প্রবন্ধ – তন্ময় সরকার

মধুকবি স্মরণে

বাংলার তথা ভারতবর্ষের নবজাগরণের অন্যতম মহৎ ব্যক্তিত্ব মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের আজ জন্মদিন। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

নবজাগরণের আগে ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক। সেই সমাজে ব্যক্তি ছিল, কিন্তু মানুষের ব্যক্তিবাদী মন ছিল না। ‘আমি একটি সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিসত্ত্বা। আমার জীবনের মালিক আমি। আমার নিজস্ব মতামত আছে। আমি স্বাধীন আমার জীবনযাপনে, আমার চিন্তাচেতনায়’— এই চেতনা সেদিন ছিল না। মানুষ এতখানি ভাবতে পারত না। মানুষ ছিল রাজার দাস, ধর্মীয় অনুশাসনের দাস, গুরুজনদের দাস, জমিদারের দাস। মানুষ মনে করত, তার কিছুই করার নেই। সবই পূর্বনির্দিষ্ট, ঈশ্বর নির্ধারিত। সে নিমিত্তমাত্র। ‘সকলি তোমারই ইচ্ছা/ ইচ্ছাময়ী তারা তুমি/ তোমার কর্ম তুমি কর মা/ লোকে বলে করি আমি’— এই ছিল মানুষের বিশ্বাস। নবজাগরণ সেই মানুষকে জাগাল। তাকে পথ দেখাল উত্তরণের। নবজাগরণ বলল, তুমি ব্যক্তি, তুমি মানুষ, তুমি স্বাধীন সত্ত্বা, তুমি তোমার কর্ম নির্দিষ্ট করার অধিকার রাখ, তোমার জীবন পরিচালনা করার মালিক তুমি, তোমার অনেক কিছুই করার আছে, এই সমাজের কাছে তুমি দায়বদ্ধ, এই সমাজের মানুষের প্রতি তুমি দায়বদ্ধ, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’, তোমার জীবন পূর্ব নির্ধারিত নয়, তোমার পরলোকের ভয় নেই, এই পৃথিবীতেই তোমার ইহকাল-পরকাল, ধর্ম তোমার জীবনের পথপ্রদর্শক নয়, তোমার জীবনের পথপ্রদর্শক বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবোধ, জীবনের সমস্ত ঘটনা ঈশ্বর নিয়ন্ত্রিত নয়, নিয়ম নিয়ন্ত্রিত এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, সকলই কার্য-কারণ সম্পর্কের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
এই ছিল নবজাগরণের মূল সুর। নবজাগরণ তাই বহু ‘নতুন মানুষ’ উপহার দিয়েছিল আমাদের। যে মানুষ তার আগে ভারতবর্ষে আগে কখনও ছিল না। মাথা উঁচু করে উন্নত ব্যক্তিসত্ত্বা নিয়ে দাঁড়াতে পারে যে মানুষ, সেই মানুষ। নবজাগরণের সেই সব মহৎ দানের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

বাংলা সাহিত্যে মধুকবির অবদান সবাই জানেন। তিনি সেই পুরোনো সনাতনী পদ্য রীতিকে ভেঙে বেরিয়ে এলেন। পয়ারের পরিবর্তে তিনি এনেছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের। তাঁর অমিত্রাক্ষর ছন্দ সম্পর্কে নবজাগরণের আর এক জন বড়মানুষ রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলেছিলেন, “পয়ার ছন্দের একঘেয়ে ঝন ঝনানি ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে এটাই প্রথম ও সবচেয়ে সফল প্রচেষ্টা। এবং কবিতা হিসাবে এটাই আমাদের ভাষায় সর্বোত্তম।… তিলোত্তমা সৃষ্টিতে যেসব সৌন্দর্যমণ্ডিত উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে তার ভুল ধরা তো দূরের কথা, পাঠক তা লক্ষ্যই করতে পারবে না।… ভেবে অবাক হয়ে যাই যে লেখক যখন এক হাতে এইরকম একটা হাস্যরসের ছবি আঁকছেন (একেই কি বলে সভ্যতা) তখন তিনি অন্যহাতে মিল্টনের সুষমা সম্পন্ন তিলোত্তমা রচনার কাজে ব্যস্ত।” (সূত্র : রাজেন্দ্রলাল মিত্র : নবজাগরণের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব -শংকর ঘোষ, পথিকৃৎ, শারদ সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৬)

সয়ং বিদ্যাসাগর প্রথমে অমিত্রাক্ষর ছন্দকে খুব আগ্রহে আমন্ত্রণ না জানালেও, তিনি তার মধ্যে যে Great Merit আছে তা চিনতে ভুল করেন নি। মধুসূদন রাজনারায়ণ বসুকে লেখা এক চিঠিতে ১৮৬২ সালে লিখছেন, “You will be pleased to hear that the great Vidyasagar is almost a convert to new poetical creed and is beginning to tear the ‘apostle’ who has propagated it with great attention, kindness, and almost affection!”
এবং মধুকবির পরবর্তী জীবনে এই মহৎ বিদ্যাসাগরের কী অসামান্য ভূমিকা— সে হয়ত অনেকেই জানেন। বিদ্যাসাগর মধুকবির বহু দোষ অবলীলাক্রমে ক্ষমা করে তাঁকে সাহায্য করেছেন নিজের সাধ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত। কারণ বড় মানুষ বড় মানুষকে চিনতে পারে, বড় গুণকে চিনতে পারে। মধুসূদনও তাই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে ছিলেন আমৃত্যু ঋণী :

“বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,
দীন যে, দীনের বন্ধু !–…
…পরিমলে ফুল-কুল দশ দিশ ভরে,
দিবসে শীতল শ্বাসী ছায়া, বনেশ্বরী,
নিশায় সুশান্ত নিদ্রা, ক্লান্তি দূর করে।”

বিদ্যাসাগর মধুসূদনকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও যখন মধুকবির অকাল মৃত্যু হয়, তিনি যারপরনাই কষ্ট পেয়েছিলেন। মধুসূদনের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার একটা উদ্যোগ হয়। উদ্যোক্তারা যখন বিদ্যাসাগরের কাছে এলেন, তিনি বললেন, “প্রাণপণ চেষ্টা করে যার প্রাণ রাখতে পারিনি, তার হাড় রাখার জন্যে আমি ব্যস্ত নই।”
বিদ্যাসাগরের চোখ তখন জলে ভোরে গিয়েছিল।

মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তাঁর অমিত্রাক্ষর ছন্দ। যা বাংলা সাহিত্যে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের আর একটি কথা না বলে পারছি না, “Poor fellow! He is born in evil days, when he will set nothing for his pains save the approbation of a very select few. Our countrymen are yet not in position to appreciate and enjoy blank vese. It requires a mental training which in these degenerate days of the Kaliyug no Bengalee, who has not a liberal english education, can lay claim to…”
(বেচারা! দুঃসময় ওঁর জন্ম হয়েছে। তাঁর যন্ত্রণার জন্য তিনি কিছুই পাবেন না। পাবেন শুধু হাতে গোনা কয়েকজনের সমর্থন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ উপভোগ ও প্রশংসা করার মত অবস্থায় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ নেই। এর জন্য দরকার সুশিক্ষিত মন। অধঃপতিত এই কলিযুগে উদার ইংরেজি শিক্ষা ছাড়া কোনও বাঙালীর এমন মন থাকতে পারে না।…)

মধুসূদন নবজাগরণের এক অসামান্য দান। তাঁর সাহিত্য শুধু মানুষকে নতুন রস দেয়নি, মানুষের মনকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। রাম নয়, মেঘনাদ হয়েছে মানুষের কাছে পূজ্য তার দেশের জন্যে আত্মবলিদানের কারণে। সত্যিকারের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ সেই মহৎ সাহিত্য ‘মেঘনাদ বধ’-এর শিল্প সুষমার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।