মেহেফিল -এ- কিসসা, অরণ্য পারভেজ  

অর্ধাঙ্গিনী

অনু ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলল, ডিপ ফ্রিজে এক সপ্তাহের খাবার রান্না করা আছে। তুমি খাবার আগে শুধু একটু কষ্ট করে গরম করে নিবা। কি পারবা তো? আমি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে বললাম, হু। তারপর অনু আলমারি থেকে অনেকগুলো শাড়ি বের করে বিছানার উপর রাখল, সেখান থেকে একটা শাড়ি হাতে নিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, মেরুন রঙের এই শাড়িটা বিয়েতে পড়লে কেমন হবে? আমি আবার মাথা নেড়ে বললাম, হু ভালো। অনু শাড়িখানা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি। অনুর বারবার হাত নড়াচড়াতে ওর হাতের চুড়িগুলো কেমন রিনিঝিনি বাজছিলো। অনেকক্ষণ ধরেই আমি সেই শব্দ শুনছি। ঘোর কাটল অনু যখন এসে আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, কি স্যার? কি হয়েছে আপনার? খুব বিষণ্ণ লাগছে যে? আমি কিছু না বলে হেটে বিছানার উপর গিয়ে বসলাম। তারপর বললাম, কই কিছু না তো। অনু আবার ওর গোছগাছে ব্যস্ত হলো। এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবে যাচ্ছো বাড়িতে? অনু বলল, সকালেই। দারোয়ানকে দিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটিয়ে রেখেছি। ৮ টায় ট্রেন। আমি শুধু বললাম, ওহ আচ্ছা। তারপর অনেকক্ষণের নীরবতা। সে এটা ওটা গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকাতে লাগল। আরো খানিকক্ষণ পর অনু বলল, রোজ অফিস থেকে বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরবে। আমি নেই বলে যে রাত বিরাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবা তা হবেনা। আমি আবার মাথা নেড়ে বললাম, -হু। -একদম বাইরের খাবার খাবেনা। রান্না করে রেখে গেছি কষ্ট করে হলেও এই কয়দিন এগুলাই খাবা। -হু। -অফিস থেকে এসে জিড়িয়ে নিবা। তারপর গোসল সেরে ঘুম। নো রাত জেগে এল ক্লাসিকো দেখা। -হু। -কি এতো হু, হু? মুখে কথা বলা যায় না? (অনু এবার খানিকটা ভ্রু কুঁচকে বলল) -হু! -আবার হু? -সরি। -আর হ্যা, অফিস থেকে যত দ্রুত সম্ভব ছুটি নিয়ে আমাদের বাড়িতে যাবা। সবাই কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করবে। বিশেষ করে তোমার ছোট বোন অপর্ণা। -হু! এইই… আবার? কি শুরু করছো তুমি? -সরি। অনু এবার কি জানি ভেবে আমার খুব কাছে এসে বসল। তারপর, আমার হাতখানা ওর দুহাতের মুঠোয় রেখে বলল, -তোমাকে রেখে আমি আগে যাচ্ছি, তাই তোমার মন খারাপ তাইনা? -আরে নাহ। -কি করব বলো? সবাই আসবে বিয়েতে। কাজিনরা ফোন করে বারবার আগে যেতে বলছে। তোমাকেও বললাম, কিন্তু তোমার ছুটি নেই এখন। আমার কি দোষ? -আরে তোমাকে দোষ দিচ্ছে কে? তুমি বরং সব গুছিয়ে নাও। আমার ছুটি হলেই আমি চলে আসব। আর হ্যা, সকালে তোমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাবো। -উম। -অনেকরাত হয়েছে। আমি ঘুমালাম। তুমি সব গুছিয়ে শুয়ে পড়ো। -আচ্ছা। খুব সকালে অনু ঘুম থেকে উঠল। উঠে নাস্তা রেডি করে আমাকে ডেকে তুলল। দুজনে নাস্তা সেরে বের হলাম। স্টেশনে পৌঁছালাম ৭: ৪৬ এ। অনুকে ওর কম্পার্টমেন্টে তুলে বসিয়ে দিলাম। তারপর আমি বসলাম ওর পাশের সিটে। অনু এবার কিঞ্চিত অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার তুমি বসছো কেন? যাও, অফিসে যাও। তোমার দেরী হয়ে যাবে। রাস্তায় তো অনেক জ্যাম থাকবে। আমি বললাম, -একদিন দেরী হলে কিছু হবেনা। -কিন্তু ট্রেন তো এখনি ছেড়ে দিবে। -দিক না। আমি নেমে যাবো। ততক্ষণে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। আমি আরামসে অনুর পাশের সিটে হেলান দিয়ে বসলাম। ট্রেন একটু একটু করে ছেড়ে যাচ্ছে। আর অনু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কিন্তু, কিছু বলছে না। তারপর হঠাৎ…… -এই তোমার মতলব কি বলোতো? ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে অথচ তুমি নামছো না যে? -সত্যিই ছেড়ে দিয়েছে নাকি? -হ্যা। -তাহলে আর কি সামনের স্টেশনে নেমে যাবো। -এতো ঢং কই থেকে শিখছো? -ঢং এর কি দেখলে? -এটা কি? -এটা আবার কি! তোমার ট্রেনের টিকিট! -আমার টা এই যে ব্যাগে। কিন্তু, এইটা? -সেটা আমি কি করে বলব? -তাই? -তো এই সিটটা কার? যেটাতে বসে আছো? -হবে হয়তো কারো। -একটা দিবো….. (আমার দিকে থাপ্পড় এগিয়ে) মিথ্যুক কোথাকার। বলে তার ছুটি নাই। অথচ, আমার সিটের সাথে নাম্বার মিলিয়ে টিকিট কেটে রেখেছে। কিভাবে করছো? -কিভাবে আবার! তুমি যেভাবে করছো সেভাবেই। -মানে? -তোমার টিকিট ও কাউন্টার থেকে কেটেছো আমারটাও কাউন্টার থেকে কেটেছি। -এখন কিন্তু মাইর খাবা। সত্যি করে বলো বলছি। -ইয়ে মানে। তুমি যখন সেদিন দারোয়ানকে দিয়ে টিকিট কাটতে পাঠিয়েছিলে তখন আমি দেখেছিলাম। পরে দারোয়ানকে ফোন করে বলেছি আমার জন্যও পাশাপাশি সিট দেখে টিকিট আনতে। আর তোমাকে তা না বলতে, ব্যাস। -বান্দর একটা। বৌ ছাড়া একদিনও থাকা যায় না, তাই না? -উহু যায় না তো। তোমাকে না দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। -আহা, তাই? -হ্যা। -তো এতো নাটক কেন করলে? -তোমার সাথে মজা করতে আমার ভাল্লাগে খুব। বিয়ের আগে থেকেই তো দেখে আসছো। -তুমি না একটা….. -কি? -কিছুনা। -কিছুনা? -নাহ। -কিছুনা? -সবকিছু। -হা হা হা….। অনু এবার খানিকটা সরে এসে আমার কাধে মাথা রাখল। তারপর গা এলিয়ে দিলো বুকে। আমি শক্ত করে ওর হাতটা ধরে রাখলাম। হঠাৎ ওকে উঠিয়ে দিয়ে বললাম, -অনু, এই….শুনছো? -কি? -আমি যাচ্ছি অথচ ওখানে গিয়ে পরবার মতো কোনোকিছু তো নিয়ে আসিনি। -লাগবে না। -লাগবে না মানে? -রাতে তোমার মানিব্যাগে টিকিট পেয়েছি যখন, তখনই কয়েকটা শার্ট আর প্যান্ট আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছি। এখন ঠিক হয়ে বসো তো। আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে, আমি তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো। এটুকু বলেই অনু আবার আমার বুকে মাথা রাখল। আমি মুখ টিপে হাসলাম অনেকক্ষণ। তারপর ওর কানের কাছে মুখ এনে আলতো করে বললাম, পাগলিটা… ভালোবাসি খুব। সে শুনতে পেলো নাকি জানিনা। কিন্তু, মেয়েটা নড়েচড়ে আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তখন কেন জানি নিজেকে নিজে একটা কথা বারবার বলতে ইচ্ছে করছিল, অরণ্য সাহেব, আপনি বড্ড বেশী লাকি। কেননা, আপনি ভাগ্যগুণে অনুর মতো এতো ভালো একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।