“রথযাত্রা Special” রম্য রচনায় ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

রথ না দেখে কলা বেচা

শিরোনামে লেখা বাক্যটি আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । কারণ রথ নিয়ে আমার তেমন কোন স্মৃতি বা স্মৃতিকাতরতা নেই । রথের দড়িতে হাতও ছোঁয়াই নি কোনদিন ।কম বয়সে রবিন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’ নাটকটা করেছিলাম । রথ বলতে আমার ভান্ডারে এটুকুই সঞ্চয় । অথচ রথ নিয়ে শব্দ সাজাতে চাইছি ।তবে হ্যাঁ,অনেকের মত শৈশবে আমিও দু একবার রথের মেলায় গিয়েছি, পাঁপড় ভাজা খেয়েছি । কিন্তু তা নিয়ে আর কত শব্দ সাজানো যায়! আসলে তারুণ্য থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত যেখানে কাটিয়েছি সেখানে রথ পার্বণ নেই । শুধু বাংলা খবরের কাগজে যাত্রাদলের গদির বড়বড় বিজ্ঞাপন দেখে বুঝতাম আজ রথ ।সে যাই হোক ।বাংলায় রথকে আমার খুব একটা ভক্তিভাবের পার্বন বলে মনে হয়নি । অবশ্য মাহেশ, মহিষাদল এইরকম কিছু স্থানে যেখানে বিপুল জনসমাগমে আর অর্থ ব্যয়ে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয় সেখানকার কথা পৃথক ।নানান লোককাহিনি সেইসব রথযাত্রা উৎসবকে মহিমময় করে রেখেছে ।তবে একটা বিষয়ে দ্বিমত হবেন না কেউ যে, রথ পেরিয়ে গেলেই বাঙ্গালির সেরা উৎসব দুর্গাপূজার গন্ধ আসা শুরু হয় ।বাঙালির উৎসবের মরসুম শুরু হয় রথযাত্রা দিয়েই ।আষাঢ়ের রথ বাঙালির উৎসব মরসুমের আগাম গন্ধ নিয়ে আসে, শুরু হয় বাঙালির উৎসব মরসুমের কাউন্টডাউন ।
রথযাত্রায় রথের মেলাটাই আসল আকর্ষণ । ছোটদের খেলনা, গ্রামীণ গৃহস্তের নানান কাজের জিনিস, পুতুল আরো কত কি রকমারি জিনিষের পসরা সাজিয়ে বিক্রিবাটা হয় , গ্রামীণ মানুষের সমাগম হয় । শহুরে আমরা এখন শপিং মল আর অনলাইন শপিং এ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, এইসব মেলা টেলায় নাক কুঁচকোয় । কিন্তু রথের মেলাতে যেন এক টুকরো বাংলাকেই খুঁজে পাওয়া যায় । গল্প-কবিতা-গান লোক-কথায় রথের মেলার অনেক কথা আমরা পড়েছি । বঙ্কিমচন্দ্র মাহেশের রথের মেলা দেখতে আসা দুখী বালিকাটিকে নিয়ে উপন্যাস লিখলেন রাধারাণী । দরিদ্র বালিকা রাধারাণী অসুস্থ মায়ের পথ্য জোগাড়ের আশায় বনফুলের মালা গেঁথে রথের মেলায় বিক্রি করতে চেয়েছিল, অকস্মাৎ দুর্যোগের কারণে মালা তার বিকোয় নি । আবার এই রথের মেলাই রাধারাণীর জীবন বদলিয়ে দিয়েছিল। কিংবা মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের ‘সুখদুঃখ’ কবিতাটি । সেটিও রথের মেলা থেকেই উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । রথের মেলার সুখ ও দুঃখ তাঁর কবিতায় ।
“আজকে দিনের মেলামেশা
যত খুশি যতই নেশা
সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি—
এক পয়সায় কিনিছে ও
তালপাতার এক বাঁশি” ।
সুখের পাশে দুঃখও আছে কবিতাটিতে –
“আজকে দিনের দুঃখ যত
নাই রে দুঃখ উহার মতো ,
ওই – যে ছেলে কাতর চোখে
দোকান – পানে চাহি
একটা রাঙা লাঠি কিনবে
একটি পয়সা নাহি” ।

চেয়ে আছে নিমেষহারা ,
নয়ন অরুণ—
হাজার লোকের মেলাটিরে
করেছে করুণ”
হিন্দু ধর্মের অন্যান্য অনেক উৎসবের মত রথযাত্রাও অনার্য ও আর্য সংস্কৃতির মিশ্রণে সৃষ্ট এক লোকাচার । কালক্রমে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি তা আত্মস্থ করে নেয় । লোককথা অনুসারে ১৮দিন ব্যাপি মহাভারতের যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরে সিংহাসনে আরোহন করার পর শ্রীকৃষ্ণ দেহত্যাগের বাসনা করেন । জরা নামক এক ব্যাধের শর নিক্ষেপে তাঁর মৃত্যু হয় এবং এক কাষ্ঠখন্ডে পরিণত হন । জরাব্যাধ পুরীর কাছে সমুদ্রের জল থেকে শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ সেই কাঠ সংগ্রহ করেন ।জরাব্যাধই ছিলেন অরণ্যচারী শবরদের রাজা বিশ্ববসু। বিশ্ব বসু শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষ রূপী সেই কাষ্ঠ খন্ড নীলাচলের অধিপতি ইন্দ্রদ্যুম্নকে দান করেন । ইন্দ্রদ্যুম্ন সেই কাষ্ঠখন্ডকে মন্দিরে সংস্থাপন করেন । দেবলোক থেকে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা মূর্তি নির্মাণ করতে । বিশ্বকর্মা শর্ত আরোপ করেন যে মুর্তি নির্মাণকালে বন্ধ দ্বার খোলা যাবে না । অনেককাল অতিবাহিত হবার পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নির্মাণশালার দ্বার ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করেন । শর্তভঙ্গের ফলে বিশ্বকর্মা মূর্তি নির্মাণ অসমাপ্ত রেখে চলে যান । তখনও মূর্তির হাত, পা চোখ নির্মিত হয়নি । ইন্দ্রদ্যুম্ন সেই অসমাপ্ত মূর্তিই পুরীর মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন । জগন্নাথ দেবের এই অসমাপ্ত মূর্তির জন্যই ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ কথাটির উৎপত্তি ।
একটি প্রচলিত ধারনা অনুযায়ী আদিতে জগন্নাথ ছিলেন কোন অরণ্যচারী শবর জাতিগোষ্ঠীর উপাশ্য দেবতা, এবং রথযাত্রা ছিল কৃষিকার্য ও কৃষির উর্বরতা সম্পর্কিত এক সার্বজনীন উৎসব যেখানে সমাজের ধনী-দরিদ্র একসাথে অংশগ্রহণ করতেন । এই ধারণার যুক্তি অগ্রাহ্য করা যায় না। কারণ রথ অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে অর্থাৎ ভরা বর্ষায়, কৃষিকার্য শুরু করার উপযুক্ত সময়, এবং শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন গোপালক, ও বলরাম হলধর । কালক্রমে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্ম জগন্নাথকে নিজেদের দেবতা হিসাবে গ্রহণ করেছেন ।
পুরাকথা, লোকগাথা যাই থাক, বাঙালি আমোদ প্রিয় ।রথ উৎসবে বাঙালির আমোদের উপাদান বড় কম নয় । একালে অবশ্য বাঙালির রথ বলতে সাহেবদের আয়োজনে বিপুল অর্থ ব্যয়ের ঝকঝকে আয়োজন ইসকনের রথ । নয়তো পাড়ায় পাড়ায় শিশুদের খেলনা রথ টানা ।
রথযাত্রা হল উড়িষ্যা প্রদেশের প্রাচীন ও প্রধানতম উৎসব । বাংলাতেও রথযাত্রা উৎসবের ঐতিহ্যও বহু প্রাচীন । বাংলায় রথযাত্রার সংস্কৃতি সম্ভবত এসেছে শ্রীচৈতন্যর নীলাচল অর্থাৎ‌ পুরী গমনের পরে। শ্রীচৈতন্যর নির্দেশে চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। অনুমান করা হয়, হুগলি জেলার মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের রথই বাংলার প্রাচীনতম রথ। ইতিহাস বলে, চৈতন্য সমসাময়িক জনৈক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরী গিয়ে জগন্নাথ বিগ্রহ দর্শন করে প্রীত হয়ে মাহেশের গঙ্গাতীরে এক কুটিরে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ স্থাপন করেন। পরে শেওড়াফুলির জমিদার মনোহর রায় সেখানে প্রথম একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। সে মন্দির ভগ্ন হয়ে পড়লে কলকাতার বড়োবাজারের মল্লিক পরিবারের নিমাইচরণ মল্লিকের দানে ১২৬৫ বঙ্গাব্দে বর্তমান মন্দির তৈরি হয়। শ্রীচৈতন্যের নির্দেশে তাঁর ভক্ত কমলাকর পিপলাই আনুমানিক ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে বা তার কাছাকাছি সময়ে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর কাছ থেকে জগন্নাথ মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানেও তাঁর বংশধরেরা ওই মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
তো এই মাহেশের রথযাত্রাকে ঘিরে উনিশ শতকের নব্য ধনি বাঙালিদের আমোদের শেষ ছিল না । রথযাত্রার এক পক্ষকাল আগে হয় জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা । স্নানযাত্রা উপলক্ষ্যে মদ, বাঈজি, গণিকা সহযোগে বাজরায় নৌকাবিলাস চলতো । মাহেশের স্নাণযাত্রায় কদর্য বেলেল্লাপনার সেইসব বৃত্তান্ত সেকালের সংবাদপত্রে লেখা আছে। কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোপ্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থে সেই বেলেল্লাপনার শ্লেষাত্মক বিবরন আছে । তা থেকে কয়েক পংক্তি উদ্ধার করছি । “আজ সহরে…গেরস্তর মেয়েরাও বড়ভাই,শ্বশুর, ভাতার, ভাদ্দর-বৌ ও শাশুড়ীতে একত্র হয়ে গেছেন; জগন্নাথের কল্যাণে মাহেশ আজ দ্বিতীয় বৃন্দাবন”।… গঙ্গারও আজ চূড়ান্ত বাহার ! বোট, বাজর্‌ পিনেশ ও কলের জাহাজ গিজগিজ কচ্চে, সকলগুলি থেকেই মাৎলামো, রং, হাসি ও ইয়ারকির গররা উঠচে; কোনটিতে খ্যামটা নাচ হচ্চে, গুটি ত্রিশ মোসাহেব মদে ও নেশায় ভোঁ হয়ে রং কচ্চেন; ……”
এ সব উনিশশতকী বাবুবিলাসের কথা কারই বা আগ্রহ তাতে ! আমার কাছে সামগ্রিক বিচারে রথযাত্রা হলো সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রতীক। ধনি-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ সকলে মিলিতভাবে রশিতে টান দিয়ে রথ বা প্রগতির চাকা কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই রথযাত্রার প্রকৃত তাৎপর্য । রবীন্দ্রনাথের রথের রশি নাটক এই প্রতীক অবলম্বন করেই রচিত। রথের রশি’নাটকটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করে রবীন্দ্রনাথ তাকে পত্রে লিখেছিলেন “মানুষে মানুষে যে সমবন্ধন দেশে দেশে যুগে যুগে প্রসারিত, সেই বন্ধনই এই রথ টানার রশি । সেই বন্ধনে অনেক গ্রন্থি পড়ে গিয়ে মানবসম্বন্ধ অসত্য ও অসমান হয়ে গেছে, তাই চলে না রথ । এই সম্বন্ধের অসত্য এতকাল যাদের বিশেষভাবে পীড়িত করেছে আজ মহাকাল তাদেরই আহ্বান করেছেন তার রথের বাহন রূপে, তাদের অসম্মান ঘুচলে তবেই সম্বন্ধের অসাম্য দূর হয়ে রথ সন্মুখের দিকে চলবে”
নাইবা থাকলো লোকাচারের রথযাত্রার স্মৃতি, প্রগতির রথের রশিতে আমাদের সকলকেই হাত ছোঁয়াতেই হবে ।চিরন্তন সেই আহ্বান –
“আয় রে ছুটে টানতে হবে রশি –
ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি ।
ভিড়ের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে গিয়ে
ঠাই করে তুই নে রে কোন মতে” ।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।