মেহেফিল -এ- কিসসায় হুমায়ূন কবীর ঢালী

সেই ছেলেটা

ঘরের দাওয়ায় বসে তরকারি কুটছিলেন সাহেরা বেগম। তাড়াতাড়ি চুলায় রান্না চড়াতে হবে। ভাত খেয়ে স্বামী লুৎফর রহমান কোর্টে যাবেন। গোপালগঞ্জে। অনেকখানি পথ। পানি-পানতা খেয়ে কি আর এতদূর যাওয়া যায়? তার ওপর সেরেস্তাদারের চাকরি, ভীষণ ঝামেলার। মাথা খাটাতে হয় জবর।

স্বামীকে বিদায় করে ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে হবে। ছেলেটা যা দূরন্ত হয়েছে না! ওকে সামাল দিতে দিতে মাথার চুল সব পেকে যাওয়ার উপক্রম। এই বয়সেই ছেলে বিচার-আচার করে বেড়ায়। নেতার মতো দৌড়-ঝাপ করে। কার কী সমস্যা তা নিয়েই ব্যস্ত। কার ঘরে খাবার নেই, কার গায়ে পোশাক নেই। এই নিয়ে ছেলের রাজ্যের ভাবনা। এমন পাগল ছেলে সামাল দেয়া কি চাট্টিখানি কথা! তার ওপর ছেলের বাপের খবরদারি। ছেলেকে দেখেশুনে রেখো। কোথায় যায় কী করে খেয়াল রেখো। কারও সঙ্গে  মারামারি, ঝগড়াঝাটি যেন না করে। ঠিকমতো লেখাপড়া করে কিনা আমাকে জানিও।

ছেলেকে নিয়ে বাবা শেখ লুৎফর রহমানের ভাবনার শেষ নেই। ছেলে লেখাপড়া শিখে উচ্চশিক্ষিত হবে। সৎ পথে চলবে। তিনি যেমন অন্যায়, অসত্য, নির্যাতন, ভয়-ভীতির কাছে কখনও মাথা নত করেননি, ছেলেও তার আদর্শে বড় হবে। এজন্য ছেলেকে তিনি কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন। নিজ কর্মস্থল মাদারীপুরে। মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তিও করেছিলেন। সেখানে বছর দেড়েক যেতে না যেতেই ছেলে আক্রান্ত হলো বেরিবেরি রোগে। এই রোগ থেকে চোখের ভীষণ অসুখ দেখা দিল। যার নাম ‘গ্লুকোমা’। এতে সাময়ীকভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় ছেলের। চিন্তায় চিন্তায় শেখ লুৎফর রহমান ভেঙে পড়েন। এরইমধ্যে তিনি মাদারীপুর থেকে গোপালগঞ্জে বদলি হন। গোপালগঞ্জে নিয়ে এলেন ছেলেকে। বন্ধুবান্ধবরা পরামর্শ দিলেন চিকিৎসার জন্য ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে যেতে। ছেলেকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন লুৎফর রহমান। কলকাতার চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমদ কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের চোখ অপারেশন করেন। অপারেশন সফল হলো। কিন্তু ডাক্তার পরামর্শ দেন চশমা নেওয়ার জন্য। ছেলেকে চশমা কিনে দিলেন লুৎফর রহমান। চোখ ভালো হয়ে যাওয়ার পর ছেলেকে গোপালগঞ্জ মিশনারী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন।

সেই থেকে মিশনারী স্কুলেই লেখাপড়া করছে ছেলে। বাড়িতে থাকার কারণে যত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে মাকে। মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও ছেলের সব আবদার-আরজি মেনে নিচ্ছেন। মনে মনে আশায় বুক বাঁধছেন, ছেলে তো আর খারাপ কিছু করছে না। মানুষের উপকারই করছে। এরপরও ছেলেকে সবসময় সাবধান করেন মা সাহেরা বেগম।

ছেলে এবার ক্লাস এইটে পড়ছে। স্কুলের স্যারদের প্রিয় ছাত্র। প্রিয় সহপাঠিদের কাছেও। প্রিয় হবেই না বা কেন? সহপাঠি কারও কোনো সমস্যা হলে সবার আগে তো তাকেই পাওয়া যায়। স্কুলের কোনো সমস্যায় তাকে থাকতে হবেই। কোথায় নেই সে?

এরই মধ্যে স্কুলে চাউর হয়ে গেল, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মিশনারী স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। সঙ্গে থাকবেন খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই নিয়ে স্কুলে সাজগোজ আর আনন্দের বন্যা।

অভিভাবক, শিক্ষকরা তৎপর হয়ে উঠলেন তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে। টুঙ্গিপাড়া গ্রামেও আনন্দ। কিন্তু ছেলের স্কুলে দেশের প্রধানমন্ত্রী আসবেন, এই নিয়ে চিন্তায় আছেন মা সাহেরা বেগম। তার চিন্তা ছেলেকে নিয়ে। ছেলেকে তিনি বেশ ভালো চেনেন। ছেলের সাহসের কথা বেশ জানা আছে তার। প্রধানমন্ত্রীর সামনে আবার কী কান্ড বাঁধিয়ে বসে কে জানে! এই নিয়ে ছেলেকে ডেকে বারকয়েক সাবধানও করে দিলেন।

দেখিস বাপধন, এমন কিছু করিস না, যাতে তোর বাবার মুখ ছোট হন।

ঠিক আছে।

এইটুকু বলেই ছেলে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। সময় নেই। এক্ষুনি যেতে হবে স্কুল হোস্টেলে। বন্ধুদের নিয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ করতে হবেÑ স্কুলের ছাত্রদের স্বার্থে কী করা যায়?

বন্ধুদের সঙ্গে বসল সে। বোঝাল কী করতে চায়। বন্ধুরাও সায় দিল তার কথায়। তৎপরতা বেড়ে গেল তাদের। কারোর ভেতরেই যেন ভয় নেই। কেননা তাদের নেতৃত্বে যে রয়েছে সে কখনো অন্যায় কিছু করে না। কিন্তু তাদের তৎপরতার কথা অন্যকাউকে জানানো যাবে না। শিক্ষকদের তো নয়ই। বারবার শিক্ষকদের বলেও যখন কোনো সুরাহা হয়নি, বিষয়টা ফয়সালা করবে তারাই। হোস্টেলের ভাঙা ছাদের নিচে বৃষ্টির পানিতে ভিজে লেখাপড়া করা যায় না। বইপত্র, বিছানা ভিজে যায়। এই সমস্যার সমাধান দরকার। যে করেই হোক, এই দাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতে হবে তাদেরকে।

যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী এলেন স্কুল পরিদর্শনে। পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রী ডাকবাংলোর দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। ছেলেটি খেয়াল করল হোস্টেলের সমস্যার কথা শিক্ষকরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কিছুই বলেননি। তাই যা বলার তাকেই বলতে হবে তাহলে। দেরি না করে অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে প্রধামন্ত্রীর পথ আগলে দাঁড়াল সে।

প্রধানমন্ত্রী প্রথমে থমকে গেলেন। হঠাৎ ছাত্রদের উপস্থিতিতে স্কুলের প্রধান শিক্ষকও হতভম্ব। তিনি এগিয়ে গেলেন। ছাত্রদের বললেন পথ ছেড়ে দিতে। ছেলেটা প্রধান শিক্ষকের কথায় কর্ণপাত করল না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করল।

প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিলেন। পাশে দাঁড়ানো এসডিওকে নির্দেশ দিলেন হোস্টেল মেরামতের জন্য।

এতক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর পেছনে দাঁড়িয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ছেলেটার সৎসাহস, কর্তব্যবোধ তাঁর মনোযোগ কাড়ল। তিনি মাথা নেড়ে নেড়ে কিছু একটা ভাবলেন! এরপর প্রধানমন্ত্রীসহ ডাকবাংলোর দিকে এগিয়ে গেলেন।

ডাকবাংলোতে ফিরেই সোহরাওয়ার্দী লোক মারফত ডেকে পাঠালেন ছেলেটাকে। তার সঙ্গে কথা বললেন। কলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন এই ছেলে একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবেই। দেশের জন্য, আগামীদিনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য এমন ছেলেকেই দরকার।

ভাবনা মিথ্যে হয়নি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। একদিন সত্যি সত্যি এই ছেলেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলল। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করল। এই ছেলেটার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের জাতির জনক।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।