• Uncategorized
  • 0

মুক্তগদ্যে তনিমা হাজরা

আমি তনিমা হাজরা। লিখি কবিতা, গল্প, অনুগল্প, মুক্তগদ্য, প্রবন্ধ।

অথমধ্যবিত্তকড়চা

মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটি অদ্ভুত দোআঁশলা, উভচর জীব। এদের আলমারীতে ঘোমটা দেবার জন্য শাড়িও থাকে, আবার জলকেলির জন্য বিকিনিও থাকে।
এরা পাঞ্জাবি পরে অষ্টুমীর অঞ্জলিও দেয় আবার কানে পেন্সিল আর মুখে বিড়ি গুঁজে এথিষ্ট সেজে দেবতার অস্তিত্ব নিয়ে লম্বাচওড়া বক্তৃতাও দেয়, তখন এঁদের হাতের দশ আঙ্গুলে দশটা গ্রহচক্রমুক্তির আংটি দেখে ফেল্লে কিন্তু আপনারা মোটেও আবার বেমক্কা কিছু বলে বসবেন না।
দিদিমণিরাও বগলকাটা ব্লাউজ বা পার্টিওয়্যার পরলে তাঁদের বিপত্তারিনীর তাবিজ বা শ্বেতবেড়েলার নিস্পাপ মূলগুলি লাল কালো সুতোয় বাঁধা পড়ে বাহুমূলে মুচকি মুচকি হাসে।
এঁরা নিজেরা পরনারী দেখলে লালা ফেলে গদগদবচনে এগিয়ে তাঁকে করতল দিয়ে পাখার বাতাস করে তার প্রীতিভাজন হতে চান কিন্তু নিজের স্ত্রীকে একবার যদি কোনো পুরুষের সাথে হেসে গড়িয়ে কথা বলতে দেখেছেন ওমনি তখন তাঁরা বাপের সুপুত্তুর, এমন বীরপুঙ্গব যে ঘরের লক্ষ্ণীর বিপথগামীতা রুখতে তাঁকে পিটিয়ে সিধে করার দৃঢ়তা রাখেন।
এঁরা চুল এলিয়ে ভুরু নাচিয়ে রোজ রোজ বিবিধ সাজে ফেসবুকে ছবি সাঁটিয়ে রাজ্যের পুরুষ মানুষকে লুব্ধ করার মোহিনী জাল ছড়ান কিন্তু অন্য মেয়ে তাঁর হক্কের শ্বশুরের পোলার দিকে একবার যদি ভুল করে তাকিয়েছে কি হেসেছে তবে তার চোখ গেলে দেবার দশমহাবিদ্যারূপধারণ করার ক্ষমতা রাখেন।
মানুষের কাছে স্বামীর নিন্দা করে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে দুখী,সবচেয়ে আত্মত্যাগী, সবচেয়ে নিপীড়িতা প্রমাণ করে অন্যপুরুষের স্বপ্ননচারিনী হবার বাসনা করেন।
এঁদের কাছে এঁদের নিজের স্ত্রীটি সবচেয়ে মুখরা, সবচেয়ে কুশ্রী, সবচেয়ে পাতে দেবার অযোগ্য একটি দরকচা ঢ্যাঁড়স।
এঁরা মদ্যপান করেন নুকিয়ে নুকিয়ে ছেলেপুলেদের ঘুম পাড়িয়ে, মাবাপের সামনে কদাচ সিগারেট ফোঁকেন না,
রাতে গুরুমন্ত্র জপ করে তবেই কিনা শুয়ে ইউটিউবে পানুছবি দেখেন।
ছেলেমেয়ে প্রেম করলে যথাযোগ্য শাসন করে তাদের তাঁবে রেখে বিবেচক অভিভাবকত্ত্বের পরিচয় দেন, যদিওবা প্রেমে অনুমোদন করেন, কিন্তু খুঁটিয়ে অপরপক্ষের জাতবিচার অবশ্যই করে নেন।
এরোপ্লেনে একবার চাপলেই ফেসবুকে তা জানানো এঁদের শ্রেণীর একটি বাধ্যতামূলক কর্তব্য।
তিন পয়সার সেবাকর্ম করে এঁরা দশপয়সার কেত্তন করে বেড়ান।
রবীন্দ্রনাথ এঁদের সংস্কৃতির মেরুদণ্ড। ছেলে মেয়ে একটু বড় হলেই এঁরা তাদের অবশ্যই একটি হারমোনিয়াম কিনে দেন যাতে তারা রোজ সকালবিকেল অ্যাঁ অ্যাঁ করে পাড়ার লোকের নিদ্রা শান্তি হরণ করতে পারে এবং বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে চা-বিস্কুট খাওয়াবার জরিমানাস্বরূপ তাঁদের গোটাবিশেষ ছড়া,নেত্য,গীতিসহকারে নিজেদের সাংস্কৃতিক উচ্চতাকে প্রতিফলিত করে দেখাতে পারেন।
তবে রবীন্দ্রনাথের আর কিছু লেখা পড়ুন বা না পড়ুন তাঁর সাথে কাদম্বরীদেবীর সম্পক্কটা ঠিক কতটা আঁশটে ছিল এটা এইশ্রেণীর সবাই বেশ বিশদেই জানেন।
শক্তি,সুনীল, গিরিশ ঘোষ,ঋত্ত্বিক এঁদের মদ্যপানের অভ্যাস এঁরা মেনে নিয়েছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ বা সত্যজিৎকে এঁরা কিছুতেই এক ঢোঁকও খেতে অনুমোদন দেবেন না কিছুতেই।
এঁরা সবজান্তা, সর্ব্বোবোদ্ধা এবং বড় সব্বোনেশে এক শ্রেণী যাদের নিজেদের কোনো জাত নেই অথচ প্রতি পদে পদে জাত খোয়াবার ভয়।
এঁদের চাপা কুকর্ম, মাপা গন্ডিবদ্ধ মানসিকতা, অপার বাকপারদর্শীতা, সর্বজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবল বাসনাবেষ্টিত অহমিকা, অপরের সুখে অনন্ত ঈর্ষা এবং দুঃখে প্রবল তৃপ্তিবোধ এঁদের অনন্য এক মর্যাদায় মহিমান্বিত এক অজেয়, অমর, অক্ষয় রক্তবীজের গোষ্ঠীতে ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিখে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।