• Uncategorized
  • 0

মনের কথায় সোমা মিত্র

রবিঠাকুর প্রাণের ঠাকুর

তখন আমি এম এ পড়ছি। ছোটবেলার এক বন্ধুর সাথে প্রাণের এবং মনের বন্ধনে ধরা পড়েছি। তার এবং আমার বাড়িতে হালকা হালকা বিয়ের কথাবার্তাও শুরু হয়ে গেছে। তারপরে আবার এক নতুন আরম্ভ।
যাই হোক সে ছিল আমার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি ছোটবেলা থেকেই কল্পনার জগতে বিচরণ করি, সে হার্ডকোর প্র্যাকটিক্যাল। সে চড়বড় করে তবলায় খই ফোটায়, আমার আছে সংগীত। তার কাছে সাহিত্য মানে বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদা, জুলে ভর্ন এর ফিকশন, আর শার্লক হোমসের গোয়েন্দা উপন্যাস, আগাথা ক্রিস্টির রহস্য।ইতিহাসের যত রক্তাক্ত কাহিনী তাকে আকৃষ্ট করে। আমি তখন অতি ভদ্র সফিস্টিকেটেড মহিলা। আর সে কথায় কথায় খিস্তি মারে। তার খিস্তি যত না আঘাত করে তার থেকে বেশি আনন্দ দেয়। প্রায় শিল্পের পর্যায়ে আর কি! তবে তার ভালোলাগার অনেক কিছুই যে আমারও ভালো লাগত না তা নয়। বুদ্ধদেব গুহর আমিও একনিষ্ঠ পাঠিকা ছিলাম। কিন্তু সে “মাধুকরী”” বা “কোয়েলের কাছে”র।(পরে অবশ্য এই কোয়েলের কাছে বা কোজাগর নিয়ে বহু রাত আমরা গল্প করেই কাটিয়ে দিয়েছি।) কিন্তু সবার ওপরে ছিলেন গুরুদেব। চেতনার শুরু থেকে আমার বাড়ি এবং আমার স্কুল পাঠ ভবন রবি ঠাকুরকে আমার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছে ।যেখানেই থাকি ,যখনই থাকি আমার দেহে মনে সব সময়েই রবি ঠাকুর ভর করে থাকেন। হাসলেও রবীন্দ্রনাথ, কাঁদলেও রবীন্দ্রনাথ। গাছের পাতার মৃদু কম্পনেও তখন হৃদয়ের কম্পন টের পাই। ছুটে গিয়ে রবীন্দ্র রচনাবলী খুলে বসি যদি কোনো কবিতার পংক্তি পাই। এর সাথে ছিল গান। শিশু বয়স থেকেই গানের মাধ্যমে নিজের অশান্ত অবাধ্য মনকে বশে আনার শিক্ষা পেয়েছি আমার প্রথম সংগীতগুরু বাবার কাছ থেকে। সারাদিন রবি কবি আমাকে পেলব ভাবে জড়িয়ে থাকেন। তাঁর অস্তিত্ব আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
এই পর্যন্ত কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু এ হেন আমার আমিত্বে বাধ সাধলো সে। রবীন্দ্রনাথ শুনলেই ফিক ফিক করে হাসতে থাকে, পাকা ব্যবসাদারের মত রবি কবির গুষ্টি যে কত বড় ব্যবাসাদার ছিল তাই বোঝাতে থাকে। তার মতে ওনার লেখা না পড়াই উচিৎ কারণ ওনার লেখা পড়েই নাকি আমি এবং আমার বন্ধুরা প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছি। ওনার গান শুনেই নাকি আমার সব বাস্তব বোধ লোপ পেয়েছে।
আমার কষ্ট হয়।আমার ভেতরের থরথর আবেগ যে সত্যি সত্যি রবি ঠাকুরের গান শুনে বৃদ্ধি পায়, সে কথা আমি তাকে বোঝাতে পারিনা। বোঝাতে পারিনা নর নারীর সম্পর্ক সরলরেখায় চলে না। বোঝাতে পারি না ভালোবাসা মানেই আমার কাছে ‘আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি’ কিংবা ‘ আমারও পরান যাহা চায়’। অথচ এটা ভেবে কষ্ট পাই যে সে আমাকে নিয়ে এত মজা করে তবু আমার পরান তাকেই চায়। সবথেকে অসহায় লাগে যখন কবিতার কথা বললেই অকাট্য যুক্তি প্রয়োগ করে, কবিতা মানে ছন্দ, কবিতা মনে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কবিতা মানে আগুন মানে নজরুল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পয়সার অভাব ছিল না, বসে বসে আকাশ বাতাস ফুল মাটি জল নিয়ে পাতার পর পাতা লিখে গেছেন। যে বক্তব্য এক কথাতেই বলা যায় তার জন্য অত শব্দ খরচ করার কি আছে? ??!!! আমি চুপ করে যাই।
যে কোনো মনোমালিন্যে ও দেখি একই কথা বলে। রীতিমত ঠোঁট বেঁকিয়ে বক্রোক্তি করতে থাকে ‘ উনি তো রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। ভেসে বেড়াতে ভালোবাসেন।’ চোখে জল এসে যায়।এমন ভাবে মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে আসেন এবং কিছুক্ষনের জন্য প্রেমের ডিভোর্স হয়ে যায়।
সহ্যেরও সীমা থাকে। একদিন সাংঘাতিক রাগ হলো। মনে মনে ঠিক করলাম বিয়ের দরকার নেই। প্রেম টেম সব অবান্তর । যে রবীন্দ্রনাথ বোঝে না তার সাথে সারা জীবন কাটাব কি করে। কোনো কিছু নিয়ে বেশী দিন কচলানো আমার স্বভাব নয়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ইচ্ছে করে একদিন আঘাত করলাম’ আসলে রবীন্দ্রনাথ বুঝিস না, তাই কাপুরুষের মত তাঁকে নামানোর চেষ্টা করিস সবসময়।’ বুঝতে গেলে একটু বোধ থাকতে হয়। তুই নির্বোধ,নির্মম। তুই কি ভালোবাসবি। ভালোবাসার বুঝিস কিছু! মুখ দেখে বুঝলাম ভেতরে টলেছে। অত্যন্ত বিরক্ত মুখে বলল, ‘ তুইও তো ব্যবসা বুঝিস না। তো? পৃথিবীতে সবাইকে সব কিছু বুঝতে হবে নাকি?” জানতাম। এটাই উত্তর আসবে। আমিও তৈরি ছিলাম
আজ হারবো না । আরো শান্ত গলায় বললাম, “আমি তো টাটা বিড়লাকে নিয়ে সমালোচনা করিনা। তুই করিস। তাই এলার্জি টা তোর আমার না।” এর পরের টার জন্য তৈরি ছিলাম না। ভিমরুলের মত মুখ করে বলল ,” তাহলে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত খুঁজে বের কর। আর তার সাথেই গালে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে নদী…. না না নদী তো নেই, তোর বাড়ির সামনের ওই পচা ডোবার ধরে বসে বসে বসে মশার কামড় খা। আমার দ্বারা ওসব হবেনা।আমি চললাম।
রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। মাথার মধ্যে দপদপ করছে। বাকরুদ্ধ ভাবটা কাটিয়ে রাস্তার মধ্যেই চিৎকার করে বললাম,” তোকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আজ থেকে আর কোনো সম্পর্ক নেই। এখানেই শেষ।”
ইগোতে হাবুডুবু খেতে খেতে একটা আগুন দৃষ্টি হেনে সেও বাইকের মুখ ঘোরালো। আমার বাড়ির উল্টোদিকে। আমিও মনে মনে বললাম ছাতার বর। যে বউএর ভালোলাগার দাম দেয় না সে আবার বর কিসে!!

প্রথম কদিন গনগনে উত্তাপে কেটে গেল। যা করেছি বেশ করেছি। আমাকে এইভাবে অপমান করা।ভেঙে যাক, সব ভেঙে যাক। কোনোদিন ক্ষমা করবো না। দিনের মধ্যে পঞ্চাশ বার শেষের কবিতা পড়ে ফেললাম। ঘরে বাইরে পড়ে ফেললাম। খেয়ার কবিতা গুলো প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল। কিন্তু ওই!শান্তি হচ্ছে না। আগুন ততদিনে নিভে গেছে। আঁচটুকুও প্রায় পড়ন্ত।
তারপর বেশ কদিন নিবিড় ব্যথায় ফাটিয়া পড়িবে প্রাণ অবস্থা। প্রতি মুহূর্তে নিজের সাথে লড়াই করে চলেছি। রবীন্দ্রনাথকে অসম্মান করেছে। মুখ দেখবো না। অথচ প্রতি মুহূর্তে বারান্দা দিয়ে রাস্তার দিকেও তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকি। বিরস দিন তবু কেটে যায় কাজে। সন্ধে থেকে আমার প্রতীক্ষা চলতে থাকে রাত বারোটা পর্যন্ত। তিনি ছিলেন নিশাচর। বাইক নিয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে হুশ করে ঘুরে যেতেন রাত দশটার পর। আমি হাত নাড়তাম । কিন্তু হাজার একটা বাইক চলে যায় সেই বাইক আসে না। প্রায় এক সপ্তা দিন গুনে গুনে কাটিয়ে আমি হাপুস নয়নে কাঁদতে বসলাম। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,” কি হয়েছে? দীপাঞ্জন আসছে না কেন?” আমি আরো জোরে কাঁদতে আরম্ভ করলাম।
এগারো দিনের মাথায় দেখলাম ছেলে নয়, মা এলেন। মানে আমার শাশুড়ি মা। আমি দুরুদুরু বুকে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নির্ঘাত বিয়ে নিয়েই কথা বলতে এসেছেন। ও রবি ঠাকুর কোথায় তুমি! তোমার জন্য আমার বিয়েটাই ভেঙে যাচ্ছে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ? কেন তোমায় বুঝল না? তোমাকে বাদ দিয়ে চলব কি করে!!!
শাশুড়িকে প্রণাম করে দেখলাম মুচকি মুচকি হাসছেন। কি বলব! বলার কিছুই নেই। আমি অত্যন্ত বাজে পাগলী, ভেসে ভেসে বেড়ানো, আদ্যপান্ত ইম্প্রাক্টিক্যাল একজন মেয়ে। হবু বরকেই সন্তুষ্ট করতে পারিনা তো শাশুড়ি! উনি কিন্তু কোনো কিছুরই ধার দিয়ে গেলেন না। মার সাথে দু চার কথা বলে আরো দু একবার” পড়ছো তো? পড়ছো তো? সামনে তো এম এ ফাইনাল!” বলে উঠে পড়লেন। আর চলে যাওয়া মাত্রই আমার শোক আবার উথলে উঠলো। কোনো খবরই পেলাম না। অথচ ততদিনে আমার ভরি দিয়া পূর্ণিমা নিশা/অধীর অদর্শন তৃষা / কি করুণ মরীচিকা আনে.. রাত্রি বেলা শুয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। মা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন,’আমার একদম ভালো লাগছেনা তোদের ব্যাপার স্যাপার।কালই আমি বাবাকে পাঠাব দীপাঞ্জনের বাড়িতে। পাগল পাগলী কি সংসার করবে কে জানে।”এইবার আমি বললাম ” মা বিয়েটা হচ্ছে না। আমি করবোনা। ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাকে বাজে কথা বলেছে।” মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শুয়ে বলল “ঘুমিয়ে পড়।”
পরের দিন দুপুরে নীচের ঘরে বই পত্র নিয়ে বসার চেষ্টা করছি। একজনের জন্য তো জীবন নষ্ট হতে দেওয়া যায়না। এখন আমায় খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে। দেখিয়ে দিতে হবে। বিয়ে আমি করব না। ওরই চোখের সামনে থাকব আর ওকেই যন্ত্রনা দেব। অবশ্য যে রবীন্দ্রনাথ বোঝে না সে কোনো কিছুতেই যন্ত্রনায় পাবে কিনা সেটা ভেবে একটু বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। বেশ একটা জোশ নিয়ে পড়তে বসে দপ করে নিভে গেলাম।
হঠাৎ সেই আওয়াজ। খুব পরিচিত। ধড়াস ধড়াস বুক। ছুটে ওপরের বারান্দায় গিয়ে দেখলাম হ্যাঁ ঠিকই বুঝেছি। তিনি এসেছেন। থাকুক দাঁড়িয়ে।একটু পরে খুলব। বেল টা শুনেও শুনলাম না। ধীরে সুস্থে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দরজা খুলে ঘরে আসতে বললাম। বেশ কিছুক্ষণ অখণ্ড নিস্তব্ধতা। খাটের একদিকে আমি, অন্য দিকে সে। যাই হোক জেন্টসই প্রথম মুখ খুললেন। বললো “দ্যাখো আমি রবীন্দ্রনাথ বুঝি না। অত তুমি, আমি, ঈশ্বর, সে,ফুল ,পাখি, আকাশ ,মেঘ এসব আমার দ্বারা হবেনা। তবে গত কয়েকদিন ধরে আমি তোমার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গুলো মায়ের কাছ থেকে শুনেছি। একবার নয় বারবার। গাইব কি? ”
আমার গায়ে বোধহয় পুলক ই লাগছিল তখন। চোখে ঘোর। ঘন হয়ে জাপটে ধরলাম। মনের মধ্যের উথাল পাথাল ঢেউ বাঁধ ভাঙল সজোরে। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে চুমু খেতে লাগলাম তাকে।তার সারা মুখ চোখের জলে ভিজিয়ে দিতে দিতে অনুভব করলাম, অসীম স্নেহময় একটা হাত আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কানের কাছে মুখ এনে বলছে , “সাধে কি আর পাগলী বলি!কি যেন গানটা সখী ভালোবাসা করে কয়, সে কি কেবলই যাতনাময়…..।
যাই বলো বেড়ে লিখেছেন কিন্তু ভদ্রলোক।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।