মেহেফিল -এ- কিসসা মেহেদি রাসেল (বই নিয়ে মতামত)

যেভাবে যুদ্ধ হয়েছিল

শিবচর থানায় বেশ শক্তপোক্ত ঘাঁটি গেড়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। আশেপাশের ছোটখাটো ঘাটি আগেই দখলে নিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার। শিবচর থানার প্রায় দুর্ভেদ্য ঘাটির দখল নিতে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এটা-সেটা এগিয়ে দিয়ে, খাবার এনে দিয়ে সাহায্য করছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। কৌতূহল দমন করতে না পেরে অনেকে শুধু যুদ্ধ দেখতে জড়ো হয়েছে। এক মুক্তিযোদ্ধার ম্যাগাজিন খালি হয়ে গেলে গুলিভর্তি ম্যাগাজিন পৌঁছে দিতে গিয়ে মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ে এক কিশোর। আরেকজন এগিয়ে আসে। ম্যাগাজিন পৌঁছে দেয়। গ্রামের উৎসাহী জনতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রাজাকারেরা। কেউ কেউ পালাচ্ছে সুযোগ বুঝে। যুদ্ধের এমন টানটান উত্তেজনার চিত্র নিয়ে সোহেল রহমানের উপন্যাস ‘সেইদিন একদিন অন্যদিন’।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। লাখো মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি নিজেদের এক দেশ। সেই দেশ যারা স্বাধীন করেছিলেন, মাঠের যুদ্ধের যারা সৈনিক ছিলেন, তাঁদেরই একজন ঔপন্যাসিক সোহেল রহমান। মাদারীপুরের বেশ কয়েকটি উপজেলা ছিল তাঁর যুদ্ধের এলাকা। উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক জানাচ্ছেন, ‘১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমার সক্রিয় ভূমিকা ও অংশগ্রহণ ছিল। এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বর্ণনা করার চেষ্টা মাত্র। তবে কিছু সংলাপ সংযোজন বা বর্জন করা হয়েছে নেহায়েত কাহিনি বর্ণনার স্বার্থে।’ আমরা জানি ঘটনা থেকে মূল উপাদান নিয়ে সাহিত্যিক তাঁর নিজস্ব সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেন। এটাই সাহিত্যের রীতি।

উপন্যাসের শুরুতেই পাঠকের পরিচয় হবে স্বাধীন পাগলা নামক এক চরিত্রের সঙ্গে। স্বাধীন দেশে চরিত্রটিকে কিছুটা পাগলাটে করে দেখানো হয়েছে। তার কারণ হলো, যে আদর্শকে সামনে নিয়ে স্বাধীন যুদ্ধে গিয়েছিল, সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ন্যায় ও সাম্যের সমাজ গঠিত হয়নি। তার বিপরীতে সমাজে এখনও অন্যায়, অনাচার, বৈষম্য বাসা বেঁধে আছে। কালোবাজারী, লুটেরা, ঘুষ ও দুর্নীতিবাজদেরই জয়জয়কার এই সমাজে। মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন এসব মেনে নিতে পারে না বলেই পাগল হয়ে যায়। উপন্যাসের কাহিনি বলা হয়েছে ফ্লাশব্যাকে, স্বাধীনের ডায়রিটাই মূলত উপন্যাস। বলে না দিলেও পাঠক বুঝতে পারবে, স্বাধীন চরিত্রটির পাগলের বেশে ঘোরাঘুরি করার ঘটনাটি সংযোজন। ওটুকু ছাড়া মূলত ঔপন্যাসিক নিজের জীবনের ঘটনাই বর্ণনা করেছেন পুরো উপন্যাসে।

বলা হয়, বাস্তবতা অনেক সময় গল্পকে ছাড়িয়ে যায়। এই উপন্যাসের ঘটনাগুলো তেমনই। সিনেমাকেও যেন হার মানায়, পড়ার সময় জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঔপন্যাসিক গল্প বয়ানে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। যুদ্ধ কোনো একক ঘটনা নয়। ঘটনার ভেতরে থাকে ছোট ছোট অজস্র ঘটনা। যুদ্ধের অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এমন একটি ঘটনা, যে যুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিপুল সাড়া দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের সাহায্য ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা এত সহজে বিজয় অর্জন করতে পারত না। সেই সাধারণ মানুষের চিত্র রয়েছে উপন্যাসে। দিনের পর দিন রাজাকারদের নির্যাতন সহ্য করেও এদেশের মানুষ তাদের মনোবল হারায়নি। বরং হয়ে উঠেছে প্রতিবাদী। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্ন-বস্ত্রের পাশাপাশি সাহস যুগিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ খবর আদান-প্রদান করেছে। ঔপন্যাসিক বলছেন, সাধারণ মানুষ হলো জল আর মুক্তিযোদ্ধারা হলো মাছ। জল ছাড়া মাছের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তাদের জন্য এই উপন্যাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ কীভাবে হয়েছিল, গ্রামের মানুষের ভূমিকা কী ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে ভারতে ট্রেনিংয়ে গিয়েছিল এইসব চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। যুদ্ধের প্রতিটি ঘটনাই রোমাঞ্চকর বর্ণনায় আমাদের সামনে হাজির করেছেন সোহেল রহমান। পদে পদে বিপদের আশঙ্কা নিয়ে লড়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এমনকি সব সময় ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাদের বিশ্বাস করতে হয়েছে অচেনা লোককেও।

উপন্যাসে নারী চরিত্র চিত্রনেও সফলতা দেখিয়েছেন লেখক। অপরূপ সুন্দরী মিতা ওরফে আয়শাকে বিরূপ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে উপন্যাসের নায়ক স্বাধীন। তার সাবলীল ব্যবহারে প্রেমে পড়ে যায়। মিতাও ভালোবেসে ফেলে স্বাধীনকে। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখা যায় বন্দুক চালানো থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারদর্শী মিতা আসলে পাকিস্তানিদের গুপ্তচর। সে এসেছিল মাদারীপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত খবরাখবর সংগ্রহ করতে। শত্রুর সঙ্গে প্রণয়ে জড়ায় স্বাধীন। মিতা ও স্বাধীনের প্রেমের ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয় যেকোনো পরিস্থিতি এমনকি মৃত্যু মাথায় নিয়েও মানুষ ভালবাসতে পারে, হাসতে পারে, স্বপ্ন দেখতে পারে। তবু, কর্তব্যপরায়ণতা ও দেশপ্রেমের কাছে প্রণয় পরাজিত হয়েছিল সেদিন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মিতার মানসিক দৃঢ়তা এবং স্বাধীনের প্রতি ভালোবাসা মিতাকে এক মানবিক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। আসলে যুদ্ধের সময়ের হিসাব স্বাভাবিক সময়ের সঙ্গে মেলে না, স্বাভাবিক সময়ের হিসেবে তাকে বিচার করতে যাওয়াও সঙ্গত নয়।

উপন্যাসের আরেকটি নারী চরিত্রও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অপরাধে রাজাকার স্বামীর হাতে অনায়াসে প্রাণ দেয়। আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানুষের সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগের কাহিনি এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত উপন্যাসটি আমাদের বারবার চমকে দেয়। যেন রোমাঞ্চকর কোনো কাহিনির রাজ্যে ঢুকে পড়ি আমরা। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, আদর্শের প্রতি ভালোবাসা এত প্রবল যে মানুষ প্রাণের মায়া করে না। প্রাণ যেমন সে দিতে পারে আদর্শের জন্য, তেমনি প্রাণ কেড়ে নিতেও পারে। সহযোদ্ধাকে হারিয়ে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার কথা আছে এ উপন্যাসে। এমনকি একজন ভিক্ষুকও যে যুদ্ধের বাস্তবতায় তার ভিক্ষালব্ধ সবকিছু দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। এমন সব ঘটনা থেকেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বুঝেছিলেন, বিজয় আসন্ন। যে জাতির সাধারণ মানুষ দেশের জন্য এমন আত্মত্যাগে প্রস্তুত থাকে, তাদের দমন করা কারো সাধ্য নেই।

যুদ্ধকালীন সমাজ বাস্তবতার একটি চিত্র এই উপন্যাসে লক্ষণীয়। রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসন ভেঙ্গে পড়লে সুযোগসন্ধানী মানুষ কত বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে, তার কিছু কিছু নমুনা উপন্যাসে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সরকারি চাকুরিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে একটা বিতর্ক প্রায়শই শোনা যায়। তবে চাকুরিরত বাঙালিরা জীবনের মায়া না করে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। এই উপন্যাসে বাস্তবতা এমনই সাক্ষ্য দেয়।

মূলত যুদ্ধকে বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক এই উপন্যাসে সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি ইত্যাদির সাবলীল বর্ণনা হাজির করেছেন। যেহেতু নিজের জীবনের কাহিনি বর্ণনা করছেন, তাই ভাষার জটিলতা এখানে নেই। সাবলীল এক গল্পকথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন লেখক। ফলে, উপন্যাসটি সুখপাঠ্য। মুক্তিযুদ্ধের এমন প্রত্যক্ষ বয়ান ইতিহাসের দলিল হিসেবেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।