মেহেফিল -এ- কিসসায় সালাহ উদ্দীন আহমেদ জুয়েল

নিষিদ্ধকথক

১.
“সবুজ ছাতা মাথায় লাল শাড়িতে গুটিসুটি বসে থাকা শালুককে দূর থেকে টম্যাটোর মতো লাগছিলো। জানালাম সেটা। তাকালো কটাক্ষে। চৈতি হাওয়ায় কপালের চুলগুলো উড়ছে। বসলাম অল্প দূরত্বে। সেই মিষ্টি হাসি, যে হাসি তীক্ষ্ণ একরকম ব্যথা অনুভব করায় বুকের বাঁ-ধারে। হাতটি বাড়িয়ে দিলো। কার্ড, বিয়ের। ওটি আমিই ছেপেছি। আগামী পরশু ওর বিয়ে। হাসলাম, মৃদু। হাতটি বাড়িয়ে দিলাম। নিয়োগপত্র, চাকরির। তাকিয়ে রইলো, কাগজটির দিকে নয়, আমার চোখের দিকে। ওখানে কী খোঁজে? বিষাদ? গৌরব? প্রতিশোধস্পৃহা? অনুনয়? নাকি ঘৃণা? ডান গাল এগিয়ে দিলো আমার নিঃশ্বাসের দূরত্বে- ‘টম্যাটো ছুঁতে ইচ্ছে করে? শেষ সুযোগ।’

উঠলাম। পাশাপাশি হাঁটলাম, অনন্তকাল। রিকশায় উঠলো। পা-দানিতে আটকে যাওয়া শাড়ির পাড় তুলে দিলাম, সযত্নে। বাড়িয়ে দিলো হাত- ‘ওঠো।’

বেরুলাম, কাজি অফিস থেকে, দু’জনে।”

এটুকুই। এরপর পুরো ডায়েরি খালি।

২.
শালুকের বাবা তাকিয়ে রয়েছেন সাব-ইন্সপেক্টর দুলালের দিকে, টকটকে লাল চোখে। দুলাল তাকিয়ে রয়েছে ডায়েরির পাতাটির দিকে। ‘এই ডায়েরি আপনার কাছে কিভাবে?’- প্রশ্ন, দুলালের।

“অর্জুনের ঘরে পেয়েছে, শালুকের মা। অর্জুন, ঐযে, আমার ভাইয়ের ছেলেটা। দেখেছো না! মা-বাপ নেই। আমাদের বাসায়ই থাকতো।”- রাগে গরগর করতে করতে জানালেন ভদ্রলোক।

“আহমেদ আঙ্কেলের পুত্র?”- আগ্রহ বাড়ছে দুলালের।

“হ্যাঁ, আমার বড়ো ভাই ছিলেন উনি।”- কণ্ঠ কাঁপলো শালুকের বাবার।

“মা-বাবা দু’জনেই নেই! কিভাবে?”- রহস্য ভালো লাগে দুলালের।

“অ্যাকসিডেন্ট ছিলো ওটা। অটোরিকশাকে মেরে দিয়েছিলো ট্রাক। অর্জুন তখন মাধ্যমিকে।”- জানালেন বিরক্ত অর্জুনের চাচা।

“মিস শালুককে পাচ্ছেননা কখন থেকে?”- মূল প্রসঙ্গে সাব-ইন্সপেক্টর।

“গত রাত থেকে। মোবাইলটিও বন্ধ করে রেখেছে। গতকাল সন্ধ্যায় ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো নাকি খুব। আর কেবলই বলছিলো, অর্জুন চাকরি পেয়েছে মা।”- আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন ভদ্রলোক।

“আচ্ছা, ঠিকাছে। আপনি আসুন আঙ্কেল। আপনার অভিযোগের তদন্তে নামছি আমি।”- ঘটনার সমাপ্তি টানলো দুর্ধর্ষ প্রতিভাবান পুলিশ কর্মকর্তা দুলাল। আসলে, ঘটনার সূত্রপাতই করলো সে।

৩.
অর্জুনের পাশে বসে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে শালুক; মুখে সেই তীক্ষ্ণ হাসি। অর্জুন হাতের মুঠিতে চেপে ধরে আছে শালুকের মুঠি; অল্প কাঁপছে সে। অন্য হাতে, শালুক আলগোছে ছুঁয়ে দিলো স্বামীর কাঁধ; যেনো জানালো জীবনসাথীর সত্যতম সেই উচ্চারণ- “আছি তো!”

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ধীরে, অতি শান্তভাবে এমন সব বাক্য বলে চলেছে তদন্ত-কর্মকর্তা দুলাল, যা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে অনেকের! কেউকেউ নিজেদের হৃদযন্ত্রের ঢিবঢিবও শুনতে পাচ্ছে! তাকে থামাতে গিয়েও বাদী পক্ষের লইয়্যার কী এক সম্মোহনী প্রভাবে থেমে গেলেন! দুলাল বলে চলেছে- “মহামান্য আদালত, আহমেদ তালুকদার যেদিন ফজল তালুকদারের মাস্টারপ্ল্যানে সস্ত্রীক খুন হন, তার পরের দিনই মিস শালুককে বুকে চেপে ডুকরে কেঁদেছিলেন মিসেস ফজল। তিনি আবার স্বামীকে মোটামুটি যমের মতোই ভয় পান। ধীরেধীরে সবই জেনে যায় শালুক। অর্জুন চাচার দয়াতেই বড়ো হতে থাকে। অর্জুন বেঁচে আছে কেনো? একটিমাত্র কারণে- শিশুকাল থেকেই সহজসরল ভাইপোটি, ভাইয়ের প্রপার্টি আত্মসাতের পথে কোনোই বাঁধা নয়, জানতেন জনাব ফজল তালুকদার। এবং, তাঁর হিসাব চুলচেরাই ছিলো।
শালুক। পিতার তীক্ষ্ণ মেধা ও সাহস পেয়েছে। তবে তার পিতার দুর্ভাগ্য, হৃদয়টা সে পেয়ে গেছে মায়ের। জিনেটিক সায়েন্সের সমন্বয়-বিন্যাস। প্রথমে দয়া করতো সে অর্জুনকে। কাপুরুষ ডাকতো মনেমনে। দয়া রূপান্তরিত হলো সহানুভূতিতে। অত:পর প্রেম। নিখাদ নিটোল ভালোবাসা। অর্জুনের সাহসী পদক্ষেপের জন্য এমনকি অন্য পুরুষকে বিয়েতে মত দিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে সে। যখন দেখলো, ভয়াবহ চাচার ভয়ঙ্কর মানসিক নির্যাতনে পর্যুদস্ত এ ন্যুব্জ যুবককে এভাবে নয়, বুকে লুকিয়ে মানুষে পরিণত করতে হবে, তখনই বিয়েটি করে ফেলেছিলো ওরা। যেকোনো পরিণতির জন্য সদা প্রস্তুত সুদৃঢ় নার্ভের অধিকারিণী মিস শালুক, হবু স্বামীর চাকরিটাও আদায় করে দিয়েছিলো অর্থক্ষমতায়।
যাইহোক। মহামান্য আদালত, সামগ্রিক তদন্তে গিয়ে আমি জানতে পারলাম, ডায়েরির লিখাটি বিয়ের পরপরই শালুকের চাপাচাপিতে লিখেছিলো অর্জুন। মিসেস তালুকদার ও শালুকের পরিকল্পনাটি অতি নিখুঁত ও উঁচুমানের মানবিকতাসম্পন্ন। তাঁদের প্রয়োজন ছিলো পুলিসস্টেশন পর্যন্ত পৌঁছানো, এবং সেটা তালুকদার সাহেবের মাধ্যমেই।
তবে, একটি আশঙ্কা তাঁদের আগাগোড়াই ছিলো। সেটা তাঁদের নাগালের বাইরের বিষয়। যেটা অর্থক্ষমতার দাপটেও সম্ভব নয়। একজন বিশ্বস্ত তদন্ত কর্মকর্তার হাতে, মাতা-কন্যার হাতে থাকা বিগত ষোলো বছর ধরে লুকিয়ে রাখা হত্যারহস্যের প্রমাণসমূহ, তুলে দেওয়া। তাঁরা কেনো ভাবলেন, আমি ঘুষখোর নই? তাঁরা কিভাবে নিশ্চিত হলেন, তালুকদার সাহেবের পক্ষে আমাকে কেনা সম্ভব নয়? তাঁরা কেনো ভাবলেন, এ পুলিসস্টেশনে আমার আসার দু’মাসের মাথায়ই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা প্রয়োজন? তাঁরা কোন্ সমীকরণে নিশ্চিত ছিলেন, তালুকদার সাহেব মামলা করবেনই? এবং, সে মামলার তদন্তভার আমার উপরেই বর্তাবে?
অতি সহজ।
তাঁরা জানতেন, প্রচণ্ড রগচটা মনোভাবের প্রভাবে জনাব তালুকদার মামলার করণে পরিবারের মানহানি হওয়ার বিষয়টা বেমালুম ভুলেই যাবেন। পাশাপাশি, স্ত্রীর অল্প উস্কানিতে তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্যই হয়ে পড়বেন। এবং, জানতেন আমার কাছেই আসবেন তিনি। কেনো?
কারণটি স্বাভাবিক।
আমার সাথেই কন্যার বিয়ে ঠিক করেছিলেন তালুকদার সাহেব।

মহামান্য আদালত, মামলাটির তদন্তভার নিজ আগ্রহে আমিই চেয়ে নিয়েছি, ঊর্ধ্বতনের কাছ থেকে, সমস্ত নিয়ম মেনেই। এবং, আপনার কাছে, আমার বক্তব্যের সপক্ষে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ সাবমিট করলাম আমি।”

৪.
মামলাটি কয়দিন চলেছিলো, আমি জানিনা। জাগতিক ব্যস্ততায়, রায় কী হয়েছিলো তার খবরও আর নেওয়া হয়নি। তবে, সেদিনের আদালতে শোনা মানবেতিহাসের শ্রেষ্ঠতম একটি অব্যক্ত ছোট্ট বাক্য আমি হয়তো আমৃত্যু ভুলতে পারবোনা; একজন বিহ্বল যুবকের কম্পমান কাঁধ আলগোছে ছুঁয়ে তার জীবনসাথীর সত্যতম সেই আশ্বাস- “আছি তো!”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।