বইঘরে সঙ্কর্ষন ঘোষ

পাঠ_প্রতিক্রিয়া

নকশালবাড়ির দিনগুলো- অর্জুন গোস্বামী

প্রকাশনী- গাঙচিল, মূল্য- ৪৫০/-

মাস তিন-চারেক আগে যখন নির্বাচনের বাজার আর “আমার আট বছরের ভালোবাসার দাম দেও” নিয়ে বাজার সরগরম, আমার তখন সেসব দিকে নজর নেই। ‘কালবেলা’ পড়ে মাথায় ঘুরছে, “ঠিক কী ভুল, ঠিক কী ভুল… জবাব চাই, জবাব দাও”। বইপোকার লিস্টটা হাঁটকে লাল তমসুকটা পেতে গাঙচিলের দোকান ছুটলাম, কলেজস্ট্রীট… উঠলো বাই তো দোকান যাই।

বর্ণপরিচয়ের দোতলায় কখনো উঠিনি, না উঠলে জানতেই পারতামনা, বই বিক্রীর জায়গা এতো নোংরা হতে পারে। ঘুপচি দোকানটায় যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঝিমোচ্ছিলেন, আমি লাল তমসুক খুঁজছি শুনে প্রথমে একটু তাকালেন, তারপর চটক ভেঙে বললেন, “অ্যাঁ? “

ঐ বইটার যা দাম আমার কাছে তখন ছিলোনা অতো। আমি খুব সলজ্জভাবে বললাম, “ইয়ে এই ন্যাক্সালিজম নিয়ে আর বই আছে? ” তিনি তৎক্ষণাৎ আমায় প্রায় পাঁচ-ছটা বই বের করে দিলেন, তার মধ্যে ‘নকশালবাড়ির দিনগুলো’ও ছিলো। আমি সেটা নিয়ে টাকা মেটাচ্ছি, ভদ্রলোক কাঁপা স্বরে আমায় বললেন, “আজ্ঞে আপনি কি ইউ পি এস সি দিচ্ছেন? “, আমি একটু তাকাতেই “ডব্লু বি সি এস? ” আমি বললাম, “না না এমনিই এসব ঘাঁটতে ভালো লাগে আমার তাই পড়বো”।

সেদিন ভদ্রলোকের মুখে যে চকিত হাজার ওয়াটের দ্যুতিটা হঠাৎ দেখেছিলাম, সেটা জানাতেই এতো গৌরচন্দ্রিকা। আসলে আমরা যারা নবীন প্রজন্ম তারা ইতিহাস বিস্মৃতি আর সময়ের অগ্রগতির ভেতরে যে সূক্ষ্ম পর্দাটি বর্তমান তাকে প্রায়ই ভুলে যাই। নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে জানতে প্রথমেই এই বইটি কেনায় আমার একত্রে ভুল হয়েছিলো আবার ঠিকও। নাম ‘দিনগুলো’ হলেও এখানে মূলতঃ আন্দোলনের উপস্থিতি খুব কম। এই বইটি আসলে তৎকালীন ও তৎপরবর্তী কয়েকটি প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন সংকলন, যেখানে ছবির মতো ফোটানো আছে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চিন্তার পারিপার্শ্বিক এবং পটভূমিকা। ভারতে ‘মাওবাদ’ মানেই ‘খতম’ নয়, ‘শেল্টার’ নয়, ‘জেলব্রেক’ নয়, ‘নকশাল’ মানেই কেবলমাত্র চারুবাবু নন। এ যেন সেই অভিন্নহৃদয় দুই ভাইয়ের গল্প, যাদের একজন শত্রুর অবনমনের সুযোগ নিতে গিয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো অন্যজনেরই কাঁধে। উৎপল দত্ত কেবল মানিকবাবুর ‘মগনলাল’ নন, উৎপল দত্ত মানে একটা ‘টিনের তলোয়ার’ও বটে। বিপ্লবী মানেই বন্দুকধারী নন… সরোজবাবু কিন্তু কাউকে প্রাণে না মেরেই পৈতৃক প্রাণটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে তুলে দিয়েছিলেন। কিছু অপ্রকাশিত চিঠি, তার কী আগুনে ভাষা… সাধারণের যা চিন্তার বাইরে। আজকের নির্লজ্জ পদলেহনের যুগে কতোটা প্রয়োজনীয় নির্ভীক ছাত্রমনষ্কতা… সমস্ত বোঝানোর পক্ষে উপযোগী তথ্য ও গবেষণামূলক প্রতিবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরেছেন লেখক অর্জুন গোস্বামী। পাঠক হিসাবে তাঁকে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের দ্বিধা থাকা উচিত নয়।

সবশেষে বলি, এই বইটি কিন্তু আন্দোলনকে জানার প্রাথমিক দরজা কোনো মতেই নয়। অতএব কেউ যেন প্রাথমিক পরিচয় হিসাবে ন্যূনতম তথ্য ব্যতীত এটি সংগ্রহ না করেন। এই বইটি আমার প্রশ্নের সংখ্যা এতো অসীম পর্যায়ে বাড়িয়ে তুলেছিলো, যে পরবর্তীতে ‘লাল তমসুক’ কেনা আমার পক্ষে অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এখন বুঝি ঐ বইটি পড়া সম্পূর্ণ বলে, এটি আমার চোখে তৎকালীন ছবিটি আরো পরিষ্কার তুলে ধরতে সাহায্য করেছে। একটি বিষয় তো পরিষ্কার গাঙচিল প্রকাশনীর দুটি বই কিনলাম, দুটিই দশে দশ পাওয়ার যোগ্য।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।