ভ্রমণ কথায় অমিতাভ দাস 

অমিতাভ দাস । কবি , গল্পকার ও প্রাবন্ধিক । অবগুণ্ঠন সাহিত্য পত্রের সম্পাদক । প্রকাশিত বই ২৪টি । সদ্য প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ " বিষাদ-সুন্দরী ও লালপদ্ম " । পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মান ।

এই তো কাছেপিঠেই

পেশাগত কাজে সকাল সকাল কলকাতা যেতে হয়েছিল । কাজটা দুটোর ভিতর শেষ হয়ে গেল । হাতে অনন্ত সময় । কালেজ স্ট্রিটে চলে গেলাম আরো একটি কাজে ।সেটাও হয়ে গেল । তারপর ? কফি হাউস তো আছেই । গিয়ে বসলাম ।অনেকটা সময় । কফি ও স্যান্ডউইচ খেয়ে চলে এলাম । গন্তব্য এবার ব্যারাকপুর ।কাছাকাছি দু-চার জনকে ফোনাফুনি করে বেশ বিব্রত করা গেল । তাঁরা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় একা একাই চলে এলাম ব্যারাকপুর ।
বহুকালের একটা খ্যাপা মন আছে আমার ।যখন-তখন পথে পথে হাঁটি–ধুলো লাগাই শরীরে ।অচেনাকে চিনতে চাই ।আর অজানাকে জানতে ।সঙ্গে ক্যামেরা তো থাকেই । একা একা ভ্রমণেরও একটা আলাদা মজা আছে ।কেউ বিব্রত করবার নেই । আত্মভাবনার সুযোগ ঘটে বেশি ।
ব্যারাকপুরে নেমে অটোর খোঁজ করলাম ।কোনো অটো যাবে না রিজার্ভ করতে হবে ।রিক্সা যাবে ।  বললে ,ভাড়া লাগবে 50 টাকা ।
তাহলে কী করা উচিত্ ? এক আইসক্রিমঅলা  বললে , গান্ধীঘাটের কাছে একটা মোড় আছে বিটি মোড় ,ওখানে নামুন ।তারপর হেঁটে দশ-বারো মিনিট । সে ভাবেই চলে গেলাম ।হাঁটতে তো আমার চিরকাল ভালোই লাগে । পথের এক গুমটি দোকান থেকে কিনে নিলাম সিগারেট ।
শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠেই ফেসবুকে লিখলাম ,ব্যারাকপুরে যাচ্ছি । স্থানীয় লেখক বন্ধুরা চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন । চারটে থেকে সাতটা পর্যন্ত আছি । যদিও কয়েকটি লাইক ছাড়া কেউ যোগাযোগ করেনি । ফলত , একা একা পথ চলতে বেশ ভালোই লাগছিল ।
গান্ধীঘাটের পথেই একটি জগন্নাথ মন্দির চোখে পড়ল ।বেশ বড়ো । এই মন্দিরটির কথা কোনো বইতে লেখেনি তো ! রাস্তায় দাঁড়িয়েই প্রণাম করে আবার এগোলাম । যেটা বলার ,তা হল ,এই জগন্নাথ মন্দিরটি মনে হ’ল অর্বাচীন । মন্দিরের ভাস্কর্য চমৎকার । চূড়াতে একটি পাতাকা পতপত করে উড়ছিল ।কাছাকাছি অনেক অ – বাঙালি মানুষের বাস । তাঁদের বাড়ি – ঘর দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম ।

.গান্ধীঘাটের নির্জনতা আর স্নিগ্ধ ভাব সকল ক্লান্তি জুড়িয়ে দিল । স্থানটির গাম্ভীর্য আছে । দেখলাম কারুকার্যমন্ডিত গান্ধীজীর স্মারকমিনাটটি ।এখানে তাঁর চিতাভস্ম ভাসানো হয়েছিল ।নানা ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাঁর জীবনকথা ।
অনেকেই বসে আছেন । কেউ চুপচাপ ।কেউ বা মৃদু স্বরে কথা বলছেন । গঙ্গা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি নৌকা ।পৌঁনে পাঁচটা বাজে ।সূর্য চোখের সামনে অস্ত চলে গেল ।একটা লাল কমলালেবু একটু একটু ডুবে গেল জলের তলায় ।
ফিরতে হবে । আধ ঘন্টা বসে তারপর বেরিয়ে এলাম ।
উঠে পড়লাম একটা রিক্সায় । এবার আমার গন্তব্য অন্নপূর্ণা মন্দির ।
এখন দ্রুত সন্ধে নেমে আসে । ফলে দেখা হল না গান্ধী স্মৃতি মন্দির তথা সংগ্রহশালাটি । রিক্সাঅলা যথা সময়ে শিব-অন্নপূর্ণা মন্দিরে পৌঁছে দিল । দেখেই অবাক হলাম । যেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ।সত্যিই অবাক হতে হয় ।
স্থানীয় মানুষদের কাছে এটি সোনার অন্নপূর্ণা মন্দির । কারণ বিগ্রহটি দেবী ভবতারিণীর নয় ,শিব ও অন্নপূর্ণার । অষ্টধাতুতে তৈরী ,তবে সোনা-রূপোর প্রভাব বেশী । জগৎজননী মা শিবকে অন্ন দান করছেন –এই মূর্তি ।
ইতিহাসটি এই রকম : রাণী রাসমণির ছোটমেয়ে জগদম্বার ইচ্ছেতেই এই মন্দির গঠিত হয় ।উদ্বোধন হয় 1875 সালের 22 এপ্রিল ।অর্থাৎ দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণের 20 বছর পর । সে অনুষ্ঠানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন। সুতরাং এখানকার মাটি পবিত্র ।শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলিতে ধন্য । এই সন্ধ্যায় নিজেকে অশেষ ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল ।
প্রণাম সেরে চুপচাপ বসেছিলাম নাটমন্দিরে ।অনেকেই আসছেন ।প্রণাম সেরে ,মন্দিরে মাথা ঠেকিয়ে চলে যাচ্ছেন ।পাশে এক অবাঙালী ভদ্রমহিলার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বাংলা বোঝেন না ।তাঁকে আধা হিন্দিতে এই মন্দির তৈরীর গল্পটি বলছিলাম।
এখানে শিব মন্দির ছটি । কারণ ? জগদম্বা নাকি আদেশ পেয়েছিলেন , এই মন্দির যেন কোনভাবে দক্ষিণেশ্বরকে ছাপিয়ে না যায় । তাই বারোটি শিব মন্দিরের স্থলে ছয়টি শিব মন্দির । মন্দিরগুলি দর্শন করলাম ও যথাযোগ্য শ্রদ্ধা জানালাম । শিব মন্দিরের পাশেই ধ্যানঘর । মন্দির লাগোয়া নাটমন্দিরটি সুন্দর । প্রচুর পায়রা সেখানে ডাকছে বক বকুম । কাছেই গঙ্গা । তবে সে দিকের গেট বন্ধ । স্থানটি নির্জন । সন্ধ্যা হয়েছে । তবে আলো অপ্রতুল । আরও আলোর প্রয়োজন । দেখলাম পূজারী এসেছেন ।আর একটু পর সন্ধ্যাআরতি শুরু হবে , তবে আমি থাকতে পারব না , আমাকে আসতে হবে অনেকটা পথ ।
সন্ধার অপূর্ব নির্জনতায় মন ভরে গেল । এই মন্দিরের ফটকটাও দারুন । এ নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে বিবাদ হয়েছিল । যা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল । ফটকের মাথায় একটা বিরাট সিংহ । ইংরেজরা বললে , এই সিংহ নাকি তাঁদের সাম্রাজ্যের শৌর্যের প্রতীক । আদালত রায় দিলে , শিল্পকে শিল্প হিসেবেই দেখতে হবে । তাতে কোন ক্ষতি নেই । এসব অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম । এতো চমৎকার একটি মন্দির ,অথচ সাধারণ ভক্ত ও পর্যটকদের কাছে সেভাবে প্রচার পেল না , অজানাই থেকে গেল । শুনেছিলাম এখানে একটি দক্ষিনী সিনেমার শুটিং হয়েছিল । তবুও এখানে তেমন ভক্ত সমাগম হয়না বললেই চলে ।
এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে অটো ধরে চলে এলাম আবার একদিন আসব সকাল সকাল এই সংকল্প করে । এবার বাড়ি ফিরতে হবে ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।