মুড়িমুড়কিতে ঈশা দেব পাল
পিডিএ কিংবা ভালবাসার ভাষা
—পিডিএ-র জন্য মেরেছে। কী অবস্থা। দুটো বাচ্ছা ছেলেমেয়ে পিডিএ করেছে বলে মেট্রোতে কয়েকটা বুড়ো তাদের উদোম কেলিয়েছে।
—-হোয়াট ইজ দিস বান্টি? এটা কী ভাষা?
—– কিসের কী ভাষা??? আমি মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়েই বলি।
——মায়ের মুখের ভাষা শুনেই বাচ্ছা শেখে। মনে রেখো।
যাচ্চলে। এ লোকটা খামোখা জ্ঞানবাজির লাইনে চলে যাচ্ছে আজকাল। কী বলেছি কী। বুঝতেই পারছিনা।
তবে মোবাইল থেকে চোখ উঠিয়ে দেখি, আমার পতিদেবতা পরীক্ষার খাতার স্তুপ থেকে কেমন একটা অবাক আর ভ্যাবলা চোখে তাকিয়ে আছে। আজকাল মাঝে মাঝেই এমন দৃষ্টি উপহার দিচ্ছে। ছেলে পাশের ঘর থেকে কার্টুন দেখে একা একাই হাসছে। ছেলে কী শিখবে ?
—- কীসব বলছ আজকাল!! কেলিয়েছে, উদোম। এসব কী? উদোম মানে জানো?
—– উফ। সবটাই শুনেছ তাহলে ঘটনাটা।
—- না শুনে!!! পি ডি এ টা কী?
—-আরেএএএ, পি ডি এর জন্যই মেরেছে দুটো ছেলেমেয়েকে।
—- আজকাল ঝগড়া করাকে পিডিএ করা বলে নাকি!!!!
আমার অধ্যাপক স্বামীশ্রী চিরকালই একটু হাবাগোবা টাইপ বলে আমার মনে হয়। নিজের ক্লাস, অংক, ছাত্রছাত্রী তার বাইরে ইচ্ছে করেই ঢুকতে চায়না। চিরকালই আমার মনে হয়েছে সময়ের থেকে ত্রিশ বছর পিছোনো। তাই বলে এতটা??? হাঁ করা মুখটার দিকে তাকিয়ে গা পিত্তি জ্বলে গেল। তাও বললাম— পিডিএ মানে ঝগড়া???? দুটো যুবক যুবতী মেট্রোতে ঝগড়া করছিল???
—- কেন করতে পারেনা? তুমি আমার সঙ্গে কতবার মেট্রোতে ঝগড়া করেছ বলতো!!
—- হা ঈশ্বর, হায় আল্লা। তোমার আর কিচ্ছু মনে নেই??
—- কেন মনে থাকবেনা? তোমাকে এক ঘণ্টার ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম বলে তুমি রেগে আমাকে একবার প্রায় ঠেলে দিয়েছিলে। সেটা অবশ্য মেট্রোতে নয়, বাসস্ট্যান্ডে। ওহ, বুঝেছি পিডিএ মানে মারামারি? আজকাল অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে বড্ড মারামারি করে। তবে তাই বলে অন্য লোকেরা ওদের মারবে কেন? বাড়াবাড়ি করছিল???
আমি মোবাইল রেখে অবাক হয়ে লোকটার লেকচার শুনি। এই বুদ্ধি নিয়ে কলেজে পড়ায়???? এর পয়সায় আমি খাই??? চাকরি না করে???
—-গম্ভীর হয়ে বলি —নাহ, এবার বদলাতেই হবে।
—- কী?? এবার আবার খাতায় মগ্ন।
—- তোমাকে।
—- হাহ হাহ, আমাকে বদলাতে পারবেনা। আমি যা বলি সোজাসুজি।
—- আমার খেয়েপরে কাজ নেই, তোমাকে বদলাবো??? আমি আমার লাইফ পার্টনার বদলে নেবো।
—-এবার আবার খাতা থেকে মুখ তুলে—কী ভুলটা বলেছি!!
—– ভেবেছিলাম ফেটে পড়বোনা। পড়তেই হল। চিৎকার করে বললাম—- দুটো নারী-পুরুষ রাস্তায় শুধু ঝগড়া-মারপিট করে?? এই তোমার জিকে ??
—- আর কী করে??
—- আমরা কী করি?? শুধু ঝগড়া???
—- করনা?? সারাদিন তো তাই কর।
—-উফফফ, আর কিচ্ছু করিনা???
—-এবার একটু লজ্জা পেয়ে ছেলের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল—এত চেঁচাচ্ছো কেন?? মেট্রোতে ওসব কিকরে করবে কেউ??
যাক, মোটা মাথায় ঢূকেছে। এতেও না বুঝলে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস নিতে হত।
—- বোকারাম, মেট্রোতে অত কিছু কেউ করেনা। একটু আধটু করছিল।
— অ।
—-অ মানে ?
—- একটু আধটুতে মন নেই আমার।
—– ছি ছি ছি। তোমার মনের কথা কে জানতে চেয়েছে?? তুমি ইস্যুটা থেকে শুধু সরে যাচ্ছ। তোমার কি সমর্থন নেই এতে?
কোনও উত্তর না দিয়ে ব্যাটা খাতা দেখে যাচ্ছে। আমাকে ইগনোর করা হচ্ছে!!
আমিও গিয়ে রামঠ্যালা দিয়ে জানতে চাই—তুমি কি এটা সাপোর্ট কর??
—- একদম একদম পুরো সাপোর্ট। পিডিএ মানে যদি ওইসব হয়, হোক । রোজ হোক। তবে ওরা কি আর আমাকে জিজ্ঞাসসা করে করবে? তাহলে বলতাম, মেট্রোর চেয়ে ময়দান ভালো। তবে আমরাও তো আর পিডিএ করতে ওদের জিজ্ঞাসা করছিনা, তাই না?
চিরকাল দেখেছি, অধ্যাপক গোছের লোকেদের একটা পেটে পেটে শয়তানি থাকে, ওপর চালাকিও থাকে। শব্দটার মানে না জেনেই কী ওভার স্মার্ট হয়ে ব্যবহার করে দিচ্ছে।
দুই
বিকেলে রুমিদিকে ফোন লাগালাম। এতবড় একটা পিডিএর ঘটনা নিয়ে একটু পিএনপিসি করব বলে। সে ব্যাটা আজ দুবছর ধরে একটা পরকীয়ায় লটকেছে। সাহিত্যিকেরা পরকীয়া বলতে যেসব আধো গান, কবিতা এদ্দিন লিখে গেছে এ কেস মোটেই সেরকম না। এ হচ্ছে ঝগড়া, ঝঞ্ঝাট, রাগারাগি, ফেসবুকে ব্লক-আনব্লক করার রোজকার প্রেম। তাই প্রেমভালবাসা র লাইনের যা কিছু আমি ওর সঙ্গে ই আলোচনা করি। ওর জীবনের থিওরিই হচ্ছে, যেখানে ঝগড়া,সেখানে প্রেম। সেইসব শোনার পর থেকে মাথা এমন গুলিয়েছে, বাসে ট্রামে ও আজকাল ঝগড়া করি ভয়ে ভয়ে। কেজানে এই উদো লোকের সঙ্গে পরে যদি সত্যিই প্রেম হয়। ওকে জিগ্যেস করলাম, —-ভালবাসার ভাষাটা ঠিক কেমন হওয়া উচিত বলে তোমার মনে হয়? মানে কী ভাষায় প্রকাশ করা যায় আরকি। একদম গোড়া থেকে ধরতে চাইছিলাম পিডিএ ব্যাপারটা। অর্থাৎ পাবলিক ডিসপ্লে অফ এফেকশন। ব্যাপারটা তো সেই হল প্রেমের প্রকাশ। তা কেমন ভাবে প্রেম প্রকাশিলে লোকে বোঝে? রুমিদি প্রথমটা প্যাচাল পাড়ল— তার বক্তব্য হচ্ছে ভালবাসা মানেই ভুলের ভাষা।
ভালবাসার সঙ্গে ভুলের সম্পর্ক নিবিড়। বা বলা যেতে পারে বেশ ঘন। এমন কেউ এই পৃথিবীতে নেই, যে ভালবেসে ভুল করেনি বা ভুল করে ভালবাসেনি। অন্তত একথা ভাবেনি। যদিবা এমন কেউ জোটে যে মনে করে সে ভালবেসে ঠিক করেছে, তখন দেখা যায় বিশ্বশুদ্ধু লোক মনে করছে-কী ভুল। কী ভুল। অর্থাৎ ভুল ভালবাসার পিছু ছাড়েনা।
আর যে জিনিসটার গোড়াতে ভুল, শেষেও ভুল তার ভাষাও যে ভুলভাল হবে সেকথা বলাই বাহূল্য। খুব ছোট থেকেই সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞান হয়েছে আমার, হয়ত সবারই হয়। তখন আমি ক্লাস নাইন। সবে শাড়ি পরে ইস্কুল যাচ্ছি। নিজেকে খামোখাই বেশ সুন্দরী লাগছে। মা সর্বদাই রাগী রাগী চোখে দেখছে আমার দিকে। তাও তো আমাদের সময়ে ফেসবুক ছিলনা, মোবাইল ছিলনা। তবু হাত ঢেকে কিছু লিখলেই বাড়ি শুদ্ধু সবাই উঁকি দিচ্ছে। সেইরকম আপতকালীন সময়ে আমার ক্লাস থ্রি তে পড়া বোন হঠাত মা কে খেতে বসে জিজ্ঞেস করল—মা, লাইন মারা মানে কী? মা এর হাতা ধরা হাত থমকে গেল। আমার ঠাম্মা বসে জপ করছিলেন। জপতপ থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মা গম্ভীর হয়ে বোনকে জিজ্ঞাসা করলেন—এই কথাটা তুমি কোত্থেকে শিখলে ? বোন বলল—বলইনা তুমি। আমাকে দেখে রাকেশদা বলছিল,– লাইন মারা মানে জানিস? মা চোখ দুটো কটমট করে বলেন—লাইন মারা মানে ইলেকট্রিকের লাইন সারানো। আমাদের বসার ঘরের বাল্বটা কেটে গেছে, সেদিন ওরা দেখেছে। তাই বলছিল। কিন্তু বোনের উত্তরটা মনের মত হোলোনা। বেশ পাকাবুড়ির মত বলল—তাহলে কেন বলল যে তোর দিদির সঙ্গে লাইন মারব? ওর কি বাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে মা?
এই পর্যন্ত পড়ে সবাই বুঝেছেন যে সেদিন সত্যিই আমার বাল্ব কেটে গেছিল। মা ইস্কুল যাবার সময় টেঁপিদিকে পাহারা বসালো।
তিন