মেহেফিল -এ- কিসসা ইরা সামন্ত (প্রবন্ধ)

মেমসাহেব’ ও নিমাই ভট্টাচার্য

কথাসাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্যের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একশত পঞ্চাশের বেশি। তবু অধিকাংশ পাঠকের কাছে তিনি পরিচিত ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসের জন্যই। উপন্যাস, ছোটগল্পের বাইরে তিনি লিখেছেন ‘বিপ্লবী বিবেকানন্দ’র মতো গুরুত্বপূর্ণ বইও।

সাংবাদিকতা দিয়েই পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন নিমাই ভট্টাচার্য। কলকাতায় কাজ শুরু করলেও পরবর্তীকালে দিল্লিতে প্রায় ২৫ বছর সাংবাদিকতা করেছেন। ‘বিশ্বামিত্র’ নামে একটি পত্রিকায় কাজ করতেন। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার সূত্রেই জওহরলাল নেহরু, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, মোরারজি দেশাই, ইন্দিরা গান্ধীর মতো রাজনৈতিক নেতৃবৃদ্ধের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ছিলেন তিনি। নির্জোট শীর্ষ সম্মেলন, কমনওয়েলথ সম্মেলনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীসহ বিখ্যাত নেতৃবৃন্দের সঙ্গী হয়ে প্রতিবেদন করেছেন। তাদের জীবনাচরণও দেখেছেন কাছ থেকে। এমনকি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সফরসঙ্গী হয়েও বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন তিনি। রানী এলিজাভেথের সঙ্গেও প্রায় ৬ সপ্তাহ ধরে ভারত-নেপাল ঘুরেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর দিল্লিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হলে তিনি সেসময় বঙ্গবন্ধুকে চারটি বই উপহার দিয়েছিলেন। প্রথমবার রেলমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৯৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে প্যাসেঞ্জার অ্যামেনিটিস কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন।

কিন্তু পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা থেকে সরে এসে পুরোপুরি লেখায় মনোনিবেশ করেন নিমাই ভট্টাচার্য। তার সবথেকে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেমসাহেব’ অবলম্বনে নির্মিত হয় সিনেমাও। উত্তম কুমার ও অপর্ণা সেন সিনেমাটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

নিমাই ভট্টাচার্য ১৯৩৯ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার বর্তমান মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার সরশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু জন্মের তিন বছরেই মাতৃহীন হন তিনি। বড় হয়েছেন বাবার হাতে। ১৯৪৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। দেশভাগের পর তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

কথাসাহিত্যের পাশাপাশি টুকটাক কবিতাও লিখেছেন নিমাই ভট্টাচার্য। ১৯৬৪ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাজধানীর নেপথ্যে’ প্রকাশিত হয়।

সাংবাদিকতায় থাকার সুবাদে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন সেই সময়কার রাজনৈতিক মহল এবং একই সঙ্গে গ্ল্যামারের দুনিয়াকে। যেন সেই অভিজ্ঞতা ছায়া ফেলেছে তার সাহিত্যকর্মে।

এপার এবং ওপার বাংলা মিলিয়ে তার সবচেয়ে বেশি পঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মেমসাহেব’ নিয়ে দুই বছর আগে মিন্টু চৌধুরীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘২০১৮ সালে উপন্যাসটি এ বছর প্রকাশের ৫০ বছর হয়েছে। আমি আমার ৩৫ বছর বয়সে বইটি লিখেছি। তখন আমি রিপোর্টার। ৫০ বছর ধরে একটা বই সমানভাবে জনপ্রিয় তা খুব একটা দেখা যায় না।’

মেমসাহেব বইটিতে নিজের জীবনের ছায়া পড়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি পাঠক সমাজ ভেবে নিক। তবে মেমসাহেব চরিত্রটি একেবারেই কাল্পনিক।’

ঠিক কীভাবে উপন্যাসটি লিখেছেন জানতে চাইলে নিমাই ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘তখন আমি দিল্লিতে। রিপোটিংয়ের কাজে কখনো দিল্লি, কখনো ব্যাঙ্গালোর, কখনো নেপাল বা অন্য কোথাও যেতে হতো। রিপোর্ট লিখে পাঠানোর তাড়া থাকতো। যেখানে বসে রিপোর্ট লিখতাম, এর ফাঁকে ফাঁকেই লিখেছি উপন্যাসটি। উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে  রিপোর্ট যা লিখি সেভাবেই লিখে গেলাম, আমার রিপোর্ট লেখা এক বসাতেই প্রায় অধিকাংশ সময় হয়ে যেত। সে অভ্যাসটি থাকায় উপন্যাস লিখতে পরিশ্রম অনুভূত হয়নি। উপন্যাস বা অন্য লেখাও একবারেই লিখেছি। বারবার ড্রাফট দেখা, করেকশন করার কম দরকার হতো। দেড়শ’র মতো বই বেরিয়েছে, যার অধিকাংশই উপন্যাস।’

মেমসাহেব মূলত প্রেমের উপন্যাস হলেও এখানে রয়েছে দেশভাগের কথা, এক রিপোর্টারের অজানা জীবনকথা। সাতচল্লিশের দেশ ভাগ পরবর্তী সময়ে কলকাতা শহরের লাখ লাখ বেকারের মাঝে কী করে একজন হাফ বেকার, হাফ রিপোর্টার শুধু মনের জোর আর নিষ্ঠায় ভালোবাসার শক্তিকে অবলম্বন করে কীভাবে সর্বোত্তম পদে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে এটি সেই গল্প।

উপন্যাসটির শুরু হয়েছে দোলা বৌদিকে লেখা চিঠির মাধ্যমে। পুরো উপন্যাসটিই চিঠির মতো করে লেখা। উপন্যাসের মূল চরিত্র দু’জন। একজন মেমসাহেব অপরজন এই উপন্যাসের নায়ক বাচ্চু। নিজের অনাড়ম্বর জীবনের কথাগল্প শোনাতেই একদিন চিঠি লিখতে শুরু করে দোলা বৌদির কাছে। পাঠকের চোখেকে গভীর সমুদ্রের ঢেউ দিয়ে ভিজিয়ে সুনিপুন ভাবে লেখক তুলে আনেন মেমসাহেব চরিত্রটিকে। তবে তার আগে উপন্যাসে এসেছে নায়ক বাচ্চুর জন্মকথা।
নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা প্রায় সব উপন্যাসে বিষয়গত বৈচিত্র্যতার ছাপ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। কোনো কোনো উপন্যাসে তিনি রাজধানীর অন্দর মহলের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা অভিজাত সমাজের কুৎসিত রূপের চিত্র তুলে ধরেছেন। কোথাও নীচতলার মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনকাহিনি চিত্রিত হয়েছে। কোথাও কোথাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদও লক্ষ্য করা যায়। আবার অনেক উপন্যাসে সোনালী আনন্দ দিনের বিলাপ লক্ষণীয়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।