, কোনো ফিল্মি ডায়লগ নয়। আর নীচের ছবিটিও কোনো ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা নয়।
ওরা এভাবেই বসেছিল, এক থালায় ছজনের যুগলবন্দী। সবার পেটে খিদে।
আমার স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার তালিকায় আজ সবচেয়ে কুচোদের পরীক্ষা শেষ হলো। অন্যদিন দেখি মুখ বুজে সব বাড়ি ছোটে। পিছনে পরের দিনের পরীক্ষার তাড়া। আজকের ব্যাপার আলাদা। সাথে যদি থাকে গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি আর আলুভাজা। সে এক অমৃতময় মুহূর্ত। নিজস্ব পরস্ব বোধ একাকার হয় সেই বাসে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা থালা যে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু অভিজ্ঞ সন্দেহপ্রবণ মনে বিশ্বাসযোগ্য হবেনা এসব। আমরা যখন বড্ড বড় হয়ে যাই তখন বড় বেশি সাবধানী আমরা।
স্বপ্ন, কল্পনার জগতে বিচরণ করতে গেলে দিব্যদৃষ্টি সাথে অতীন্দ্রিয় শ্রবণ শক্তিও চাই। আমার তা নেই বলেই মনে করি। তবুও মাঝে মাঝে স্কুল যাতায়াতের পথে গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেলে মনে মনে জাতীয় বিজাতীয় সব স্রষ্টাকুলকে জোড়হাতে স্মরণ করি।
কে না জানে “ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম, / সবকো সৎমতি দে ভগবান।”
ঈশ্বরের প্রেরিত দূতেরা বলেই গেছেন
“যিনি রাম, তিনিই রহিম” কিন্তু ভগবান আমার মতো পাপী তাপীদের চোখে ধরা দেননা! তেনাদের বাহন বা স্ট্যাম্পমারা ভক্তদের পাঠিয়ে দেন।
একজন মাতব্বর হনুমান ছিলেন মূল বক্তা।
“বন্ধুগণ! কোনো বাইরের প্ররোচনায় নিজেদের ইউনিটি নষ্ট করবেন না। আমরা সেই আদিম অভ্যেসে সঙ্ঘবদ্ধ। দলবদ্ধতাই আমাদের শক্তি। এই জোট ভাঙতে দেবেন না”
“কিন্তু নিজেদের মূল খুঁজে বের করাটাও জরুরী” এক উত্তেজিত যুবকের বক্তব্য
“মূল আবার কি খুঁজবে! আমরা মানুষের পূর্বপুরুষ! মানুষের জন্ম দেখলাম! এখন এদের কথায় লেজ হেলিয়ে দৌড়াতে হবে! এই নাকি তোমরা বীর হনুমান! ” রাগত উক্তি মূল বক্তার।
“ওসব উসকানিতে না গিয়ে, দেখে এস আজকের দিনেও কেমন এক থালায় বসে জাত বিজাতকে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে মানুষের বাচ্চারা খাবার খায়! এ অতি আশ্চর্য দৃশ্য। ” স্মিতমুখে এক তরুনের দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
“এখন ওদের বিড়ালজন্ম! তাই এসব করতে পারছে। এরপর ঘোড়া জন্ম পেরোতেই বলদজীবন শুরু হবে! তখন পালে পালে একদিকেই ছুটবে। মানুষের কথা ছাড়ো! “
“হ্যাঁ ভাই মনে রেখো আমাদের একটাই জন্ম। হনুজন্ম! একটাই থালা। এস ভাগাভাগি করে খিদে মেটাই। ওটাই তো আসল কিনা!”
এতবড় বিভেদ সমস্যার অনায়াস সমাধান করে শিষ্যদল একবার জুলজুলে চোখে আমাকে মেপে নিয়ে দল বেঁধে সরে পড়লেন।
পিছন থেকে দু তিনটে গাড়ির হর্ণে চটক ভাঙলো। তার দুএকদিনের মধ্যেই কর্মক্ষেত্রে এই দৃশ্য এবং কথোপকথন।
এই দৃশ্য আমাকে নিজের ইউনিভার্সিটি বেলায় ফিরিয়ে নিয়ে গ্যালো। গোলাপবাগের ছায়াবিছানো পথ ধরে পরিখার পাশে পাশে হেঁটে গেলে ছোট্ট একটা কাঠের পুল। পুল পেরিয়েই তারাবাগ। প্রফেসরদের কোয়ার্টার পিছনে
রেখে লেডিস হস্টেল শুরু।
ডানদিকে মোড় ফিরে নিবেদিতা
বাঁদিকে সরোজিনী, নিবেদিতার সোজাসুজি মীরাবাঈ।
নিবেদিতা হোস্টেলের দোতলার ২০ নম্বর ঘর। অচেনা পরিবেশে থাকতে গিয়ে প্রথম রাত্রে যে মেয়েটা প্রায় কেঁদে ফেলেছিলো, বছর ঘুরতে না ঘুরতে এখান থেকে বাড়ি যেতে তার আর মন ওঠে না। শনিবার বিকেলের দানাপুর ট্রেন ধরার নিত্য নৈমিত্তিক রুটিন ভুলে সে তখন রবিবারের জমাটি হস্টেল আড্ডায় জমে গেছে।
সবচেয়ে লোভনীয় রবিবারের দুপুরগুলি। ঐ একটাই দিন চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার। সক্কাল সাড়ে নটার থেকে দশটার মধ্যে পেটে সোয়াবিনের ঝাল নয়তো কুমড়োর ঘ্যাঁট ভাতসহ ২০% পেটে আর ৮০% ডাস্টবিনে ফেলে দিলে যা হওয়ার তা হবেই।