প্রবন্ধে মানস চক্রবর্ত্তী

সত্যবাদিনী

সত্যনিষ্ঠ মায়ের সন্তান কখনো ব্যর্থ মনোস্কাম হতে পারে না | ছান্দোগ্য উপনিষদের সত্যকাম জাবাল তার জলজ্যান্ত প্রমাণ | সত্যকাম নামে এক তরুণ ব্রহ্মচর্য নিয়ে গুরুগৃহে বাসপূর্বক বেদাধ্যয়ন করতে চায় | এখন যেমন আমাদের স্কুলে ভর্তি হতে হলে বার্থ সার্টিফিকেট লাগে , সেইরূপ ঋষিগুরুর কাছে নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় ব্যক্ত করতে হতো | অনেক সময় পিতা বা পিতামহের নাম সংযুক্ত করে পরিচয় প্রদান করা হতো | যেমন উদ্দালক আরুণি , উপকোসল কামলায়ন | আবার কখনো গোত্র লিখেও পরিচয় দেওয়া হতো | যেমন জিতেন্দ্র বশিষ্ঠ , রামসেবক কাশ্যপ ইত্যাদি |
সত্যকামের পিতৃপরিচয় জানা ছিল না , তাই মায়ের কাছে গিয়ে পিতৃপরিচয় জানতে চাইল – ‘ পূজনীয়া মা , আমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে বাস করতে চাই | আমার গোত্র কী ? ‘ মাতা জবালা এতটুকু সত্য গোপন করার চেষ্টা করলেন না | একবার ভাবলেন না , পুত্রের কাছে তার মানের সমভাব থাকবে কিনা ? স্পষ্ট ভাবেই বললেন , ‘ তোমার গোত্র আমি জানি না | ‘ কারণটা জানাতেও কোনো দ্বিধা করলেন না – ” বহ্বহং চরন্তী পরিচারিণী যৌবনে ত্বামলভে সাহহমেতন্ন বেদ যদগোত্রস্ত্বমসি ……” ১ যৌবনে আমি বহুলোকের পরিচর্চায় ব্যস্ত থেকে তোমাকে লাভ করেছি | এইজন্য তুমি কোন গোত্রীয় তা আমি জানি না | রবীন্দ্রনাথ ‘ চিত্রা ‘ কাব্যগ্রন্থের ব্রাহ্মণ কবিতায় বড়ো সুন্দর তার কাব্যিক রূপ দিলেন –
” কহিলা জননী যৌবনে দারিদ্যদুখে
বহু পরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে ;
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে ;
গোত্র তব নাহি জানি তাত ! ” ২
তবে যদি কেউ তোমার পরিচয় জানতে চায় তুমি বলবে , তুমি সত্যকাম জাবাল | মাতৃপরিচয় দিয়ে দিলেন | সত্যের কোনোরূপ বিকার আসতে দিলেন না |
পুত্র প্রসন্ন মনে ঋষি গৌতমের সমীপে উপস্থিত হলো | বললেন , ” আমি আপনার নিকট ব্রহ্মচর্য অবলম্বন পূর্বক বাস করব | তাই আমি আপনার শিষ্য হতে ইচ্ছে করি | ” ঋষি গৌতম প্রথামাপিক গৌত্র জিজ্ঞাসা করলেন – ” কিং গোত্রা ? ” তুমি কোন গোত্রীয় ? সত্যকাম মায়ের কাছে যা জেনেছিলেন হুবহু তাই বললেন | মাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম | তিনি আমাকে বলেছিলেন , ” যৌবনে বহু লোকের পরিচর্যায় ব্যস্ত থেকে তোমাকে পেয়েছি | তাই তোমার গোত্র আমি জানি না | আমার নাম জবাল ও তোমার নাম সত্যকাম | সুতরাং তুমি সত্যকাম জাবাল | ” গৌতমের অপর শিষ্যসকল সত্যকামের পরিচয় পরিচয় পেয়ে বক্রচোখে তাকালেন | রবীন্দ্রনাথ লিখলেন –
” শুনি সে বারতা
ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিল কথা ,
মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল
পতঙ্গের মতো | সবে বিস্ময়বিকল ;
কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার
লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার | ” ৩
কিন্তু আচার্য গৌতম মন দিয়ে সব শুনলেন এবং বললেন – ” ….সোম্যাহরোপ ত্বা নেষ্যে ন সত্যাদগা ইতি তমুপনীয়…..” ৪ হে সোম্য , সমিধ ( যজ্ঞ কাঠ ) নিয়ে এস | আমি তোমাকে উপনিত করব | কারণ তুমি সত্যের অপলাপ ঘটাও নি | – ” তং হোবাচ নৈতদ ব্রাহ্মণো বিবক্তুমর্হতি …” ৫ ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ এভাবে অকপট সত্য বলতে পারে না |
” অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত ,
তুমি দ্বিজোত্তম , তুমি সত্যকুলজাত | ” ৬
জবাল সত্যবাদিনী বলেই সত্যকাম এই নিষ্ঠুর সত্যটা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে পেরেছে | এরজন্য তেজের দরকার | তেজ হল দৈবী সম্পদ | – ” তেজ: ক্ষমা ধৃতি: শৌচমদ্রোহো নাতিমানিতা | / ভবন্তি সম্পদং দৈবীমভিজাতস্য ভারত | ” ৭ নিঃসন্দেহে আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে সত্যকাম এইরূপ সত্য বলার তেজ লাভ করেছে তাঁর মা সত্যবাদিনী বলে |
————————————————————
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
(১)ছান্দোগ্য উপনিষদ , ৪র্থ অধ্যায় , ৪র্থ খণ্ড
(২)সঞ্চয়িতা (৩) ঐ | (৪)ছান্দোগ্য উপনিষদ |
(৫) ঐ | ( ৬) সঞ্চয়িতা | (৭) গীতা , ষোড়শ অধ্যায়
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।