মেহফিল -এ- কিসসা কবিতা: ডিসেকশন ও আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ শাপলা সপর্যিতা

পেশা শিক্ষকতা। অরণী বিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য ও সৃজনশীল লেখা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত হয়েছে এই পৃথিবী এই দেশ ও নিভৃত পরবাস নামে দুটি কবিতার বই। টাইমমেশিন ও গুপ্তহত্যা অতঃপর নামে দুটি বড় গল্পের বই। মূলত উপন্যাস লিখছেন। বর্তমানে ‘সম্পর্কটি শুধুই জৈবিক’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন। ঢাকায় বসবাস করেন।

কবিতা:ডিসেকশন ও আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ – ১

অভিমানের খেয়া – রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

কবিতার সাথে আমার প্রথম সখ্যের কথা আমি মনে করতে পারি না কিছুতেই। কবে কখন কোথায় তার শুরু! প্রথম বলতে এইটুকু স্মৃতিই কেবল মনে আছে, লালমাই পাহাড়ের নিচে আমার বসবাস তখন। বৃটিশ আমলের বানানো সরকারি কলোনিতে সন্ধ্যা রাতেই গভীর অন্ধকার নেমে আসে। দূরে গ্রামগুলোতে যখন কুপিবাতি জ্বলতে শুরু করে তখন পাহাড়ের বনঝোপ থেকে শেয়ালের হুক্কাহুয়া আর বাঘডাসের সম্মিলিত চিৎকারে আমি কেঁপেকেঁপে উঠি তখনও। বয়স কত হবে, ছয় কি সাত। হঠাৎ কখনো ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে যেন প্রেতের নগরী সেই বনপাহাড়ের রাত। ঠিক এমনি এক সন্ধ্যায় ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। রাতে মোমবাতির আলোতে বসে মা আমাকে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘লিচু চোর’ পড়তে বসিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি ঝাকড়া চুল দুলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে পড়ছি, ‘বাবুদের তাল পুকুরে হাবুদের ডালকুকুরে..’। কখন যে ছেড়ে দেয়া চুলের একটি দুটি দুলে দুলে ওঠার সাথে মোমের আগুনের শিখায় শিখায় লেগে পুড়ে যাচ্ছে আমার সেদিকে খেয়াল নেই। ওদিকে চুল পুড়ে বিকট ঘ্রাণ ছড়ালে মা দৌড়ে আসেন। সেই আমার কবিতা পড়ার শুরু। সেবার ওই কবিতাটি আবৃত্তি করেই স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি প্রথম পুরস্কার পাই। ওরম তো কতজনই করে। একটা বয়সে সবাই কবিতা পড়ে। কিন্তু আমি সেই থেকে কবিতার নেশায় মাতাল। দিন যায় রাত যায় সময় বাড়ে। বয়স বাড়ে। কবিতার সাথে সখ্য কবে বাড়ে আমি জানতেও পারি না। বাবার সরকারি চাকরির ট্রান্সফারের কারণে শহর বদলে যায়। ময়মনসিংহ শহরে আমার কবিতা পড়তে বাইরে যাওয়া মানে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাংস্কৃতিক দল চারণে দু চারটে অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করা, এই। আসলে কবিতা আবৃত্তি করতো আমার বড়বোন। নানা অনুষ্ঠানে পড়তো। আমি তার পড়া, আবৃত্তি করা শুনতাম। আমাকে কখনো কোথায় ঠিক হচ্ছে কি না দেখিয়ে দিতে বলতো। কিন্তু নিজে একা একা পড়ি অজস্র কবিতা। তখন ক্যাসেটের যুগ। বারো ক্লাস পার হতে হতে বাংলাদেশের প্রথিতযশা আবৃত্তিকার যেমন গোলাম মোস্তাফা, কাজী সব্যসাচী, কামরুল হাসান মঞ্জু, শিমুল মুস্তাফা, ইস্তেকবাল হোসেন, মাহিদুল ইসলাম এদের কবিতা আবৃত্তি শোনা হয়ে গেছে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেব। ফেব্রুয়ারি মাস। মেজভাই আমাকে পরীক্ষার আগের দিন নিয়ে এলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার সিট প্ল্যানটা জানতে। যাব কার্জন হল, ক ইউনিটের পরীক্ষার সিটপ্ল্যান দেখতে। তখন অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু হতো টি এস সির মোড় থেকেই, এখন যেখানে রাজু ভাস্কর্যটি স্থাপন করা আছে তার কিছু পর থেকে শুরু হতো। পুরো রাস্তা জুড়ে নানা রকম জিনিসপত্রের মেলা বসতো। সেখানে কাঁচের চুড়ি পুতির মালা বাঁশ বেতের ঝুড়ি থেকে বাঁশি কিছুই বাদ থাকতো না। সবচেয়ে ভালো লাগার যে বিষয়টি ছিল তা হলো রাস্তার দু ধারে বসতো কবিতা আবৃত্তির জন্য ক্যাসেটের স্টল। তখন বইয়ের মতো ফেব্রুয়ারি আসলেই আবৃত্তিকারদেরও আবৃত্তির ক্যাসেট বের করারও হিড়িক পড়ে যেত। বড় বড় ডেকসেটে বাজানো হতো নাম করা আবৃত্তিকারদের আবৃত্তি। আবৃত্তিকারের বিশাল বিশাল পোস্টার লাগানো থাকতো আবৃত্তির স্টলগুলোতে। আবৃত্তিপ্রেমী আবৃত্তিপাগল শ্রোতার সমাগম হতো রাস্তার ধারে ধারে ধারে এইসব আবৃত্তির স্টলগুলোতেও। বাংলা একাডেমির মূল গেট পর্যন্ত চলতো এমন। তারপর মূল গেট দিয়ে ঢুকে কেবল বর্ধমান হাউজকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমির আশপাশ ঘিরে বসতো বইয়ের স্টলগুলো।
আমি টি এস সির মোড় থেকে সোজা পথ ধরে মেঝোভাইয়ার হাত ধরে হাঁটি। ১৯৯৩ সালের প্রথম দিক। একটা স্টল থেকে খুব ভরাট জোরালো কণ্ঠের আবৃত্তিতে আমি মুগ্ধশ্রবণ, চলতে থাকি একমনে;
‘অনুরাধা, তুমি কখনো পপি ফুলের নাম শুনেছ?/পপি ফুল?/পৃথিবীর সবচেয়ে দামী আর ছোঁয়াচ জিনিস/ এখন আমার ঘরে সেই ফুলের নিকষ ঘ্রাণ/ঝুরঝুর ছন্দময়/ঘর অন্ধকার/ অথচ বাইরে হাজার পাখি বুঝি গাইছে বউ কথা কও/বউ কথা কও/ তাহলে কি শাশ্বত দিন এসেছে?’
সারাটা পথ হাঁটতে হাঁটতে দারুণ কণ্ঠে ‘স্বপ্নের দেশে বাহারী নদী’ নামের সেই কবিতার শব্দে শব্দে ঝরে পড়া বেদনায় বিবর্ণ হতে হতে আমি শক্তপোক্ত ভাবে প্রেমে পড়ে যাই কবিতার। আবৃত্তিরও। বুকের ভেতর সেই অনুরাধা তোলপাড় করে। বয়স ১৭ বছর। দিন একাকার সে অনুরাধার বেদনায়। রাতগুলো পপি ফুলের গন্ধে মাতাল করে তোলে। তারপর ময়মনসিংহ এসে কতবার যে সেই আবৃত্তিকারের আবৃত্তি শুনেছি। সেই থেকে আমি মাহিদুল ইসলামের কবিতা আবৃত্তির দারুণ ভক্ত। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর পরই আমি যখন সিদ্ধান্ত নিই কোনো দলের সাথে যুক্ত হবো তখন প্রথম আমি স্রোত আবৃত্তি সংসদের কথাই ভাবি। শুরু হয় দারুণ এক জীবনের নতুন পাঠ। কেবল কবিতা আবৃত্তিই নয়। নিয়মানুবর্তিতা সময়ানুবর্তিতা শৃঙ্খলতার যে দারুণ বাধ্যবাধকতা ছিল স্রোত আবৃত্তি সংসদে তা বলে শেষ করা যাবেনা্। কিন্তু যে কবিতা আবৃত্তির কণ্ঠ শুনে স্রোতে জয়েন করেছিলাম সেই মানুষটাকে সামনে দেখে বড়ই মনভাঙা। মাহিদুল ইসলাম তখন সদ্য বিয়ে করেছেন্। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্ল্যায়ড ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট ত্যাগ করে বাইরে বি এ পরীক্ষা দিয়েছেন। আর দিনরাত কবিতা আবৃত্তির দল করেন। জান প্রাণ দিয়ে রাত দিন খাটেন দলের সাথে। আমাদের মতো নতুন আবৃত্তি শিক্ষার্থীদের সাথে চরম তার ব্যবহার। পাঁচ মিনিট দেরীতে হলে ক্লাস ঢোকা বারণ। প্রতিদিন নিয়ম করে পঠনপাঠন অনুশীলন। দলের সাপ্তাহিক কাজের বাইরেও সারা সপ্তাহ জুড়ে দুটি তিনটি ভাগে অনুশীলন করতে হতো। আমি কলাভবনে ক্লাস সেরে কখনো ক্লাস ফাঁকি দিয়েও চলে যেতাম টি এস সি অনুশীলনের জন্য। সে এক দারুন সময়। মাহিদুল ইসলামের এই কঠোর অনুশাসনে সত্যিকার অর্থে আমরা গড়ে উঠেছিলাম সঠিক সময়ানুবর্তী আর কবিতা অন্তপ্রাণ আবৃত্তিকার হিসেবে। ভীষন ভয়ানক ছিল তার ব্যক্তিত্ব। আমিতো দশ হাত দূরে দূরে থাকতাম ভয় পেয়ে আর ‘জ্বি আচ্ছা’র ওপর দিয়ে চলতাম। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ দিন মাহিদুল ইসলামের ছত্রছায়াই কবিতার পাঠ আবৃত্তি নির্মাণে শিক্ষণ আজও জানিয়ে যায় সে সময়ের সমৃদ্ধ দিকনির্দেশনার কথা। যে কারণে শত বিরুদ্ধ প্রতিবেশেও আমি মাহিদুল ইসলাম ছাড়া আর কাউকে আমার আবৃত্তির গুরু হিসেবে মেনে নিতে পারিনি এ যাবত। সেই মাহিদুল ইসলাম পড়বেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা ‘অভিমানের খেয়া।’
কবিতার নামটি শুনলেই বোঝা যায় দূরন্ত ঝড়ের মতো ব্যাকুল ব্যপ্ত বিক্ষুব্ধ এক প্রলয়ের ইতিহাস লেখা আছে এখানে। যারা যারা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে খুব কাছ থেকে চেনেন তারা জানেন কি ছিল তার অভিমানের প্রাবল্য কেমন্ ছিল তার ভাষার জ্ঞান আর প্রয়োগের দক্ষতা কেমন ছিল তার বোধের গভীরতা অথবা প্রজ্ঞা আর কতটা শক্তিশালী কবি ছিলেন তিনি। কতটা সমৃদ্ধ কিংবা ঐশ্বর্য্যমন্ডিত ছিল তার সৃষ্টির সম্ভার। অভিমানে ক্ষুব্ধ দ্রোহে পরাক্রান্ত প্রবল যন্ত্রণায় কাতর ব্যক্তি হিসেবেও আজীবন স্বেচ্ছাচারী একজন মানুষ যখন কবিতা লেখেন তখন সেটা কোনো মার্গে পৌঁছুতে পারে তার স্বাক্ষর রুদ্র রেখে গেছেন তার কবিতায় এ কথাটি অনস্বীকার্য।
কবিতাটির শুরুতেই নিজেকে একা ঘোষণা দিয়ে প্রবল আঘাত। বেঁচে থাকার ন্যুনতম ঐশ্বর্যহীনতার প্রকাশ মিন মিন করে নয়, প্রবল আত্মসম্মানে। সাথে কেন এই একাকীত্ব কেন এই দহন অথবা কি চাই কেন চাই তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যায় কবিতাটির বিষন্ন হতে হতেও বিষন্ন নয়, বরং রুদ্র রস সঞ্চার করে। সেই রুদ্র রস চলে পুরো কবিতাটি জুড়েই;
-এতদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই
পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।

প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,
নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-
এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন!
কিছুটাতো চাই, হোক ভুল – হোক মিথ্যে প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক-জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

এই যে নিজের অধিকার আদায় করতে না পারার প্রতিবাদ আপাত দৃষ্টিতে তা নারী প্রেমে আহত কিংবা ব্যর্থ একজন প্রেমিক পুরুষের কথা মনে করিয়ে দেয়। যে পুরুষ প্রেমিকার আঘাতে বাকরুদ্ধ। ভাষা হারিয়েছে। বুকের নিভৃতে জমে উঠেছে যার দারুণ অভিমান। জানানো হয়নি কাউকে কোন সে দ্বিধা কোন সন্ত্রাসে সে অবরুদ্ধ কেউ কি জানে! খুব একটা সিমপ্যাথি জন্মে মানুষটির জন্য যখন এমন লাইনগুলো পড়ি
– এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটেনা শাখায়।
এত ব্যথার ভার যখন একা নিয়ে চলতে হয় একজন মানুষের তখন কোথাও না কোথাও তো তার পারগেশন চাই। তাই বেদনাকেই শেষতক অবলম্বন করে বাঁচিয়ে রাখতে হয় নিজেকে। তারই রূপায়ন রয়েছে কবিতার এই লাইনগুলোতে। ব্যক্তিমানুষের আজীবনলব্ধ দুঃখ পরাজয় লয় কিংবা গ্লানিকে যখন বেদনার রূপে অপরূপ করে তোলা যায় তখনই বোধ করি নিজের মনের সান্ত্বনা হয়। তাতেই কি কিছুটা পাওয়া? হয়তো হয়। তা না হলে রাত কেন সুতোনু হবে? কেনই বা অধরার ঠোঁটৈ চুমু খেয়ে রাত হবে সুখের। আর সে সুখের রং কেনই বা হবে নীল থেকে সুনীল!

– তুমি জানো নাই-আমি তো জানি,
কতটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি
বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে, বলি এইতো জীবন,
এই তো মাধুরী এইতো অধর ছুঁযেছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।

কবিতায় এর পরের লাইনগুলো জাগায় দ্বিধা। এই যে এতক্ষণ ধরে কবিতার পরতে পরতে অসীম বেদনা না পাওয়ার চিৎকার অধিকার হরণের যন্ত্রণা কিংবা অবদমনের আক্ষেপ সে কি কেবলই নারীপ্রেম তাড়িত কিংবা নারীপ্রেমে ব্যর্থ কোনো চিরকালীন আহত মানবের হতাশা? না তা নয় কিন্তু। নিচের কয়েকটি লা্ইন পড়লে বোঝা যাবে সময় হতাশা ব্যর্থতা গিয়ে মিশেছে এক অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা হন্তারকের প্রবল আধিপত্যের বিরোধে। নারীপ্রেমের অবয়বের আড়ালে বিপুল আগ্রাসী সমাজ-স্বার্থান্ধ পরসম্পদ হরণকারী লুটেরা রাজনীতি- আর রাজনীতিক-স্বেচ্ছাচারী নেতা শাসকের অধিকার হরণে নিষ্পেষিত অবদমিত অপহৃত চিরায়ত বঞ্চিত মানবের যাতনার আর্তনাদ এখানে মিলেমিশে একাকার
– তুমি জানো নাই – আমিতো জানি
মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে
মাংশের ঘরে আগুন পুষেছে,
যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নিলীমা চেয়েছে শুধু,
করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।
পরাজয় এসে কণ্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা
চিতার চাবুক মর্মে হেনেছ মোহন
তবু শেষে কবি যুগ যন্ত্রণার বিপুল পরাজয়কে মুছে ফেলতে চেয়েছেন প্রত্যাশার শেষ অস্ত্রটি ঝুলিয়ে রেখে। প্রেম আর প্রীতির আবাহনের আয়োজনে ভুলে যেতে চেয়েছেন রক্তাক্ত ক্ষত আর পরাজয়কে। সুন্দরের প্রত্যাশায় ফুলের প্রতি বাড়িয়ে রেখেছেন দুহাত। প্রত্যাশায় মুখর রেখেছেন হৃদয়ের গতি। শেষ লাইন কটিতে মানবের বিজয় ঘোষণা করেছেন চমৎকার ভাবে। যে মানুষ সকল বঞ্চনা ভুলে যেতে পারে ক্ষমা করে দিতে পারে লুণ্ঠিত সম্পদের আক্ষেপ কিংবা ভুলে যেতে পারে নির্মম অত্যাচারের দগ্ধতা সুন্দরের স্পর্শে। তাই সুন্দরের প্রতি আহ্বানে মুগ্ধ রেখে পাঠককে কবিতাটির শেষটুকু রেশ রেখে যায় মনে অনেক্ষণ।
মাহিদুল ইসলাম আমার দেখা আমার ধারণায় একজন জাত আবৃত্তিকার। রক্তে রক্তে তার শব্দ বাক্য গভীরতর প্রক্ষেপনের দীক্ষা আর আবেগের চুড়ান্ত কিন্তু সুনিয়ন্ত্রিত প্রকাশের মিথস্ক্রিয়ায় আবৃত্তিগুলোকে বরাবর করে তোলেন অসাধারণ। তার অতিরিক্ত একটি সুবিধা হলো জন্মগতভাবে প্রাপ্ত অসাধারণ ভরাট কণ্ঠ। কিন্তু সেই কণ্ঠ নিয়ে কজনই বা খেলতে পারে। বহু বিশিষ্ট আবৃত্তিকারকেই আমি দেখেছি শব্দে শব্দে ভরাট গলায় কবিতার বারোটা বাজাতে। কারো তো নিজের ভরাট কণ্ঠের আতিশয্য এতটাই প্রবল যে কখন কবিতাটি চিৎকার হয়ে উঠছে কখন তা মিন মিন করছে বোধেই থাকে না। মাহিদুল ইসলামকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি- দিনের পর দিন দেখেছি কবিতার আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণে। কি নিজের কবিতার আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণ কি আমাদের নির্মাণ শিখিয়ে তোলা সবটাতেই বড়ো বেশি খুঁতখুঁতে। ঠিকঠাক শব্দ প্রয়োগে সাবধানতা আবেগের সঠিক ব্যবহার স্টেজে মাইক্রোফোনে মহাপ্রাণ শব্দ অল্পপ্রাণ শব্দের থ্রোয়িং কিংবা শব্দের অন্তে অল্পপ্রাণ শব্দকে কি করে টেলড্রপে না নিয়ে উচ্চকিত করতে হবে তার বিশেষ শিক্ষার প্রকাশ তার আবৃত্তিতেও সুস্পষ্ট। আমি সত্যিকার অর্থে মাহিদুল ইসলামকে দেখেছি একটি কবিতার সার্থক আবৃত্তির রূপায়ণে একজন পরিশ্রমী মানুষ ‍রূপে। অাবৃত্তি শিল্পের প্রতি কমিটেড একজন বিশিষ্ট প্রেমিকরূপে। শ্রমিকের মতো খেটেছেন দিনের পর দিন। ঘর বাড়ি সংসার চাকরি ব্যবসার সবকিছু ফেলে রেখেও পড়ে থেকেছেন একটা সময় আবৃত্তি নিয়ে। দিনের পর দিন দলের অন্যান্যদের রিহার্সেল শেষ করে নিজেরটা নিয়ে যখন বসেছেন তখন হয়তো তার প্রেরণা কিংবা শক্তির অবশেষ খুব ক্ষীণ। তবু স্টেজে তিনি দুর্জয়। আমি যতদিন দলে কাজ করেছি ততদিন তাকে বড় বড় কোনো কবিতাও সামনে কাগজ রাখতে দেখিনি। মুখস্ত করে আত্মস্থ না করা অবধি তিনি স্টেজে ওঠেননি। আজকাল কি করেন তা আমার জানার মধ্যে নেই। অভিমানের খেয়া আবৃত্তিটি আমি সেই সতেরো বছর বয়সেই তার কণ্ঠে শুনে নিয়েছিলাম। আর তারই বছর দু্ই পর নিজের চোখের সামনে দেখেছিলাম স্টেজে উপস্থাপনের জন্য নির্মাণের সেই অসাধারণ শ্রম। দেখেছি অনবদ্য ভালোবাসায় কবিতা পাগল আবৃত্তিমুখর তুখোড় এক যোদ্ধাকে। তারই ফলে সেদিনও অসাধারণ একটি কবিতার আবৃত্তিযোগ্য নির্মাণের ফসল শ্রোতা দর্শক দেখতে ও শুনতে পেরেছিল। মুগ্ধচিত্ত হরণ করে যা আজও স্মরণ করে দেয় কবিতার সাথে অসাধারণ দিনযাপনের ইতিহাস।
চলুন পুরো কবিতাটি একবার পড়ি..

এতদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই
পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।

প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,
নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-
এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন!
কিছুটাতো চাই, হোক ভুল – হোক মিথ্যে প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক-জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন-আর কতোদিন?
ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতটা বিলাবে?
কতো আর এই রক্ত তিলকে তপ্ত প্রণাম!
জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়?

এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটেনা শাখায়।

তুমি জানো নাই – আমি তো জানি,
কতটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে এতো গান, এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে, বলি এইতো জীবন,
এই তো মাধুরী এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।

তুমি জানো নাই – আমিতো জানি
মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে
মাংশের ঘরে আগুন পুষেছে,
যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নিলীমা চেয়েছে শুধু,
করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।
পরাজয় এসে কণ্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা
চিতার চাবুক মর্মে হেনেছ মোহন ঘাতক
তবুতো চাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,
পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।

বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ,
পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায় –
ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন?
নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতটা জীবন?
কতোটা জীবন!!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।