প্রবন্ধে হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রসঙ্গ : মহাজাগতিক কবি আলোক সরকার
বাংলা কবিতার ভুবনে কবি আলোক সরকার
এমন এক মহাজাগতিক নক্ষত্র যার আপাত সরল লেখাগুলির মাঝে লুকিয়ে থাকে নির্মাণ ও বিনির্মাণের সুষমা।একবার পড়ার পর এক মোহ তৈরী হয়, পরে দিনে দিনে শব্দ গুলি সম্পর্ক অন্বেষা সৃষ্টি করে।নৈর্ব্যক্তিক এক অন্বয়সাধন
নির্লিপ্ততা অথচ চিরজ্বলমান।মানুষের যেমন
অতীত ভবিষ্যত দুদিকে ছড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনি তার কবিতায় ক্রমান্বয়ে নিস্পৃহ বিস্তৃতি
রহস্যময়তায় ভরে ওঠে।
আচ্ছা দেখা যাক কেমন সে নির্লিপ্তি :
…..একদিন আর কোনো দুঃখ ই পাবো না। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এসে/ দামী ইজিচেয়ারের ভিতরে নিজেকে সপে দিয়ে / বেয়ারার হাতে ঠান্ডা জল খাব। একদিন অত্যন্ত কৌতুক বলে মনে হবে / এইসব কবিতা ,বিনিদ্র রাত্রি, শিল্পের
গভীর গভীরতম মানে/ যেমন এখন কুড়ি বছরের প্রেম বহুদিন পর ফিরে এসে/ চুলের ভিতরে হাত রাখলেও শুধুমাত্র মমতা ঘনায়, / কোনো উত্তেজনা নয়, শিহরণ নয়, সেইরকম সহজ আঙুলে / একদিন প্রিয় কবিতার ব ই খুলে পড়ব । একদিন আর কোনো / দু:খ ই পাবো না অন্ধকারে একটি সবুজ পাতা ঝরে গি য়েছিল বলে।
একদিন স্তব্ধলোক
এইসব কবিতার বীজ পাঠকে শুধুমাত্র আলোড়িত করে না, আরোগ্য দেয়।অবশ্য একথা ঠিক নিশ্চিত যে,এইসব কবিতা পংক্তি জীবন এবং জীবন বিষয়েই বলা তবু স্ব নির্মিত স্বাতন্ত্র্যতা যা বিশ্বাস নম্র আভরণ জাগ্রত চেতনার ই বহিঃপ্রকাশ।আলোক সরকারের কাছে কবিতা কি এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন:
…….ধরা যাক ,একটি বাড়ি রয়েছে, তার দরজা আছে ।আমার কাজ বেরিয়ে যাওয়া ।বেরিয়ে যাওয়াটাই আমার কাছে সত্য।একটা লক্ষ্য নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে।বেরিয়ে যাওয়াটাই শুধু আছে।সে যেখানে যেতে চায় তার একটা আগ্রহ
আছে, প্রাপ্তি আছে, আনন্দ আছে।দরজা আছে কি নেই, তার লক্ষ্য নয়।অপরিকল্পনার দিকে যাওয়াটা ই শিল্প।আর এসব নিয়েই ঘোর ,ঠিক ঘোর নয়,নিবিষ্টতা ,এই নিবিষ্টতাই আমার কবিতা।…..
আসলে শব্দের গঠনবিন্যাস এবং ম্যাজিকায়ন আলোক সরকার এর কবিতার ইউ এস পি ।
…যতদিন সে না ফেরে/ আমাদের সব খেলা বন্ধ।/উৎসব বন্ধ / হাওয়াকে বলব তোমাকে আর পাতা / কাপাতে হবে না।/ তুমি সেই দেশে যাও / যেখানে সে আছে।/ ফুলকে বলব/ তোমার আর এ দেশে ফুটতে হবে না / তুমি সেই দেশে ফোটো/ যেখানে সে আছে /আমরা কারো ডাকে ঘরছাড়া হব না/ আমরা কোনো গান শুনব না/ কেবল দুপুর যখন চুপচাপ হবে/আমরা এমন একটা সুর বাজাব / যা ঘর ছেড়ে ওপরে ,আরো ওপরে / মলিন করুণ সুরে সারা আকাশ/ ভরে দেবে ,বাতাস ভরে দেবে / সেই দেশ ভরে দেবে/ যেখানে সে আছে ।…
যতদিন সে না ফেরে/ পবিত্র মানুষদের জন্য ।।
এই কবির কাব্যচর্চা যারা দীর্ঘকাল অনুসরণ করেছেন তারা জানেন কবিতাকে বিষয় থেকে
বিষয়হীন করে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার।উতল নির্জন, আলোকিত সমন্বয়, অন্ধকার উৎসব, বিশুদ্ধ অরণ্য, অমূলসম্ভব রাত্রি এই সব কাব্যে তার গভীর সাধনার নিবিড়তা সর্বক্ষেত্রে
অভিব্যক্ত হয়েছে।অনেক ক্ষেত্রে সূক্ষ্মভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইগো সেন্ট্রিসিটির প্যারাডাইম শিফট ঘটেছে।সংস্কারের বাধনগুলি শিথিল হয়েছে। শৈলী ও প্রথার প্রাচুর্য ক্রিয়াশীল এবং চিরজাগরুক তার লেখায়।এক উজ্জ্বল এবং স্থিতধী সচেতনতা তার হৃদয় সঞ্জাত।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সাহিত্যিক অশোক মিত্র
আলোক সরকারের কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন:
থেমে থেমে, থেকে থেকে, কবিকে উপলব্ধি করতে হয় মনন বোধ ও মজ্জায়।তার কবিতায় পাওয়া যায় বেদ উপনিষদের শান্ত ব্যাপ্ত গভীর প্রজ্ঞা । হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে এমনভাবে জারিত করে, যার মধ্যে উপলব্ধি করি এক স্বর্গীয় সুষমা
।তারপর তার নীল আলো সমস্ত অন্তর জগতকে করে তোলে আবিষ্ট ও আপ্লুত।আলোক সরকারের সৃষ্ট কবিতাগুলি মরমী প্রজ্ঞার আশ্চর্য এক বিস্ময়কর অনুরণন ,যা কিন্তু ব্যাখ্যাতীত।
…চিরদিন আজ্ঞাবহ থেকে যাবো ।বৈশাখ দুপুরে একা/ তোমার গোপন চিঠি হাতে নিয়ে খররৌদ্রে যাব/ তোমার প্রেমিক তার বাড়ি।বলব বিকেলে হবে দেখা/ বড় রাস্তার পাশে তুমি তার অপেক্ষায়। সমস্ত দুপুরবেলা / পথে পথে ওড়াবে
নিস্পৃহ ধুলো, ক্লান্ত কাক ঘূর্ণিফল গাছে।…
অংশ – বিশুদ্ধ অরণ্য
বিশুদ্ধ অরণ্যে আর একটি কবিতা যা উল্লেখ না
করলে লেখাটি সম্পূর্ণ হবে না।
… তোমরা সব এসে দেখে যাও ,আমার ছাদের/ গোপন টবেতে আজ গোলাপ ফুটেছে/ সম্পূর্ণ
আকাশ,মেঘ ভেসে যায়, ফাল্গুন মাসের / হাওয়া
। তোমরা এসে দেখে যাও।/দশটি পাপড়ি গাঢ় নির্নিমেষ একাগ্র জেগেছে…
(রাজকন্যা বিশুদ্ধ অরণ্য)
কেন্দ্রিভূত অবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।অন্ত্যমিল সাধারণত দেখা যায় না তার কবিতায়, টানা গদ্যে কবিতা লেখা নতুন কিছু নয় কিন্তু আলোক সরকারের গদ্য কবিতা গুলি সবসময় অনন্য মাত্রা প্রদর্শন করে পাঠকের হৃদয়ে।যাকে বলা যায় অভিব্যক্তময়তার তৎপরতা।স্বচ্ছ তরল নির্ভার
উৎসর্জনে মূর্ত আরেকটি কবিতা এরকম:
……. হারিয়ে যাওয়া লাটিম আমি তোমার কথা ভাবি/ ঠিক তোমার কথা নয় তোমার হারিয়ে যাওয়ার কথা/ ছিলে একদিন সারাবেলা উদ্বেগব্যাকুল নিশীথিনী/ ঠিক কখন হারিয়ে গেলে লাল রঙের লাটিম?।কতো নি:শব্দে
হারিয়ে গেলে!/ …/ কুয়াশা জড়ানো অপরাহ্ন
মিলিয়ে যাচ্ছে আলো/ কার্নিশের নিচের আলো কার্নিশের ওপরের আলো/…/ সব কিছুই
সরে যাচ্ছে এখন আমার মনে হয়/পেছিয়ে যাচ্ছে খোলা নীল রঙের আকাশ/মিলিয়ে আসছে কোলাহল।
সব কিছুই সরে যাচ্ছে ।লাল রঙের লাটিম….
ঠিক কখন হারিয়ে গেলে? আমার কেবল ভাবনা/শূন্যময় অন্ধকার ফেনিয়ে উঠছে অভিমান/আমার কেবল ভাবনা ঠিক কখন হারিয়ে গেলে /লাল রঙের লাটিম।…..