মেহেফিল -এ- কিসসা মাহফুজা অনন্যা (প্রবন্ধ)

মহাজীবনের কবি জীবনানন্দ দাশ

এক একজন কবিকে যদি আকাশের এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সাথে তুলনা করা হয় তবে আমি বলবো জীবনানন্দ দাশ ছিলেন সবকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সমন্বয়। আধুনিক বাংলা কবিতায় এত দ্যুতি খুব কম কবিই ছড়িয়েছেন। তার কবিতার বিচ্ছুরিত আলো এখনও পথ দেখিয়ে চলেছে বাঙালি কবিদের। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লিখতে গেলেই যে পঙতিগুলি প্রথমেই চোখে ভেসে ওঠে তা হলোঃ

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, /
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; /
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই- প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই /
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

কিংবা ‘চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার /
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো – দুধে আদ্র- কবেকার শঙ্খিনীমালার! /
এ পৃথিবী একবার পায় তারে পায় নাকো আর। – (-শঙ্খমালা)

আমার জানামতে যে কয়জন বাঙালি আধুনিক কবির কবিতা মানুষের মুখেমুখে সবচেয়ে বেশি পঠিত হয়েছে তার মধ্যে কবি জীবনানন্দ দাশ অন্যতম। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তার মা কুসুমকুমারী দাশও ছিলেন একজন কবি। জীবনানন্দ দাশ ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি নিবাস ঢাকার বিক্রমপুরে গাওপাড়া গ্রামে। বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশকে শুদ্ধতম কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকবাদী পঞ্চপান্ডকের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ অন্যতম। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭সালে। কিন্তু  তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে কবি বা পাঠক মহলে তেমন সাড়া মেলেনি। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রামাণিক-ইতিহাসের রচয়িতা সুকুমার সেন ঝরা পালকে অন্তভুক্ত ‘পলাতক’  কবিতার সমালোচনা করে বলেছিলেন ‘ঝরা পালক’র একটি কবিতায় দ্বিতীয় -তৃতীয় দশাব্দসুলভ পল্লী রোমান্সের অর্থাৎ করুনানিধান- জোতিন্দ্রমোহন- কুমুদরঞ্জন -কালিদাস – শরৎচন্দ্র প্রমুখ কবি, গল্পকার ও লেখকদের অনুশীলিত ছবি পাই’। তিনি জীবনানন্দ সম্পর্কে আরও বলেছিলেন ‘ইংরেজি কবিতার অনুসরণে যাহারা বাংলায় কবিতাকে অবলম্বন করিলেন তাহাদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ প্রধান’। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় আধুনিক কবিতার কারিগর যে পাঁচজন কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৮),  বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)  এবং অমিয় চক্রবর্তী তারা সবাই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। সেই সাথে বলা যায় বাংলা কবিতায় আধুনিকতার যে বাঁক সৃষ্টি হয়েছিল তা মূলত ইংরেজি আর ইউরোপীয়ান সাহিত্যের উৎসধারা থেকেই। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ  থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয় ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি জীবদ্দশায় ৮৫০টিরও বেশি কবিতা লিখেছেন কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ২৬২ টি। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৭টি। তারমধ্যে ঝরাপালক (১৯২৭), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১) অন্যতম। এছাড়াও তার লেখা একমাত্র প্রবন্ধটির নাম “কবিতার কথা” (১৯৫৫)। তার দুটি বিখ্যাত উপন্যাস “মাল্যবান”(১৯৭৩),সতীর্থ (১৯৭৪)। সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া তার দুটি উপন্যাস “কল্যাণী” (প্রকাশ ১৯৯৯), দেশ পত্রিকা এবং “চারজন” (২০০৪, সম্পাদক ভূমেন্দ্র গূহ ও ফয়সাল শাহরিয়ার)। জীবনানন্দ দাশের মতো বাংলা সাহিত্যে কিংবা কবিতায় আর কোনো কবিকে এত বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। তাকে বলা হয় ধূসরতার কবি,তিমির হননের কবি, নির্জনতার কবি,এবং রূপসী বাংলার কবি এছাড়াও বিপন্ন মানবতার নীলকণ্ঠ কবিও বলা হয় তাকে। আধুনিক বাংলা কবিতায় কল্লোল যুগের কবি জীবনানন্দ দাশের উপর গবেষণা করেছেন ক্লিনটন বি সীলি। তার অগ্রন্থিত কবিতাবলি নিয়ে প্রকাশিত সংকলনগুলি হলো ‘সুদর্শনা’ (১৯৭৩),  ‘আলো ও পৃথিবী’ (১৯৮১), ‘মনোবিহঙ্গম’, ‘হে প্রেম তোমার কথা ভেবে’ (১৯৯৮) ‘অপ্রকাশিত একান্ন’ ( ১৯৯৯) এবং ‘আবছায়া’ (২০০৪)।  জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প ১৯৮৯ সালে সম্পাদনা করেন আব্দুল মান্নান সৈয়দ এবং তার ‘লিটারেরি নোটস’ সংরক্ষিত আছে গবেষক ভূমেন্দ্র গূহের কাছে।
নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনে ১৯৫২ সালে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ “ বনলতা সেন” কাব্যগ্রন্থটি শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত হয় এবং তার মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে “জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৫৪) সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করে।

বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক, কবি বুদ্ধদেব বসু কবি জীবনানন্দকে নির্জনতার কবি হিসেবে আখ্যা দেন। কারণ হতে পারে কবির প্রচারবিমুখতা। তিনি ছিলেন বিরসবাসি মানুষ। জীবদ্দশায় তার এই প্রচারবিমুখতার জন্য খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। তাই হয়তো কবি বুদ্ধদেব বসু তাকে নির্জনতম কবি হিসাবেই আখ্যা দিয়েছিলেন। কবি জীবনানন্দ দাশ প্রথমদিকে জনপ্রিয়তা পাননি কারণ তার রচনার প্রতি অনেকেই বিমুখ ছিলেন। একজন প্রকৃত কবির কবিতা সাধারণের বোঝা সহজ নয়,একারণেই হয়তো অনেকেই তার কবিতার প্রতি বিমুখ ছিলেন। জীবনানন্দের কবিতা পড়তে হয় ধীরে-সুস্থে, আস্তে-আস্তে বুঝতে হয়। জীবনানন্দ একজন খাঁটি কবি ছিলেন। তার প্রমাণ সরূপ একটি লাইন উল্লেখ করি -’ আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে – আকাশে’। আকাশের অন্তহীন নীলিমার দিগন্ত বিস্তৃত প্রসারের ছবিকে কবি জীবনানন্দ একটি লাইনে এঁকেছেন। একেই বলে সধমরপ ষরহব. আকাশ শব্দটির পুনরাবৃত্তি করবার জন্যই আকাশের ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে কবিতার শব্দের এমন মূল্যবোধ খুব কম কবিই দিতে পেরেছেন।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা আর সবার মতো আমাকেও মুগ্ধ করে। তার কবিতা আমাকে আলোকিত আর শিহরিত করে রেখেছে জীবনের প্রতিটি বাঁকে। কী কারণে জীবনানন্দের কবিতায় এত মুগ্ধ হই তা বলতে গেলে কমই বলা হয়। জীবনানন্দের কবিতায় মিল- অর্ন্তমিলের ব্যবহার অতুলনীয়। তার কবিতার বিষয়, উপমা, অনুপ্রাস তার নিজস্ব এবং সতন্ত্র। জীবনানন্দের কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য শব্দ, স্পর্শ, রং,রূপ, গন্ধ এবং অনুভূতিমুখর বাণী। যেমনঃ ‘ কাল রাতে- ফাল্গুনের রাতের আঁধারে /
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ /
মরিবার হলো তার সাধ।

তবে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তিনি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের জীবন এবং কবিতার উপর প্রচুর গ্রন্থ লেখা হয়েছে এবং এখনো রয়েছে বাংলা ভাষায়।  তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম এ (১৯২১) পাশ করেন। তিনি ‘দৈনিক স্বরাজ’ নামে একটি পত্রিকার সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করতেন। আধুনিক নাগরিক জীবনের হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষাদ ও সংশয়ের চিত্র তার কবিতার মূল উপজীব্য। বিশ শতকে ষাটের দশকের কবি জীবনানন্দ দাশের নিসর্গ বিষয়ক কবিতা বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশে আন্দোলন ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তীব্রভাবে এদেশের সংগ্রামী জনতাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি চিঠিতে লিখেছিলেনঃ “তোমার কবিতা চিত্ররুপময়; তাতে তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে”। রবীন্দ্রনাথের এই পর্যবেক্ষণ ভুল নয়। সত্যিই তো, জীবনানন্দের কবিতায় ছবির পর ছবি দেখা যায়। এই ছবি যেমনতেমন সাদাকালো ছবি নয়, যেন রঙিন চলচ্চিত্র। তিরিশের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দই এই গুণে গুণান্বিত ছিলেন। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যেমনঃ ‘চারিপাশে বনের বিস্ময় / চৈত্রের বাতাস / জোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন; / ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে; / কোথাও অনেক বনে – যেইখানে জোৎস্না আর নাই / পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার’  (- ক্যাম্পে) অথবা অন্য একটি একটি কবিতায় : ‘হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল? / বালতিতে টানিনি কি জল?/ কাস্তে হাতে কতবার যাই নি কি মাঠে? / মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে / ঘুরিয়াছি; / ( -বোধ)। এই দুটি উদ্ধৃতিতেই কবিতা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের চোখে একটি করে রঙিন ছবি ভেসে উঠবে। জীবনানন্দের কবিতাকে তাই চিত্ররূপময় কবিতা বলা হয়।

কবি জীবনানন্দ দাশকে ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬)  কাব্যগ্রন্থের জন্যই যে তাকে ধূসরতার কবি বলা হয় তা নয়। ঝরাপাতা, শিরশিরে হাওয়া, উর ব্যাবিলন মিশরীয় সভ্যতা -এসবই জীবনানন্দের কাব্য -বৈশিষ্ট্য। জীবনানন্দের কবিতা মানেই এক অমৃত শব্দপাঠ; এক আত্ম তৃপ্তির স্রোত বয়ে চলে পাঠকের হৃদয়ে। বন্ধ্যাযুগের যথাযথ চিত্রকল্প সৃষ্টিতে জীবনানন্দের তুলনা নেই। মৃত্যুচেতনাও তার কবিতায় প্রায় প্রথম থেকেই দেখা যায়। শ্মশান, মরুবালু, আলেয়া ইত্যাদি কবিতার পটভূমি মৃত্যু। এই মৃত্যুচেতনা যুগযন্ত্রণা থেকে উদ্ভুত। জীবনানন্দ একে জীবনে ধারণ করেছিলেন। যেমন একটি কবিতায় তিনি হতাশাভরে লিখেছেনঃ ‘বিবর্ণ জ্ঞানের রাজ্যে কাগজের ডাঁইয়ে পড়ে আছে, /  আমাদের সন্ততিও আমাদের নয়’। এরকম হতাশা আর বিবর্ণের কথা আছে তাঁর বহু কবিতায়। তার কবিতার চালচিত্রে আছে ধূসর বর্ণ। তাই জীবনানন্দ দাশকে ধূসরতার কবি বলা যুক্তিযুক্ত। জীবনানন্দ দাশের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে নিজস্ব বিষয়, ছন্দভঙ্গি, ভাষা,প্রতিভা নানা বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাই ধূসর পাণ্ডুলিপি গ্রন্থের মাধ্যমেই বাংলা কাব্যঙ্গনে জীবনানন্দ দাশের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হতে শুরু করে।
তাছাড়াও ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম। এ কাব্যের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে খ্যাত। এবং জীবনানন্দের কবিতাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ভারতীয় পুরাণের অন্তর্বয়ান যেমনঃ’ চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, / মুখ তার  শ্রাবস্তীর কারুকার্য, / এখানে বিদিশা, শ্রাবস্তী আর সিংহল সমুদ্রতীর, ছেড়ে এসে দেখি নাটোরের বনলতা সেন, পাখির নীড়ের মতো চোখ মেলে বলে ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন’ আকস্মিক এ প্রশ্নের বিস্ময়ে শিহরিত হই। কবি শ্রীলংকা থেকে নাটোরে চলে এসেছেন এক পলকে। এতো দূরকে এতো কাছে এতো অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন এবং সেখানে পাখি আর মানবের বন্ধন সেঁতু এঁকে দিয়েছেন সুচারুভাবে। একটু গভীরভাবে দেখলে দেখা যায় জীবনানন্দ মূলত পঙক্তি প্রধান কবি। তার এক একটি উপমা একটি কবিতার স্বাদ আনে এবং সে উপমা বেশিরভাগ সময়েই বক্তব্য স্বচ্ছ ও অর্থকারী করার জন্য ব্যবহার হয়না, কেবলমাত্র একটি আবহ সৃষ্টিই তার উদ্দেশ্য। ফলে স্বভাবতই জীবনানন্দের কবিতা পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কারণ জীবনানন্দের কবিতায় একটি ভাবের সাথে আর একটি ভাবের যোগসূত্র আবিষ্কার সাধারণ পাঠকের কাছে বেশ দূরূহ ব্যাপার। যেমনঃ ‘রাতের বাতাস আসে/ আকাশের নক্ষত্রগুলো জলন্ত হয়ে ওঠে/ যেন কাকে ভালোবেসেছিলাম/ তখন মানবসমাজের দিনগুলো ছিলো মিশরনীলিমার মতো’। এখানে ভালোবাসার গভীরতা বুঝাতে মিশরনীলিমার উপমা দেওয়া হয়েছে। পাঠককে এই মিশরনীলিমার উপমা বুঝে উঠতে হিমশিম খেতে হয়। জীবনানন্দ তার নিছক প্রেমের কবিতার মধ্যেও প্রকৃতির প্রলেপ দেন। কখনো বিস্মিত শিশুর দৃষ্টি দিয়ে, কখনো ক্লান্ত পথিকের নিষ্পাপ স্পষ্টতায় এক সরল ভঙ্গিমায় কোনো নবতর আত্মাকে আহবান করেন। প্রেম ও প্রকৃতি, খণ্ডজীবন, হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদ, ইতিহাসের বিশাল অনুভূতি এবং বর্তমানের ছিন্নভিন্ন অস্তিত্ব, এককথায় সমস্ত কিছুর সমাহার এই অপরূপ কাব্যে আলো ছায়ার জাল রচনা করেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে ‘উপমা কালিদাশস্য’ বলে একটি কথা আছে। সত্যিকার অর্থেই জীবনানন্দ দাশের কবিতা যেন উপমার যাদুঘর। যেমনঃ *আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে।
* তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।
* নীল আকাশে খই ক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা।
* পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
* উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।
*শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা
*অন্ধকারের মতো কালো চুল, ইত্যাদি অশ্রুত পূর্ব উপমা প্রয়োগে জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যে এক অসাধারণ ভূমিকা রেখে গেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতার শ্লথগতি, ছন্দস্পন্দ,
অভিনব শব্দপ্রয়োগ ও অন্বয়, রূপময় ইন্দিয়ালু বাক্যপ্রতিমাগুলি কাব্যকে অসামান্য মহিমা দিয়েছে। বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উপমা প্রয়োগ নিয়ে মন্তব্য করেছেনঃ ‘তার উপমা উজ্জ্বল, জটিল ও দূরগন্ধবহ’। তিনি কল্পনার সঞ্জীবনী মন্ত্রে অনুভুতি মুখর। এমন ধারা বাংলা কবিতায় সত্যিই অভিনব। তার কবিতায় এমন অনুভূতি জীবন লাভ করে, বিশ্বময়ী প্রকৃতি, জীবন, মৃত্যু, কাল সমস্ত কিছুই তার কাছে রক্ত-মাংসের মতো জীবন্ত। যেমনঃ ‘আহলাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,/ চারিদিকে ছায়া-রোদ ক্ষুদ-কুঁড়া- কার্তিকের ভিড়; / চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, / এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান, / পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালি ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ। এখানে কবি জীবনানন্দ দাশ উপমা দিয়ে হেঁটেছেন পরাবাস্তববতার পথ ধরে,কখনো ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া জনপদে,আবার কখনো ব্যক্তিবোধের গভীর অতলে। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, পুরনোর সঙ্গে নতুনের, অসম্ভবে- সম্ভবে,অবিশ্বাস্য- বিশ্বাসে,গ্রামের-নগরের, সমকালের- হাজার বছরের অদ্ভুত সংমিশ্রণ এঁকে দিয়েছেন কবিতায়।
রবীন্দ্রবলয় ছিন্নকারী ও উত্তরকালের কবিদের উপর সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারকারী কবি হিসেবে বিবেচিত হন কবি জীবনানন্দ দাশ।
কবি জীবনানন্দ দাশের রূপসীবাংলা কাব্যগ্রন্থটি ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলির গঠন সনেটে। কবি জীবনানন্দ দাশ এ কবিতায় তুলে এনেছেন বাংলার রূপকে। তিনি বিশ্বাস করতেন উপমাই কবিত্ব। বহুমুখী উপমায় বাংলার চিরায়ত রুপকে আঁকতে পেরেছেন একমাত্র তিনিই।তার কবিতার বিষয়বস্তু আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, নদীনালা, পশুপাখি, উৎসব, অনুষ্ঠান।  জনপ্রিয়তার দিক থেকে আধুনিক বাংলা কবিতা বনলতা সেন এর পরেই রূপসী বাংলার স্থান। যেমনঃ ‘আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়  / হয়তো মানুষ নয়, – শঙ্খচিল শালিখের বেশে, কবিতাটি এ গ্রন্থের বিখ্যাত উক্তি। অথবা ‘তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও-,/ আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব;/  দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;।  জীবনানন্দ তার কবিতায় বারবার বাংলাদেশে ফিরেছেন, ফিরেছেন বাংলার প্রকৃতির কাছে। আর কোনো কবির কবিতায় এমন করে বাংলাদেশ কিংবা ফুল, পাখি, জীবজন্তু আসেনি। কার্তিকের ছায়া,হেমন্তের মিষ্টিরোদ, হিজলের জানলায় আলো আর বুলবুলি, হলুদ পাতায় শিশিরের শব্দ, বুনোহাঁস, শঙ্খচিল, পেঁচা, লাশকাটা ঘর, সোনালি ডানার চিল, নক্ষত্রের তারা জ্বলা রাত, সবকিছুই জীবনানন্দের কবিতায় স্পন্দন হয়ে এসেছে। এসেছে ভালোবাসার গভীর আবেশ হয়ে। শিরীষের ডাল, অশ্বথের চূড়া, কলমির ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শাদাবক এসেছে অলংকার হিসেবে নয়, এসেছে অবয়ব হয়ে কবিতার পরতে পরতে। যেমনঃ ‘বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে; / ছড়ায় রয়েছে তারা প্রান্তরের পথে পথে নির্জন অঘ্রানে;।  এছাড়াও তার মহাপৃথিবী কাব্যের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘হায় চিল’। তার বিখ্যাত কবিতা বনলতা সেন কবিতাটি বিশ্লেষণ করলে পাশ্চাত্যের কবি অ্যাডগার এলেন পো’র ‘টু হেলেন’  কবিতাটির প্রভাব মেলে। ‘ সব পাখি ঘরে আসে -সব নদী-ফুরায় এ জীবনের লেনদেন / থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। এখানে বনলতা সেনের সাথে কবির জীবদ্দশায় মিলনের ইঙ্গিত বোঝায় না, বরং জীবনাতীতে মিলনের ইঙ্গিত বোঝা যায়, স্বপ্নে কিংবা কল্পনায়। তার কবিতার একটি লাইন ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’ এই পঙতিতে কেবল ক্লান্তির কথা নয় এর মধ্যে অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যতব্যপী পরিভ্রমণের কথা ব্যপ্ত আছে। জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় স্থির থাকেননি এক স্থানে, সতত চলিষ্ণু তার কবিতা। তার কবিতা সন্ধানী। ক্রমপরিবর্তমান। ক্রমঅগ্রসরমান। প্রেম ও মৃত্যুর মতো দুই বিপরীতকে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন অনন্য সুন্দরময়তায়। হৃদয় ও স্বপ্নকে সবকিছুর উপরে স্থান দিয়েছেন। তাছাড়া তার কবিতায় ইয়েটস,বোদলেয়ারেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শুধু কবিতা নয়, তিনি মর্মগত,সুমিত, নিরাবেগ ও সুস্থির গদ্যলেখকও  ছিলেন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত “মাল্যবান’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের মূল কাহিনী বর্ণনার ধারা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক আঙ্গিকে রচিত উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। দাম্পত্য জীবনের নিষ্ঠুর কাহিনী, জটিলতা, ও পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার বোধ এক অসামান্য কুশলতার সাথে ইঙ্গিতময় ভাষায় বর্ণিত করেছেন। ১৯৯৯ সালে খ্ুঁজে পাওয়া তার নতুন আর একটি উপন্যাসের নাম “কল্যাণী”। কবি জীবনানন্দ দাশ স্বপ্নের হাতে নিজেকে সমর্পন করলেও সবকিছুর উপরে তিনি তার হৃদয়কে স্থান দিয়েছেন। আর তাই হৃদয়ের গভীর অন্ধকারেই রচিত হয় এমন কবিতা, ‘ যে -জিনিষ বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহবরে!- / নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে / কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।

জীবনানন্দের কবিতা বহুমাত্রিক। কোনো নির্দিষ্ট কয়েকটি উপমা দিয়ে তার সমগ্র রচনাকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। জীবনানন্দীয় কবিতার জন্যই তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ের গভীর গহবরে। নক্ষত্রের চেয়েও নিঃশব্দ আসনে,প্রতিটি কাব্যপ্রেমী মানুষের মনে। ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর কলকাতার বালিগন্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় কবি জীবনানন্দ আহত হন। পরে  ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। কী স্বল্প জীবন ছিল তার! কিন্তু তার জীবনের ব্যাপ্তি এক মহাজীবনের সমান। রেখে যাওয়া বহুমাত্রিক কবিতা পড়লেই বোঝা যায় “সকলেই কবি নয়,কেউ কেউ কবি”… এই কেউ কেউ কবির মধ্যে তিনিই অন্যতম কবি, জীবনানন্দ দাশ। যার কবিতার মর্মকথা লিখে শেষ করা অসম্ভব।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।