বইমাত্রিক রাহুল গাঙ্গুলি

বাংলা সাহিত্যে, এই সময়ের ১জন তরুণ ও প্রতিভাবান কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী।সুদূর বাংলাদেশে থেকেও, বিভিন্ন প্রতিকূলতার ভেতর সে কাজ করছে বাংলা কবিতা নিয়ে।এখানে অবশ্য আমি তার সহধর্মিনী অপর্ণা হালদার’এর যোগ্য সঙ্গতের কথা বলতে চাই।যদিও, কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের পরিবারের কথা আমরা সেভাবে শুনি নি আজ পর্যন্ত; তবু মনে হয় : বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এসব আলোচনা হওয়া উচিৎ।অর্থাৎ, যেটা বলতে চাইছি ~ সমসাময়িকতায় সমর্থন কারা কারা করছেন, সেটা তুলে ধরা জরুরী।চেয়েছিলাম, অরবিন্দ’র কবিতার সাথে, যাঁরা তাকে পড়েন নি; সেইসকল পাঠকদের পরিচয় হোক।সে লক্ষ্য নিয়েই আজকের বইমাত্রিক।
তাঁর ১টি অতি সাম্প্রতিকতমো বই “অতিচল্লিশ ইন্দ্রিয়দোষ” নিয়ে লেখা ভূমিকাটি আজ সকলকে পড়াতে চাই।বইটি বেহুলাবাংলা প্রকাশনী থেকে এই বছরই বেরিয়েছে।বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শতাব্দী জাহিদ।যেখানে; অন্তরের গহীন স্তরে তাকিয়ে থাকা প্রতিফলিত চিত্রমূর্তি য্যানো সর্বদা এক অদ্ভুত আপেক্ষিকতার সাথে প্রতিনিয়তো অনুসন্ধান চালিয়ে বেড়াচ্ছে, যেভাবে ১জন প্রত্নতাত্ত্বিক মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেন অজানা সভ্যতার নিদর্শনী সম্পদ।বেহুলাবাংলার প্রকাশককে এই পর্যায়ে কুর্নিশ করতেই হয়; যেভাবে যত্ন নিয়ে গোটা বইটির উপস্থাপনা সাজানো হয়েছে, সে বিন্যাস বড়ো মনোমুগ্ধকর।এবারে, সরাসরি ভূমিকাটিতে চলে যাবো; যদিও জানি না ~ ক্যানো অরবিন্দ আমায়ে এতোটা ভরসা করে, ক্রিজে গোড়াপত্তন করতে বলেছিলো!

ক্যাওস ও অ্যান্টি-ক্যাওস : দৃশ্যকল্পনার নতুন দিশা

অর্থপূর্ণ প্রকাশের প্রতিসরণ যে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, এটাই যদি কবিতার সজ্ঞা হয় তবে সেই অনুরণনকে ডকুমেন্টেশন করে রাখাটা অতীব আবশ্যিক।কারন, কবিতা শুধু যে জীবন থেকে আবিষ্কৃত হয়, তাইই নয় বরং একটা সময়কে দেখা ও বোঝা এবং সর্বোপরি অনুভব করাটাও কবিতার অন্তিম লক্ষ্যগুলোর ভিতর অন্যতম শর্ত।ফোকাস যেমন আলোকে স্বীকার করে বিপরীত অন্ধকারকে শর্ত মেনে, তেমনই কবিতার কাছে দৃশ্যকল্পনাও একটা স্থায়ী শর্ত।কোনো সাময়িক প্রভাব নয়, বরং গভীরতর কবিতার ভ্রূণ অথবা সঙ্গমের আবেদন, নিশ্চিত করে শর্তাধীন অনুসন্ধান।আবার তেমনটা উল্টো পথেও ঘটে।শর্তহীন থাকাটাও যেমন কবিতার প্রাণধর্মিতা।তবে অনুভূতি ও অনুসন্ধান ততোটাই প্রয়োজনীয়, যতোটা সমুদ্র বিস্তারের প্রয়োজনীয়তায় জল।ঠিক এরকমই একটা অবস্থান থেকে বোঝা ও জানার শুরু দিয়েই অরবিন্দের কবিতা রচনা।আর এই কাজটা স্বতঃপ্রণোদিত কেবল নয়, বরং পূর্বপরিকল্পিত।কারন, বিগত শতাব্দীগুলোতে কবিতার যে বাঁকবদলের প্যাটার্ন আমরা লক্ষ্য করে আসছি বা যেভাবে এই শতাব্দীর শুরু থেকে বর্তমান আবহমানকালের কবিরা সেই প্যাটার্নের জাদুদন্ডটি বহন করে চলেছে, তাদের মধ্যে অরবিন্দ যে একজন অগ্রণী পথিক, সেকথা হলফ করেই বলা যায়।আরো কিছু কারনও রয়েছে, কিন্তু তাকে বলতে হলে সমান্তরালভাবে অরবিন্দের বই “চুপাচুপি একাল্লিশ ইন্দ্রিয়দোষ” আলোচিত হওয়াটা খুবই যুক্তিযুক্ত বা বলা ভালো অতিমাত্রায় দরকারি।
চুপাচুপি একাল্লিশ ইন্দ্রিয়দোষ, যার অন্তর্গত মোট চল্লিশটি ইন্দ্রিয়দোষে অভিযুক্ত কবিতা।কেবলমাত্র দৃশ্যকল্পনা বা প্রতিদৃশ্যকাল্পনিকতার ইমেজারি এফেক্ট নির্ভর সর্বস্বতা নয়, আমার কাছে এইসব দৃশ্যত উপাদানগুলির একত্র প্রয়োগে, একটা সার্বিক ক্যাওস্ (যাকে আমরা বলতেই পারি, চোখের সনাতন ডিলেইমাকে লন্ডভন্ড করে দেওয়ার প্রবণতা)।এই এফেক্ট অন্তত আগে তার কবিতায় সেভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে দেখি নি।দেখিনি, তার অ্যানার্কিষ্টমূলক্ পরিক্রমণের সচেতন প্রয়াস।দেখি নি, আলো ও অন্ধকারকে সাবলীলভাবে নস্যাৎ করে, তার প্লাজমাকেন্দ্রিক মানসিকতা।ভার্চুয়ালিটিকে চূড়ান্ত করা থেকে যার শুরু এবং ডাইভার্চুয়ালিটিকে একইসাথে সাধন সঙ্গিনী রূপে স্বীকারের প্রত্যয় থেকে যার নতুন বলয়ে নিরবচ্ছিন্ন অনুপ্রবেশ।যেমন, পাতা ওল্টাতেই বইটির প্রথম কবিতা ‘পতিত কমলা ও সম্ভাব্য গ্রহ’।যেখানে, ক্যাপ্টেন ফিলিপস্, কয়েকজন আইনস্টাইনবাদী ও মার্কপোলো, সকলেই নিজের বিপরীত প্রতিফলনের ছায়া।একদিকে তারা যেমন ইতিগাসগতো ভাবে স্বচরিত্র অনুযায়ী কার্যে লিপ্ত থাকেন, তেমনই একইসাথে স্থানাঙ্ক পরিবর্তনে তারা নিজেই নিজের বিপরীতে চলে যায়।এ যেন প্রিজমের অন্তরস্থ আলোকবর্ণালীর উল্লাসের কোনো এক যাযাবর সমান ক্যাওস, যা কেবল পথিকেরই কাছে গুরুত্বপূর্ণ।সেরকমই পরবর্তী কবিতা ‘প্রাণ’।ক্যাওসের নিরবচ্ছিন্ন কন্টিনিউয়াস আছড়ে পরা।সুতরাং, কবির চিন্তনাংশে [মোকাম খুলে দিল বোতাম অথবা আমি তো প্রাণী নই, উড়াল]।একটা সচেতন প্রলাপকারীতায় উদ্বুদ্ধ ভার্চুয়াল অতিচেতনা।ঠিক যেমন ‘পরশরীর বনাম অপর শরীর’ কবিতায় শরীরকে শরীর ভেবে সালাম করলে, নামতা শেষে পুরুষ গুনন পায়।আর অপর শরীর পেরিয়ে পরশরীর হয়ে ওঠে গহনাভিত্তিক কৌতুকঘর।আসলে, একটা শেষ না করে অপরটায় যেমন প্রবেশ নিষিদ্ধ, তেমনই এই চূড়ান্ত ক্যাওসভিত্তিক দৃশ্যকাল্পনিকতায় পর্বগুলো যেন চড়াই উতরাইএর মতোই সাজানো।এরকম সাবলীলতা নিয়েই আরেকটি কবিতা ‘ইমেজারি ইরেজারি, কুচ ক্যাওয়াজ’, যেখানে চিন্তনাংশ সাব্যস্ত করে [কম্পাস কম্পাস সিনেমার ইশারামুক্তি]।একেকটা পর্ব, খানিকটা বিরাম, খানিকটা উপলব্ধির মুক্তি।ক্রমাগতভাবে চলতে থাকে ক্যাওস ও অ্যান্টি ক্যাওসের ক্রিয়া বিক্রিয়া।একদিক থেকে এই অবস্থান থেকে একটা ট্রমা জাতীয় স্ট্যালাগমেশন্ বলা যেতেই পারে (স্ট্যালাগমেশন্ শব্দটির কোনো সনাতনী অস্তিত্ব নেই, যদিও এই ক্যাওস থেকেই তার জন্ম হলো এখনই)।ঠিক যেমন ‘সুষম’ কবিতায়, আমার ভেতরে আমি কে প্রশ্নে পরমাণু খুঁটে খুঁটে গবেষণা বা ‘নোটিশ’ কবিতায় সিজদা করব প্রশ্ন।
এরপর যে কবিতা, তা হলো ‘গতি’।এখানে দৃশ্য ক্যাওসের সঙ্গে বাড়তি উপাদান হলো শব্দ বিন্যাস্ততার অ্যান্টি ক্যাওস।এই কবিতাটি নিয়েই একটা পরিপূর্ণ গদ্য নিশ্চিতভাবে লিখে ফেলা যায় এ কারনেই যে, বিন্যাস এখানে সুনির্দিষ্ট।যেখানে, ক্যাওস চিরকালই অবিন্যস্ত।এই গতি নিয়েই পরের কবিতা পর্ব, তা সে ‘চেকার’ হোক বা ‘তালাশ তল্লাশ তালাশিয়া’ হোক বা ‘পরিস্থিতি’।আবার বেশ ভারী মাত্রায় থমকানো যেতে পারে ‘নিরীক্ষণঘর’ কবিতায়।কারন, ক্যাওস এখানে বলয়-বৃত্ত কেন্দ্রিক, চূড়ান্ত ফোকাসড্।এই দশা ভেঙে নতুন বিন্যাস আরেকটি চিন্তাংশ ‘প্রতিদিনের আহ্নিক’ কবিতায়।অতিমাত্রায় ব্যবহৃত বেশ কিছু শব্দ ও শব্দাংশের ওপর জোর, প্রক্ষেপ করেছে নতুন এক বিন্যাস, বকলমে আরেকরকম ক্যাওস।’কারিকাহুইশল’ কবিতা যেমন একটা ফিউশন ভিত্তিক কবিতা, তেমন ‘ভেষজ’ কবিতা আবার ফিশন্ ভিত্তিক।এও যেন একরকমের প্রাকৃতিক ক্যাওস, যা নিত্য এবং অনিত্য নিয়ে উভরূপী যৌথতার সমাহার।আর, যে কারনেই ‘চুমু’ এবং ‘ঋতুভিত্তিক’ কবিতাদ্বয় ট্রমাটিক্যাল্ ভবিষৎবাণীর ফসল।যা না থাকলে হয়তো এই বলয় শেষ না হয়ে অন্য বলয়ে অনুপ্রবেশের রাস্তা খোলা থাকতো না।হয়তো এমনটাই বলা যায়, এভাবেই অন্তরচেতনার অসীম বা অসীম পরবর্তী অসীমান্তরে যাবার পূর্ব প্রস্তুতি এই কবিতাগুলো।কখনও শর্তাধীন হয়ে কখনো শর্তহীন হয়ে।আর এখানেই নতুনত্বের উদ্ভাবনা।

পরিশেষে বলি, অনেকেই প্রশ্ন করেন, কবিতার পাঠক ক্রমশঃ নিম্নমুখী।হয়তো এখানে পরিমাপক হিসেবে সেই অর্থনৈতিক চাহিদা যোগানের উৎসেচক।কিন্তু এটাও তো হতে পারে, কবিতার পাঠক মান হিসেবে অনেক বেশী অগ্রণী চিন্তাশীল।সুতরাং মান বাড়ছে বলেই পাঠক কমছে, কারন এই মুহূর্তের কৃত্তিম যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে গিয়ে চিন্তা ও বোধের যাপন করেন কতোজন? সুতরাং, এই নিরিখে বলাই যায় চুপাচুপি একাল্লিশ ইন্দ্রিয়দোষ যে সেই অন্তরমানকে অতিক্রমণ করছে শুধু তাই নয়, নতুন এক দিশার সন্ধানে রয়েছে।অতএব, এই অনুসন্ধানের কার্যভার উপাদানের যারা শরীক, তাদের এই অধিকারটুকুকে ন্যায্যভাবেই স্বীকৃতি দেওয়াটাই তো প্রয়োজনীয়।

আলোচনা: রাহুল গাঙ্গুলী

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।