মেহফিল -এ- কিসসা রঞ্জনা বিশ্বাস

ধন্যি রাজা                                   

অনেকদিন আগে এক দেশে এক রাজা ছিল।দেশটার নাম ছিল বঙ্গ । বঙ্গের  রাজা  খুব ভালোবাসতেন প্রজাদের। তিনি ছিলেন তাদের বন্ধু। বঙ্গের লোকেরা তাই তাকে বঙ্গবন্ধু বলে ডাকতো। মাস কয়েক হলো দেশটা স্বাধীন হয়েছে, শত্রæ মুক্ত হয়েছে। প্রায় ত্রিশ লাখ লোক শহিদ হয়েছে যুদ্ধে।  দেশের সবাই শোকে কাতর। যুদ্ধে কারো ভাই মারা গেছে , কারো বাবা, মা, বোন। কারো মারা গেছে ছেলে। রাজাও  তাদের  কষ্টে কষ্ট পাচ্ছেন। তাই  প্রজাদের সুখের জন্য কি করা যায় ভাবছেন রাজা। একদিন রাজা সভাঘরে সভা ডাকলেন। তিনি সভাসদদেও বলেন,‘ নয় মাস আমরা যুদ্ধ করেছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের সময় যারা শত্রæদের সাহায্য করেছে, যাদের কথায় আমার দেশের মানুষ মারা হয়েছে, আমি তাদের বিচার করবো। যাও, তাদের বন্দী করো।’
এদিকে রাজা যে ঘরে বসে সভা করেন,  সেই ঘরে ছিলো দুটো আলমারি। একটা বইয়ের আলমারি আর একটা কাপড়ের আলমারি। বইয়ের আলমারিতে ছিলো অনেক অনেক  বই। এরিস্টটল, প্লেটো, কার্ল মার্কস থেকে শুরু করে দেশের নতুন কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বইও বাদ ছিলো না। রাজা বই পড়তে খুব ভালোবাসেন। এতটাই ভালোবাসেন যে,  যুদ্ধের সময় শত্রুরা যখন  তাকে জেলে আটকে রেখেছিলো তথনও তার কাছে থাকতো বই।   রাজা হবার পর তিনি নিজ হাতে বইয়ের আলমারিটা তৈরী করান। দেশের নামকরা দারুশিল্পী দিয়ে আলমারিটার গায়ে নকশা খোদাই করান। একটু  অবসর পেলেই রাজা নিজ হাতে বই আর বইয়ের আলমারি পরিস্কার করেন। বইয়ের আলমারির পাশেই ছিলো রাজার কাপড়ের আলমারি। রাজা নিজ হাতে কখনও সে আলমারি খুলতেন না। রাজার কাপড়ের দরকার পরলে রাণি নিজে এসে আলমারি খুলে রাজাকে পোষাক বের করে দিতেন। ফলে সেই আলমারিতে রাজার হাত পরে কালে ভদ্রে। একারণে কাপড়ের আলমারিটা হিংসে করতে শুরু করে বইয়ের আলমারিকে। প্রায়ই সে রাজাকে নিয়ে খোঁচা দিয়ে কথা বলে। এতে বইয়ের আলমারি কষ্ট পেলেও কিছু বলে না। তার কোনো অহংকার নেই।
যুদ্ধের সমযে যারা শত্রুদেও সাহায্য করেছে বঙ্গ দেশের লোকেরা  তাদের বলে রাজাকার।  রাজার আদেশ পেয়ে সৈন্যরা  সেই সব রাজাকারদের  ধরে বন্দী করতে লাগলো। এদের মধ্যে একজন মহিলাও ছিলো। লোকে তাকে মিসেস চৌধুরী  নামে চিনত। তার ছিলো তিন মাসের এক দুধের শিশু। শিশুটি তখনও মায়ের বুকের দুধ খায়। বাইরের খাবার খেতে সে শেখেনি। কাপড়ের আলমারি  এই খবর শুনে   বইয়ের আলমারিকে বলল,‘ তোর রাজা নির্দয়। বই পড়ে পড়ে সে হয়েছে হৃদয়হীন’। বইয়ের আলমারি শান্তভাবে বলল,‘ তিনি বিজ্ঞ বিচারক। সময় হলেই তা জানতে পারবে।’ শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো কাপড়ের আলমারি।
একদিন বিকালে রাজা বইয়ের আলমারিটা খুলে একটা বই নিয়ে আয়েস করে বসেছেন আরাম চেয়ারে। বইটা কেবল খুলেছেন পড়বেন। এমন সময় এক লোক সভাঘরে এলো। তার কোলে ছোট্ট এক শিশু। শিশুটা কাঁদছে। চিৎকার করে  কাঁদছে ,কিছুতেই কান্না থামছে না। তাই দেখে কাপড়ের আলমারিটা নড়েচড়ে উঠলো। এরপর সে বইয়ের আলমারির দিকে তাকালো। বললো, ‘এই বাচ্চাটা নিশ্চয়ই সেই মহিলার? দেখা যাক তোমার রাজা এখন কী করেন।’ বইয়ের আলমারি বলল,‘ তিনি কোনো ভুল বিচার করবেন না।’ শুনে, কাপড়ের আলমারি হাসল।
লোকটা বললো,‘ মহারাজ, আজ কদিন ধরে এই বাচ্চাটাকে কিছুই খাওয়াতে পারছি না। সে কেবলই কান্না করছে। কোনো কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না।  মায়ের জন্য সে কেঁদেই চলছে।’
রাজা হাতের বইটা বন্ধ করে টেবিলের ওপর রেখে দাঁড়ালেন। তারপর নির্দেশের সুরে বললেন,‘ বাচ্চাটাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও।’
রাজার নির্দেশ শুনে কাপড়ের আলমারি হেসে উঠলো। বলল,‘ এবার তোমার রাজা বাচ্চাটাকেও জেলে পাঠাবে!’ বইয়ের আলমারি বলল,‘ দেখো , মহারাজ বিজ্ঞ মানুষ। ন্যায় বিচারক।’ ‘সে দেখা যাবে’ বলে কাপড়ের আলমারি মুখ বাঁকা করে হাসল।
লোকটার কোলে বাচ্চাটা তখনও চিৎকার করে  কেঁদেই চলছে। লোকটা বলল,‘ মহারাজ, ওর মাকে
তো আপনার সৈন্যরা ধরে এনেছে। এখন সে জেলে।’
শুনে, সেনাপ্রধানকে ডাকলেন রাজা।
‘ এই শিশুর মাকে ধরে এনেছ কেন?’
‘মহারাজ, আপনার হুকুম। শিশুটির মা রাজাকার।’ বলল, সেনাপ্রধান।
‘ঠিক আছে। ওকে ছেড়ে দাও’- রাজা নির্দেশ দিলেন সেনাপ্রধানকে।
সেনা প্রধান বলল, ‘মহারাজ তা কী করে হয়! সে তো অপরাধী। তার কারণে অনেক শিশু মাতৃহীন হয়েছে, অনেক মা সন্তন হারিয়েছে। তাকে ছেড়ে দিলে যে আপনি আইন ভঙ্গকারী হয়ে যাবেন?’
এবার বইয়ের আলমারির দিকে আড় চোখে তাকালো কাপড়ের আলমারি। হাসলো সে। বইয়ের আলমারি চুপ কওে রইলো। সে জানে রাজা ন্যায় বিচারক। রাজা সেনাপ্রধানকে বললেন,‘ শিশুটির মা অপরাধ করেছে কিন্তু শিশুটির কী অপরাধ? যাও , ওর মাকে ছেড়ে দাও।’ সেনাপ্রধান চলে গেল।
এবার কাপড়ের আলমারি বলল, দেখলে তো তোমার রাজা আইনভঙ্গকারী!’ বইয়ের আলমারি হাসলো। বলল, ‘তোমার মাথায় যদি বুদ্ধি থাকতো তাহলে দেখতে, তিনি কতটা হৃদয়বান। দেখতে পেতে, তিনি কিভাবে শিশুর অধীকার রক্ষা করলেন। তিনিই মহান বিচারক যিনি হৃদয় দিয়ে বিচার করেন।’ শুনে কাপড়ের আলমারিটা মুখ মলিন করে  এক কোণে বসে রইলো। রাজা বইটা নিয়ে  আলমারির কাছে এলেন। বইটা আলমারিতে রেখে  আলমারির গায়ে হাত বুলিয়ে কপাটটা বন্ধ করলেন। বইয়ের আলমারিটা রাজাকে নীরবে অভিবাদন জানালো আর আবেগে গদগদ হয়ে বলল, ধন্যি রাজা! বঙ্গদেশের ধন্যি রাজা!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।