আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
by
·
Published
· Updated
একুশে ফেব্রুয়ারি ও একটি কদমগাছ
হিম মাখা আকাশে একটুকরো চাঁদ ঝুলে আছে। পূর্ণিমা এখনও দশ দিন বাকি। কলাগাছের ফাঁকে চাঁদটাকে বাঁকা ত্যাবড়ানো চাকুর পারা দেখায়। অচেনা অদ্ভুত আড়ষ্ট। কুয়োর পানিতে তার ছায়া পড়ে না। আসশ্যাওড়ার পাতা থেকে উড়ে যাওয়া জোনাকির মতো একটুকরো জোসনা ছলকে উঠে তারপর আকাশটাকে নিভিয়ে দিয়ে কোথায় যে চলে যায় টের পায় না ইমতিয়াজ।
‘ই চাঁদ হামদের লয় ।’ সালমা বলে ওঠে একসময়।
ইমতিয়াজ নিজেও কি এরকম ভাবে নি? কতবারই তো ভেবেছে এই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে এই বিদেশ বিভুঁই ছেড়ে একদিন গাঁয়ে ফিরবে। মনে মনে সে কলকারখানার ধুঁয়ো সরিয়ে জামাপ্যান্টের কালি মুছে হালিমগঞ্জের গজল বিলের কিনারায় এসে দাঁড়ায়। সেখানে শঙ্খচূড়ের মতো ধবল পথ কেমন শান্ত উদাস ভঙ্গিতে পড়ে আছে। বিষন্ন মনমরা চোখে শুকনো বালির শব্দ। সাইকেলের টুংটাং আওয়াজ তুলে কেউ হাট থেকে ফিরছে এখন।তার হাটের কথা মনে পড়ে। মাছের কথা মনে পড়ে। বেকো নদীতে এর মধ্যেই জল শুকিয়ে যায় নি নিশ্চয়ই। ভেলসা তুড় মাগুর এবং বাঁশপাতা মাছেরা খলবল করছে রূপোলি জলে। বেকো নদীর নড়বড়ে সেতু পেরিয়ে বাঁ দিকের ঝোপঝাড় পেরিয়ে ভাঙা একতলা জিন বাড়ি।সেখানে রাতপরীরা এসে কল্পনার ডানা মেলে ওড়ে।ঘরের গা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা সজনে গাছ। গাছের ডালে একটা লক্ষ্মী প্যাঁচার অবিরাম উল্লাস । মাথার উপর ঝুলে আছে মহব্বতী চাঁদ। তার রোশনাইয়ে চিকচিক করছে চারপাশ। মরা চাঁদ দেখতে দেখতে ইমতিয়াজ নিজেও তো এরকম ভেবেছিল – দ্যাশ ছাড়লে চাঁদও পাল্টে যায়।।
গাঁ ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে মন টেকে নি তার। অথচ পেটের দায়ে তাকে ফেলে আসতে হয়েছে সবকিছু। মাটি শেকড় এমনকি নিজের চৌদ্দ পুরুষের শেখানো বুলিও। গাঁয়ে ঘরে এখন আর তেমন কাজকম্ম নেই। পাঁচ বিঘা জমিজিরেত যা আছে তা দিয়ে সম্বছরের ভাত জোটে না। কলেজে ভর্তি হয়েই তাই পড়া ছাড়তে হয়েছিল তাকে। খরচ চালাতে পারেনি তার বাপ নিজাম শেখ । ধান না হলে পেট চালানোই দায় তার আবার কলেজ। সে তো গোদের উপর বিষ ফোঁড়া। পড়াশোনায় দিমাগ ভালো না হলেও গড়পড়তা মাঝারি মানের তো ছিল । ঘষে মেজে নিলে হতেও পারত। নিজের এই আফসোস সে পুষিয়ে নিতে চায় পোলাপানের মধ্যে। তাই বলে সাহেব বানাতে হবে এমন মাথার কিরা কেউ দেয় নি। এ নিয়ে বচসা হয় সালমার সাথে।
দিনরাত খেটেখুটে দুটো কাঁচা পয়সার মুখ দেখেছে ইমতিয়াজ। এর মধ্যে সালমার বায়নার শেষ নেই। নতুন আলমারি টিভি,ফ্রিজ তো আছেই। মাস গেলে এটা ওটা সাতকাহন। আব্বা, চাচাদের কথা বললেই বলবে গায়ে জলকাদা মাইখে খোয়াব ভুইলে জনমভর চাষাই থাক তুমি। হায়াত মউত আল্লার দখলে কিন্তু কাম ইনসানের নিজের হাতে।এর জন্যই ইমতিয়াজের দৌড়ঝাপের মাঝে বিশ্রাম অল্পই । কিন্তু সে তো অন্য জীবনই চেয়েছিল। কলমকাঠি চালের জীবন। আসনলয়া ধান শীষের অদ্ভুত হাতসান দেওয়া ডাক। সবকিছু খিচড়ে দিয়েছিল হরেন মাষ্টার। কলেজ ছাড়ার পরের দিনই সামনের আধভাঙা দুটো দাঁত নিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, কিরে পড়া ছাড়লিস কেনে, ইমতিয়াস ? আর ত কিছু হবেক নাই, লকের ভাগচাষ কর। এর মধ্যে লাজশরমের কিছু নেই, তবু মাথাটা আচকা গরম হয়ে গিয়েছিল – পড়াশুনা শিখলেই আমারে কে চাকরি দিবেক স্যার? ই ত আর গাছের কেন্দ পাকা লয় যে হিলালেই টুপটাপ কইরে পড়বেক। কিন্তু মনে মনে ভেবেছিল যে করেই হোক হরেন মাষ্টারকে দেখিয়ে দিতে হবে যে তার মুরাদ কিছু কম নয় । হিলানোর মতো হিম্মত না থাকলেও হিল্লে একটা হয়েছিল। গায়ে গতরে জোর ছিল বলে টুকটাক কিছু মিস্ত্রির কাজ শিখেছিল বলে মেহনতের একটা চাকরি জুটে গিয়েছিল ভিন তালুকে । সারাদিন খেটেখুটে পেটের অভাব মরে তো মন দুখায়। প্রাণ খুলে বুকের দুয়ার দোহাট করে কথা বলার তেমন লোক নেই যাদের গা থেকে মাটির ভাপ বেরোয়। হিন্দি ভোজপুরি মিলিয়ে এক অদভুত খোট্টা ভাষা। দায়ে পড়ে দাঁত চিপে কথা বলে বটে কিন্তু ভিতরটা আইঢাই করে। কোঁথ পেড়ে বাতচিত করলে মন সাফ হয় না কিছুতেই ।পেট খোলসা করে ভিতরের সব দমবন্ধ কষ্ট সে ভাগ করে নিতে পারে না সবার সঙ্গে। মায়ের কথা মনে পড়ে। ভাষা তো মা। মনের সব আঁকুপাঁকু তুলে আনে। চোখের জল মুছায়। হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়।
মাটি বদলে গেলে ভাষা বদলে যায়। তখন আলাদা ভূগোল আলাদা চাঁদ আলাদা গাছ আলাদা পাখি। তারা কেউ তার চোখমুখের আকিবুকি পড়তে পারে না। এ কথা সে সালমাকে বলতেও থমকায়। বললেই বলবে তুমি মরদ না আওরাত বল তো। এত লরম মন তুমার। কী আছে হালিমগঞ্জে। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেইলেও পেটের গাভা ভরে না। সেই সালমাই এই সহজ কথাগুলোকে তার মুখ থেকে টেনে বাতাসে ভাসিয়ে দিল আলগোছে ভাবে। হাওয়ার ভেতর থেকে শব্দগুলোকে টেনে এনে আরেকবার শুনতে ইচ্ছে করল ইমতিয়াজের। কথাগুলো সত্যিই সালমা বলেছে তো।
দিনের বেলা কাজেকম্মে সময় বিতায় ইমতিয়াজের। তখন সাতপাঁচ নানা কথা ভাবার ফুরসত কোথায়। রাত এলেই কথার পিঠে কথা গেঁথে ফিরে আসে গজলবিল, হাতি খেদার মাঠ। পিলপিল করে তারা ঢুকে পড়ে মনে। তখন সে দেখতে পায় হাতিখেদার মাঠে নেমে এসেছে ভুতুড়ে আঁধার । চারদিক কেমন কালো কুচকুচে হয়ে আছে ।এক আচ্ছন্নতার মধ্যে দু একটা শেয়াল ডেকে উঠে- হুক্কাহুয়া। ইমতিয়াজ জানে চোরা শেয়ালগুলো এখন বেরিয়ে আসবে মাঠেঘাটের গর্ত থেকে। তারপর গেরস্থের ঘরে ঢুকে মুখে মুর্গি নিয়ে বেরিয়ে যাবে হিমঝরা নৈ:শব্দ্যের ভেতর।
একটা কদম চারা লাগিয়ে এসেছিল উঠোনে। তার কথাও মনে পড়ল। দাদা আব্বাকে বলেছিল আমার এন্তেকাল হলে একটা গাছ লাগাস। গাছটা দেখলেই আমার কথা মনে পড়বে। আব্বা লাগায় নি। মানুষ কি গাছ হয় কখনও ? সাদির একবছরের মাথায় ইমতিয়াজ উঠোনে কদমগাছটা লাগিয়ে এসেছিল নিজের হাতে। এই গাছের সাথে জড়িয়ে থাক মুনির শেখ, জড়িয়ে থাক তাদের মহব্বতের স্মৃতি। এই সাত বছরে কত বড় হয়েছে সেই গাছটা সে জানে না। তবু মনে মনে সে তার একটা আকার বানিয়ে নেয়। মাথা পেরিয়ে গাছটা হয়তো ছুঁয়ে ফেলেছে আশমানের সীমা।মানুষটা গাছের ভেতর বেঁচে থাকুক শেকড় ছড়িয়ে।
মায়ের বাতের ব্যথাটা কি বেড়েছে? অমাবস্যা পূর্ণিমা এলে তা চাগান দিয়ে উঠে। আজ তো তেমন কিছু নয়। এখনও দশদিন বাকি। এইসব ভেবনার ভেতর দিয়ে একটা ট্রেন চলে যায় রেলসেতু পেরিয়ে।তখনই সম্বিত ফেরে ইমতিয়াজের। ছেঁড়া ছেঁড়া শেকড়গুলো জ়োড়া লাগাতে গিয়েও টুকরো হয়ে যায় ট্রেনের ধাতব শব্দে।
‘আজ কী দিন মনে আছে তুমার ?’ চায়ের কাপটা নামিয়ে ধোঁয়া লাগা চোখ তুলে সালমা বলল একসময়। হর রাতে কাজ থেকে ফিরলে এক কাপ চা তার চাই। এটা তার রুটিন। সালমার সওয়াল ছুঁয়ে সে ভাবছিল এখন তো মাসের মাঝামাঝি। বেতন ফুরিয়ে এসেছে। হাতে পয়সাকড়িও তেমন নেই। দোকানে কি ধার দেনা বাকি পড়ে আছে কিছু? ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল-কেনে বল ত?
ই বাবা তুমার দেখি কিছুই খেয়াল থাকে না আইজকাল।
হারানো গরু খুজে পেলে যেমন আনন্দ হয় সেভাবেই ইমতিয়াজ উৎফুল্লভাবে বলল, ‘খুব মনে আছে। আইজ একুশা ফেব্রুয়ারি। ই দিন আইলে দাদুরে বেদম মনে পড়ে ।
হো হো করে হেসে উঠল সালমা।
‘হাইসছ যে?’
‘হাসব নাই? তুমি ইটও ভুইলে গেছ আইজ হামদের শাদির দিন।’
কাজের চাপে মন থেকে সরে যায় অনেককিছু।কেউ যেন ফুসলিয়ে নিয়ে চলে যায় এক চঞ্চলনগরে। কিন্তু এখন নামতার মতো সবকিছু ঝরঝর করে মনে পড়ে ইমতিয়াজের । বুঝতে পারে সালমার এই কথাগুলোর লক্ষ্য কী। তার গা থেকে আতরের খুসবু আসছে। ইমতিয়াজ জানে এই শীতের সাঁঝেও সালমা গোসল করেছে। বাথরুম থেকে গা ধুয়ে এলে শরীরে একটু আতর ছড়িয়ে নেয় সালমা।এ তার বহুদিনের অভ্যাস।
সেদিনও ছিল একুশে ফেব্রুয়ারী। গোল চাঁদ ছিল আকাশে।হাতে হাত রেখে সালমা বলেছিল- আইজকের দিনটা আলাদা। আইজ মহব্বতের দিন।
ঠিক । কী সোন্দর জোসনা ফুইটে আছে, ঝকঝক কইরছে চাইরদিক। তুমারে খুবসুরত লাইগছে এই আলায়।হাত বাড়িয়ে সালমার ডান হাত ধরেছিল ইমতিয়াজ।বিজলিবাতির ঘোর লাগা আলোয় শরমের আভা দেখতে পাচ্ছিল মুখে । স্পর্শের ভেতর সমস্ত কাঁপুনি, সমস্ত শিহরণ নিয়ে হাসছিল সালমা । এই হাসিতে আজও তাকে অন্যরকম লাগছে।
কী দিই তুমাকে আইজ ?
কিছুই না। আইজ শুধু এই দিনটাকে আমরা ভালবাইসব দুজনে।
চমকে গিয়েছিল ইমতিয়াজ। সালমা এরকম কথা সাধারনত বলে না। একুশে ফেব্রুয়ারি তেরোই মে বা ১লা নভেম্বর এলে সব কেমন ওলটপালট হয়ে যায়। ভালোবাসা এরকমই বেহিহাবী। বুকের গাভাটা বড় করে দেয় আচমকা। নিজের জীবন দিয়ে মানুষ তখন দেশের দশের মুখ রাঙিয়ে দেয়। বদলে দেয় ভূগোল, ইতিহাস। চাওয়াপাওয়ার ছোটখাটো হিসেব নিকেশ নিজের জীবনের তহবিলের খাতা থেকে ছিঁড়ে ফেলে দেয় হাসতে হাসতে।
আইজ একটা ভালোবাসার দিন, মহব্বতের দিন, নিজের দ্যাশকে, ভাষাকে ভালোবাসার দিন।
ইমতিয়াজ জানে। তার বুকের রক্তে টগবগ করে ফুটতে থাকে রফিক, জব্বার, বরকতের নাম। ইতিহাস কাঁপানো সেই গল্প। তারা নিজের ভাষাকে বাঁচানোর জন্য জীবন দিয়েছে।বাংলা ভাষা। যে ভাষায় কথা বলে সে নিজে। কথা বলে এত এত লোক। ইতিহাস সেই পলিমাটি বয়ে নিয়ে যায় কাল থেকে কালান্তরে ।লিখে রাখে পাতায় পাতায়। কিন্তু কেউ জানে না তার দাদু মুনির শেখের কথা। তার নাম কোথাও লেখা নেই। অথচ মানভূম যখন উথাল পাথাল । ইস্কুলে ইস্কুলে অফিসে অফিসে কাছারিতে কাছারিতে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হল খোট্টা ভাষা। গর্জে উঠল মানুষ ‘শুন বিহারী ভাই তরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাই।’ ডাং এর বিরুদ্ধে লেখা হয়েছিল গান। তার দাদু লিখেছিল । টুসুগান। কবিগান । সুর করে করে বলত। মানুষটাকে খুব একটা মনে পড়ে না ইমতিয়াজের। দাদির হাহাকার থেকে আব্বার গল্প থেকে আবছা আবছা আলো নিয়ে মানুষটার ছবি আকত খাতার পাতায়।চাষাভুষা মানুষ তবু পড়াত একটা পাঠশালায় । সেখানে পাপড়িবাঁধা পুলিশ এসে মুনিরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল থানায় – ইস্কুলমে আপকো সিরিফ হিন্দিই পড়ানা হোগা। এহি সরকারকা হুকুম হ্যায়।
যারা বাংলা পড়াবে তাদের মাইনে বন্ধ হয়ে যাবে। সবাইকে শিখতে হবে হিন্দি।লাঠির ঘা দিয়ে জোর করে শেখানো হবে।
মুনির তৎক্ষনাৎ কাজে ইস্তফা দিয়ে বলেছিল- রইল তদের চাকরি। অমন চাকরিতে থুতু ফেলি- থুঃ থুঃ।
গটগট করে বেরিয়ে এসেছিল থানা থেকে। পরে জেল হাজত অনেককিছুই হয়েছিল কিন্তু মুনিরকে টলানো যায়নি।
ইমতিয়াজ বারান্দার আবছায়া থেকে মুখ তুলে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল – এই কথাগুলো কুথাও লেখা নেই। দু একটা তারা মিটমিট করে হাসছে।
সালমা স্তব্ধ হয়ে দেখছিল ইমতিয়াজের মুখে অদ্ভুত রোশনি এসে পড়েছে। চিকচিক করছে তার গাল। চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে তেজ।এই মানুষটাই যেন একটা চাঁদ। জ্যোৎস্না ছড়িয়ে যাচ্ছে লাগাতর।
সালমা বলল: কেউ না লেখুক। আমরা লেইখে রাইখব আমাদের মনে।
হাজার মাইল দূরের কদমগাছটা যেন চকিতে বড় হয়ে উঠে। অনেক অনেক দূরে ছড়িয়ে যায় তার ডালপালা। হিম হাওয়ায় তির তির করে কাঁপতে থাকে উৎফুল্ল পাতারা । একটা ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে কে যেন দোল খেতে খেতে এগিয়ে আসছে। ঝাকড়া গাছের শাখা থেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মানুষটা। তার মুখ ঢেকে আছে পল্লবে পল্লবে ।