• Uncategorized
  • 0

মুড়িমুড়কি -তে শুভশ্রী ভট্টাচার্য

দাঁত সংক্রান্ত

আমাদের কলেজে পড়ার সময় রোগীদের ওপর কাজ করতে হত। এমনিতেই ডাক্তারদের কাজের সূত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ঘটে। আবার সরকারী হাসপাতালে কাজ করলে আরো বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। জানি না এই ঘটনার কথা আগে লিখেছি কিনা। জেলখানার কয়েদীদের দাঁতের সমস্যা হলে আমাদের কলেজেই নিয়ে আসা হত। তখন আমার প্রস্থেটিক্স বিভাগে ডিউটি। যার অর্থ দাঁত বাঁধানো। এখানে কাজের একটা বৈশিষ্ট্য হল, রোগী না থাকাকালীনও দাঁত বাঁধানোর জন্য প্রচুর কাজ করতে হয়। আর আমাদের চাপও থাকে সাংঘাতিক। এদিকে নিয়ম হল, কয়েদীর কাজ সব ফেলে আগে করে তাকে ছেড়ে দিতে হবে। কারণ তাকে ঘিরে সবসময় অনেক পুলিশ বসে থাকে। পাছে সে কোনো ফিকিরে পালায় সেইজন্য সবসময় নজরদারী থাকে। একমাত্র ডেণ্টাল চেয়ারে বসবার সময় তার শেকল বা হ্যাণ্ড কাফ খোলা হয়, কাজের সুবিধের জন্য। তখনো পুলিশ থাকে, কিন্তু একটু দূরে।
একজন কয়েদীর আমি দাঁত বাঁধিয়েছিলাম। অল্প বয়েসে তাঁর দাঁতগুলি কীভাবে চলে গেল সে আলোচনায় যাচ্ছি না। তিনি কী অপরাধ করেছিলেন, তা-ও আমার অজানা। মোট কথা আমায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁর দাঁত বাঁধাবার। আমি যথারীতি সব পেশেণ্ট ফেলে আগে তড়িঘড়ি তাঁর কাজ সেরে ফেলতাম। একদিন তাঁকে নিয়ে আসার পর দেখলাম তাঁর কাজটা কিছুটা বাকি আছে। রেডি হয়নি। তবু তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেহেতু এই জাতীয় লোকেদের কাজ এলেই করে দেওয়া নিয়ম। তাঁকে গিয়ে বললাম, ‘একটা মুসকিল হল আপনার কাজটা এখনো শেষ হয়নি। একটু ফিনিশিং করতে হবে, কিছুক্ষণ সময় লাগবে। একটু বাইরে গিয়ে বসবেন? বেশিক্ষণ লাগবে না, এই আধঘণ্টার মধ্যে আপনাকে ছেড়ে দেব।’ তিনি বললেন, ‘কী বললেন? ছেড়ে দেবেন?’ বলে ফোকলা মাড়িতে দেখি হাসছেন। আমি বললাম, ‘মানে বেশিক্ষণ তো আপনাদের ডিটেইন করে রাখা যায় না। তাই আর কী।’ বললেন, ‘বেশিক্ষণ না, যাবজ্জীবন।’ আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি দেখে বললেন, ‘আমায় এরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে।’ আমি কী বলব ভাবছি। তিনি বললেন, ‘আজই তো বাঁধানো দাঁতগুলো পেয়ে যাব, তাই না?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, একটু ফিনিশিং বাকি আছে আরকি, এরপর যদি মাড়িতে ব্যথা লাগে, তাহলে হয়তো একটু আডজাস্ট করতে আসতে হতে পারে।’ –‘ব্যথা!’ বলে আবার সেই হাসি। তারপর যেন কোনোমতে হাসি চেপে বললেন, ‘আর যদি ব্যথা-ট্যথা না লাগে তাহলে আর আসার দরকার হবে না?’ আমি বললাম, ‘নাহ, তাহলে আবার আসবেন কী জন্য?’ তিনি বললেন, ‘এমন হয় না, আপনি আজ না দিয়ে আমায় আরেকটা ডেট দিলেন।’ আমি বললাম, ‘তাতে কী লাভ হবে, আজকেই মিটে যেত কাজটা।’ তিনি বললেন, ‘আপনার লাভ না থাকতে পারে, আমার আছে।’ বললাম, ‘কী রকম?’ বললেন, ‘আপনি যেদিন ডাকেন, সেদিন জেলখানা থেকে একটু বাইরে আসতে পারি। এই যে আলিপুর থেকে এতটা রাস্তা আসি, সূর্যের আলোটা গায়ে মাখি, বাইরের বাতাসটায় একটু জোরে নাক টেনে নিশ্বাস নিই। আপনি ডেলিভারি করে দিলেই তো আবার সেই জেলখানার ঘুপচি অন্ধকার কোণে ফিরে যাওয়া। সেখানে গুমো গন্ধে– যাকগে, আপনার যা ভাল মনে হয় করুন, বাধা দেব না। আমাদের মতো পাপীদের আর কীই বা বলার থাকতে পারে।’
ভেতরের ঘরে এলাম। তিনতলার জানলা দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। নীল আকাশে ছাতিম গাছগুলো বৃষ্টি মেখে ঝলমল করছে। কাদের যেন ছাদে কচি একটা বাচ্চাকে চান করাচ্ছে তার মা। রোজ দেখেও দেখি না, আজ নতুন করে দেখলাম।
পুজোর আগে ছাতিম ফুল ফুটে কোলকাতাটাকে কেমন যেন বদলে দেয়।
আমি আর্টিকুলেটারে বাঁধানো পাটিগুলো সাজিয়ে নিয়ে এসে লোকটির সামনে সাজিয়ে যেন কত কাজ করছি এরকম একটা ভান করলাম। পুলিশগুলো একটু দূরে খৈনি ডলছিল। মিনিট দশেক পরে আরেকটা ডেট দিয়ে তাঁকে বিদায় দিলাম, মুক্তি নয়– বিদায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।