বর্ষায় প্রেম সংখ্যার মুক্ত গদ্যে ঋত্বিক গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতার বাসিন্দা। বইমেলা ২০১৯ এ দিবারাত্রির বিড়বিড় নামে একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে প্যাপিরাস প্রকাশনী থেকে। মূলতঃ কবিতালেখক। অল্পস্বল্প গল্প ও প্রবন্ধ লেখার ও ঝোঁক আছে।

বুঝিয়ে বলা

– আয়ায়ায়ায়মরা নুধন যোবনের ধুত!!!
আচ্ছা বাবা,ধুত লিখেছে কেন বলো তো?
চোখ মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলো ছয় বছরের শ্রমণা।
বাবা রবিবার সকালে মেয়েকে নিয়ে সময় কাটাতে বসেছেন।সেখানে এটা ওটা অনেক প্রসঙ্গ আসছে। সেই কথার মধ্যে ইস্কুলের গপ্পোই বেশি। ক্লাসে কি পড়াচ্ছে,কোন কোন টিচার ভালো তারপর ঈশান, পামেলা এরা সবাই কেমন আছে,আগের সপ্তাহে ময়ুরাক্ষীর সাথে আড়ি হয়ে আবার এই সপ্তাহে ভাব হয়ে গেলো কি ভাবে সেই রোমহর্ষক বর্ণনা ইত্যাদি এবং প্রভৃতিতে বাপ মেয়ের আড্ডা গড়াচ্ছে। এরই ভেতরে শ্রমণা বাবাকে জানালো যে এই সপ্তাহে গানের ক্লাসের দিদিমনি একটি রবীন্দ্রসংগীত শেখানোর দুশ্চেষ্টা নিয়েছেন। তা শেখাতেই পারেন
” ধানের ক্ষেতে” কিম্বা ” গ্রামছাড়া ওই”, কত গান তো আছে। তাতে শ্রমণার খুব একটা হেলদোল হতো না। কিন্ত দিদিমণি কি একখান অদ্ভুত গান বেছেছেন। প্রথমেই ” আয়ায়ায়া” দিয়ে গান শুরু। সে তো কিছুতেই সুরটাকে পাকড়াও করতে পারছে না। শুরুতেই চড়ায় উঠে আবার একটু নেমে ফের উঠে – নাহহ। ” আমরা ” তার ছোট্ট হাতের মুঠো থেকে চড়ুইপাখির মতো ফুড়ুৎ করে পালিয়ে যাচ্ছে। এতে শ্রমণা খুবই ক্ষুণ্ণ এবং চিন্তিত।
– তার উপরে জানো বাবা,কথাগুলো সব কেমন যেন।
শ্রমণা ফিসফিস করে বলে।
শ্রমণার বাবা ওদিকে ” যৌবণের ধুত ” শুনে হাল্কা বিষম খেয়েছেন।
– ওরে,ওটা ধুত নয় দূত। মানে messenger.
– ওই মোবাইলে তোমার যে মেসেঞ্জার আছে?
– হ্যাঁ,মানে ওইরকমই আর কি। আর নুধন নয়, নূতন। মানে নতুন। এটা হচ্ছে সাধু বাংলা।
– হ্যাঁ বাবা,বাংলা আবার সাধু কি? সাধুবাবা তো টিভিতে দেখেছি লম্বা লম্বা দাড়ি।”
বাবা হতাশ হয়ে মাথা চুলকোলেন। ইস্কুলে সাধু চলিত শেখায়নি,এদিকে নূতন কথার মানে না বুঝে কন্যারত্নটি যা পারছে আউড়ে যাচ্ছে।
” বাংলাভাষার লম্বাদাড়ি” প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বাবা আপাতত ” কথাগুলো কেমন যেন” নিয়ে পড়লেন।
– হ্যা রে, কথাগুলো কেমন যেন আবার কি? কোথায় বুঝতে পারছিস না?
– কথা আমি সবই বুঝতে পারছি।
শ্রমণা বিজ্ঞের মতো বলে।
– কিন্ত জানো বাবা,ওইখানে কি লেখা আছে? আমরা চঞ্চল আমরা অদ্ভুত।
– হ্যাঁ,তো?
– চঞ্চল হওয়া কি ভালো? মা আমায় কত্তো বকে জানো? কালকে রীনামাসিকে বলছিলো উফফ আমার মেয়েটা যা চঞ্চল। তাহলে চঞ্চল হওয়া তো ভাল নয়,তাই না?
বাবা কিছু বলার আগেই শ্রমণা আবার শুরু করে :
– তারপরে ওই বি ব্লকের সৌরভদাকে দেখো। সারাদিন ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাকে,আর রাতে ভায়োলিন বাজায়। ওকে সব্বাই অদ্ভুত বলে। বলে ওর আর কিচ্ছু হবে না। তাহলে বলো,অদ্ভুত হওয়া কি ভালো?
বাবা চুপ করে থাকেন।
শ্রমণা মুখ ভ্যাটকায় : তারপরে আবার আছে” আমরা করি ভুল”।হু:। আমি ম্যাথসে দুটো ভুল করি না এবার। মিস কি ক্ল্যাপ দেবে? না পানিশমেন্ট দেবে? আর এখানে দেখো কেমন গাইছে আবার। যত্তোসব নটি বয়েজ এন্ড গার্লসের গান। না বাবা?
বাবা হাসেন। হেসে শ্রমণাকে কোলের মধ্যে টেনে নেন। তারপর বলেন : আচ্ছা তুই সুভাষ চন্দ্র বোসের নাম শুনেছিস?
– হ্যাঁ,নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস। আমাদের স্কুলে তো ছবি আছে।
– রাইট। উনি কে ছিলেন বল তো?
– ফ্রিডম ফাইটার। শ্রমণা কনফিডেন্সে ফেটে পড়ে।
– একদম ঠিক। কিন্ত ফাইট কথাটা কি ভালো? তুই যদি কাল স্কুলে কারো সাথে ফাইট করিস,তোকে কি কেউ ভালোবাসবে?
– না। একদম না।
– কিন্ত নেতাজীও তো ফাইট করেছিলেন।
– সে তো ইন্ডিয়ার জন্য। “
শ্রমণার মুখচোখ কুঁচকে যায়। সে বুঝতে পারে না বাবা কি বলছে।
বাবা শ্রমণার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেন – তার মানে হলো এই,যে ফাইট করাটা সবসময়ে খারাপ নয়। তুই যদি ভালো কোন কাজের জন্য একটু চঞ্চল হোস,একটু অদ্ভুত হোস,যদি ভুল করিস তো কেউ কিচ্ছু মনে করবে না। কেউ তোকে পানিশ করবেনা,অন্তত যারা তোকে ভালোবাসবে তারা তো নয়ই। বুঝলি?
শ্রমণা মন দিয়ে ভাবে। তারপর বলে : কিন্ত আমি বুঝবো কি করে কোনটা নটি নটি চঞ্চল হওয়া, আর কোনটা ভালো চঞ্চল হওয়া?
বাবা শ্রমণার বুকের উপর তর্জনী রেখে বলেন : এইখান থেকে খুব ছোট্ট একটা গলা তোকে বলে দেবে। তার কথা শুনবি। সবসময়।
– wow!!!
শ্রমণার চোখ বড় বড় হয় ওঠে।
– মানে সেই সেভেন ডোয়ার্ফের একটার মতো?
– হুঁ। কিম্বা পিনোক্কিওর “জেমিনি ” নামের ঝিঁঝিঁপোকাটার মতো।
শ্রমণা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।
– বাবা,ঐ ডোয়ার্ফটাকে আমি কি নামে ডাকবো?
বাবা শ্রমণার গালদুটো টিপে বললেন :
বিবেক।
( পুনশ্চ : ” আমরা নূতন যৌবনের দূত” গানটি তাসের দেশ নৃত্যনাট্যের অঙ্গ। সেটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেন সুভাষ বোসকেই।)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।