গুচ্ছকবিতায় প্রভাত মণ্ডল
১. স্বাধীনতার স্বাদ
অগণিত মানুষের ভীড় , পথের প্রান্তে প্রান্তে ,
তিয়াত্তর বছরের স্বাধীনতার স্বাদ সবার চোখে-মুখে
তবুও কোথাও যেন একটা বিষাদের ছোঁয়া !
ইঁট ভাটায় গেলে দেখতে পাবে স্বাধীনতা ,
দেখতে পাবে ফুটপাত আর রেল লাইনের ধারেও ।
একে অপরকে টেক্কা দিয়ে যত তেরাঙ্গা কেনা হয় !
আর ষোলোই আগষ্ট তা ছিন্ন হয়ে পথে পড়ে থাকে ,
তা দিয়ে তো তেরাঙ্গা মোরা জামা হয়ে যায় বহু !
ওদের শরীরে বস্ত্র দরকার , আর তা যদি হয় তেরাঙ্গা !
তবে ওদের মান বাঁচে ! ওরাও উপভোগ করতে পারে
স্বাধীনতার স্বাদ ; প্রথাগত শিক্ষার দরজায় না পৌঁছেও
জানতে পারে ইতিহাস , ভারতের গৌরবগাঁথা , আমরাও
গর্ব করে বলতে পারি ! ভারত আমার মানব প্রেম ,
ভারত জন্মভূমি , হে ভারত বিশ্বস্রষ্ঠা তুমি ।
২. পরের বার জন্ম নেবো
পরের বার জন্ম নেবো , কি হব জানিস !
সূর্যের প্রথম আলোক বিন্দুর একটা কণা হব ,
তোকে ঘুম ভাঙাবো আলতো করে ছুঁয়ে !
একটা পাখি হব ! সেই কাকভোরে যখন তোর ঘড়ির
অ্যলামটাও বন্ধ হবে , ঠিক তক্ষুনি আমি তোদের
চিলেকোঠায় বসে , তোকে মিষ্টি সুরে গান শোনাবো ।
কি হব জানিস !
তোর প্রথম প্রাতে খোলা জানলার বাইরের
মুক্ত সাদা ধবধবে আশ্বিনের মেঘ হব ! তোর ঘরের
বাইরের উঠোনের কোণের একগুচ্ছ কাশফুল হব ! তুই
মিষ্টি করে হাত বোলাবি , আর আমি ব্যর্থ ভালোবাসার
সুখ সেদিন মনে প্রাণে উপলব্ধি করবো ।
কি হব জানিস !
তোর ঘরের দ্বারের প্রথম প্রাতের শিশির হব !
তুই ঘুম থেকে উঠে দলে পিষে আমাকে মাড়িয়ে যাবি !
ক্ষত বিক্ষত করবি আমার সমস্ত শরীরটাকে !
আর আমি সেই ব্যথার মাঝেই পরম সুখ পাবো !
পরের বার জন্ম নিয়ে কি হব জানিস !
তোর খোঁপায় বাঁধা ফুল হব , রাঙিয়ে তুলবো তোকে
সযতনে ! আমি চুপটি করে সেথায় বসে তোর
আঁখির পানে চেয়ে রবো ! তোর চোখের তারায় ,
তোর মুখের পানে , শুধু অবাক হয়েই হারিয়ে যাবো !
কি হব জানিস ! জানিস বুঝি !
তোর কাঁখের কলস হব , তুই আমাতে জল ভরবি ,
আমি সে ভারে জীবন সুখে মিলিয়ে যাবো !
কোনোদিন টুক করে আঘাত লেগে যখন ভেঙে পড়বো !
আর তুই আফসোস করবি ! আমি তখন !
আমি তখন কান্না ভাঙা বুক নিয়ে , বোবা হয়ে ,
তোর পথের পাশেই লুটিয়ে রবো ।
কি হব জানিস ! জানিস বুঝি !
৩. কি জানি
তমসা ঘিরিয়া শুধুই ছায়া
হেথা আলোক বুঝি মায়াময় কায়া ,
ধরণী ব্যাপীয়া এ কোন আঁধার
পাপেতে ডুবিয়া পুণ্য ভূধর ,
করুণ নয়নে চায় ।
লুকায়েছে বুঝি প্রাতের তপন
দেখিছে সে কোন অজানা স্বপন ,
তাহে বুঝি আজ উদিতে মানা
বসুধা তাহার চির অজানা ,
তাই মিছিমিছি খেয়া বায় ।
আঁখিতে আগুন জ্বলে ধ্বক ধ্বক
জিহ্বা শুধুই করে লকলক ,
স্থার্থেতে গোটা দুনিয়া ছোটে
যে যাহা পারে তাহাই লোটে ,
মানবের , একি বিচিত্র বেশ ।
হিংসায় ভরা লোলুপ দৃষ্টি
অর্থের প্রতি নেশার বৃষ্টি ,
ভুলিয়াছে আজ সমগ্ৰ সু-রুচি
লহিয়াছে তুলে শুধুই কু-রুচি ,
এ সবই বুঝি , আধুনিকতার রেশ ।
কি জানি কবে উদিবে রবি
ঘুচায়ে সমগ্ৰ পাপ ,
আবিরে আবিরে ভরিবে ভুবন
ত্যজিয়া সমগ্ৰ শাপ ।
৪. সত্য ও সৎ
আজ বৃষ্টিতে ভেজা চোখের পাতায়
কাল রঙিন পৃথিবী তোমার পলক ছোঁবে ,
দিগন্তের স্বপ্নিল প্রহরীরা তোমারই দরজা আঁকড়ে
দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ; তুমি সৎ , তুমি সত্য , তুমি সুন্দর
পুঞ্জীভূত অন্ধকারেও তুমিই এক চিলতে পথ ।
অহংকারীর ভৎসনা আর অবমাননা
তোমাকে গ্ৰাস করুক প্রতি ক্ষণে ,
তুমি নির্বিকার চিত্ত নিয়ে পাষাণ হয়ে সও
বাড়তে দাও ওদের অহংকার ; চুপিসারে তিলে তিলে ,
ওদের স্বপ্নের শহর ধ্বংস হবে ওদেরই অহং বলে ।
ক্লান্ত পৃথিবী , শ্রান্ত পথিক , সিক্ত আঁখির সুখ
সত্য ও সৎ গড়তে জানে পথিকের ভাঙা বুক ।
৫. মননের মৃত্যু
দুর্দান্ত একটা আঘাত
সোনা রোদেও অমাবস্যার ধারা ,
মনের মৃত্যু ঘটেছে আবার
তবুও মৃত বক্ষে জীবন্ত শুকতারা ।
ভাঙা আকাশে নতুন মেঘের ভেলা
জীবন প্রান্তে নিস্তব্ধ সুখ ,
একটা দুটো স্বপ্নের টুকরো নিয়ে
আশা খোঁজে ভাঙা বুক ।
গোধূলি বেলার আবছায়া আলো
আঁখি তারায় সেই চেনা ছবি ,
মননের মৃত্যু হয় বারেবার শতবার
আঁধার ত্যজিয়া ওঠে পুনঃ রবি ।