• Uncategorized
  • 0

প্রবন্ধে যশোবন্ত বসু

ভোগবাদ, নাকি ভোগ বাদ ?

যাঁরা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত পড়েছেন তাঁরা জানেন শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সেই কথোপকথনের কথা। ১৮৮৪ সালের ৬ ডিসেম্বর কলকাতায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী অধরলাল সেনের বাড়িতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ-আলোচনায় কথা প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, মানুষের কর্তব্য হল আহার,নিদ্রা ও মৈথুন। এই ফিচেল উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ বিরক্ত হয়েছিলেন বটে কিন্তু কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন গড়পড়তা সাধারণ মানুষের কথা। সেই মানুষের চরিত্র গত প্রায় দু-তিনশো বছর ধরে মোটামুটি একইরকম আছে।সামাজিক অবক্ষয়,রাজনৈতিক নৈরাজ্য,অর্থনীতির অধঃপতন মায় সাম্প্রদায়িক হিংসা-দাঙ্গাতেও সাধারণ পাবলিকের কিছুই তেমন যায় আসে না যতক্ষণ না আগুন তাদের নিজেদের চৌকাঠ পুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছে।
সমাজ-মাধ্যমে পাবলিক সততই সেলিব্রেশনের মেজাজে ! সে সদা আনন্দে থাকার ‘স্মার্ট’ আমোদ-উপকরণ কব্জা করে ফেলেছে।জীবনের সব রং,সব আহ্লাদ ও আবেগ বেগে আপলোড হচ্ছে। আত্মরতিময় জনগণের জীবনের সব আড়াল সরে গেছে। শুধু অর্গাজ্ম্ ও তার মোক্ষণের প্রাইভেট আড়ালটুকু প্রদর্শনকামের ছোঁয়াচ এড়িয়ে এখনও কোনওরকমে টিকে আছে, তবে আর বেশিদিন সে-আব্রু রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।কাছা খুলতে-খুলতে জনগণ যে-দিকে এগোচ্ছে !
প্রবীণত্বের প্রান্তে পৌঁছনো এক ভদ্রলোক বলছিলেন, “দোলের দিন কলেজরোডে সকাল দশটাতেই দেখছি গোটা পাঁচেক ছেলে আর তিনটি মেয়ে একেবারে খুল্লমখুল্লা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বোতলে চুমুক দিয়ে বিয়ার খাচ্ছে ! ছেলেদের তো কোনও লাজলজ্জা নেই কিন্তু মেয়েগুলোও ? কী দিনকাল পড়ল ! মেয়েরাও এখন মদ-সিগারেট খাচ্ছে জানি কিন্তু তার একটা আড়াল তো থাকবে !”
আমি বললাম, “ ওই তো, মাথায়-মুখে রং-আবিরের আড়াল তো রয়েছে।”
ভদ্রলোক তবু সেই ‘কালচারাল শক’ চট করে কাটিয়ে উঠতে পারলেন না।
এই প্রসঙ্গে মালদহের সেই বার্লো বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ভাইরাল ভিডিয়োটির কথা মনে পড়ল। নিখুঁত স্কুল ইউনিফর্ম পরে নিখুঁত অশ্লীল উচ্চারণে গাওয়া সেই প্যারডি সমাজ-মাধ্যমে এখনও বোধ হয় ঘুরছে।
মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এমনটা হওয়ারই ছিল। পিতৃতন্ত্র বহুকাল ধরে শিখিয়ে এসেছে কিনা যে, কিছু কাজ শুধু ছেলেদেরই মানায়, মেয়েদের মোটেই সাজে না। মেয়েরা হবে নরম,নম্র,লাজুক,শালীন ও সুসজ্জিতা।‘গেছো’ মেয়েদের, ‘পুরুষোচিত’ মহিলাদের মর্দানি বা ইয়ার্কি প্যাট্রিয়ার্কি সহজভাবে নিতে পারেনি। আজও পারে না।‘খারাপ মেয়ে’ ট্যাগটি তা-ই স্টিগমা হয়েই তাদের গায়ে সেঁটে থাকে। আর এই মুক্ত অর্থনীতির ভোগবাদী আবহে, উত্তুঙ্গ আমোদ-হাটে অবদমনের দীর্ঘ ইতিহাস সইতে ও বইতে-বইতে ক্লান্ত,বিরক্ত মেয়েরাও এবার ভাবছে, “আমাদের আর দাবায়ে রাখতে পারবা না” ! বিদ্রোহ (বা বিপ্লব) তো এভাবেই অঙ্কুরিত,পল্লবিত হয়।তবে কিনা কোন্ বিপ্লব সমাজের কুপ্রথাকে সমূলে উপড়ে ফেলছে আর কোনটা নিরেট অসভ্যতা সেই হিসেব বুঝে নেওয়ারও সময় এসেছে।স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে যে একখানি সূক্ষ্ম অথচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ তফাত-রেখা আছে তা বুঝতে গেলে প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োজন, সঠিক মূল্যবোধ ও বেড়ে ওঠার ইতিবাচক পটভূমিটাও জরুরি।
তা না-হলে এই ‘কেলেঙ্কারি’গুলি হবেই।
একটি বিখ্যাত মোটরবাইক প্রস্তুতকারী সংস্থার সেই বিজ্ঞাপনটি মনে করুন, রাস্তায় বেপরোয়া স্কুটি চালাতে-চালাতে পথচলতি বেলুনওয়ালার হাত থেকে বেলুন কেড়ে উড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে হাস্যময়ী,লাস্যময়ী যুবতীরা। বিজ্ঞাপনের পাঞ্চলাইন লিখছে, “হোয়াই শুড বয়েজ হ্যাভ অল দ্য ফান ?”
সত্যিই তো, সব আমোদ শুধু ছেলেরাই করবে কেন ?
এই তো ভোগের শুরু ! দুর্ভোগেরও কি ?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।