• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক শিল্পকলায় “ছবির ভাষা বোঝা বা দীক্ষিত হওয়া” – লিখেছেন আলবার্ট অশোক (পর্ব – ২)

ছবির ভাষা বোঝা বা দীক্ষিত হওয়া

যারা ছবি আঁকেননা আর যারা ছবি আঁকেন এই দুইশ্রেণির মধ্যে বোঝাবুঝির সেতু খুব কম তৈরি হয়েছে। আর যতটুকু হয়েছে তাতে লেখকের পান্ডিত্য প্রকাশ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে মর্মার্থ বিস্তার লাভ করেনি। এই নিরিখে আমার মনে হয়েছে যারা ছবি আঁকেননা তারাতো বটেই যারা ছবি আঁকেন তাদের অনেকের কাছেই শিল্প সম্পৃক্ত ভাবনা পরিষ্কার নয়। এর কারণ আমাদের আর্থ-সমাজনীতির কৈবল্যতা।
মানুষের ক্ষুধা আহার মিটে গেলে মানুষ মানসিক বিলাসিতায় আসে। সে তখন ভাবে তার সাথে এই পৃথিবীর সম্পর্কগুলি। সে কি চায় সে কি পায়। চাওয়া পাওয়ার মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ। এসব ভাবনাকে ছুঁতে গিয়ে সে সৃষ্টি করে শিল্প সাহিত্য ও বিজ্ঞান।
মানুষের যখন ভাষা সৃষ্টি হয়নি, গুহাতে থাকতো তখন থেকে সে ছবি আঁকে। নিজেকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে—ঝড় বৃষ্টি, তাপ শৈত্য, বন্য পশুর আক্রমণ – ইত্যাদি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে গুহাকে বেছে নিয়েছিল। এই গুহার দেওয়ালে তার দেখা দুনিয়াকে অবসর সময় এঁকে রাখত। এই আঁকাটায় তার মানসিক ছবি ফুটে উঠত। সে কি ভাবছে। সে কি দেখেছে, সে কি করতে চায় ইত্যাদি। চোখ দিয়ে দেখে, গভীর পর্যবেক্ষন করে গুহাতে ফিরে গিয়ে ভাবনাকে রৈখিক রুপ দেওয়া, অন্য মানুষের সাথে ভাবনার অংশ বিনিময় করা- এত্ সহজ কাজ ছিলনা। তখন গুহাবাসীরা এত চালাক ছিলনা। সময়টা ধরা যাক ২৫ ০০০ বছর থেকে ৪০ হাজার বছর পূর্বের। এশিয়া ইউরোপ উভয় ক্ষেত্রেই গুহাচিত্রের অনেক নমূনা পাই।
এই ছবিটি স্পেনের আলতামিরা গুহাচিত্র।
পন্ডিতগন মনে করছেন প্রাথমিক ভাবে বাসস্থান সুন্দর করে সাজানোর জন্য গুহাবাসীরা ছবি আঁকতেন। ছবি আঁকা হয় রেখা দিয়ে, রং ব্যবহার করে।প্রথম দিকে মানুষ গুহার গায়ে যে রঙ ব্যবহার করত তা তাদের নিজস্ব আদিম ভাবনা থেকে। রঙিন মাটি, পাথর সং গ্রহ করে গুড়ো করে জন্তুর হাড়ের মজ্জা দিয়ে মিশিয়ে রং্যের আস্তরণ লাগানো হত।
এই স্তরে শিল্প ভাবনা একেবারেই প্রাথমিক। নিজের মনকে বা ভাবনাকে মেলে ধরা বা অন্য মানুষের সাথে সুন্দরতা ভাগ করা বা ভাবনার সাথে অন্যের প্রতিক্রিয়া জানা।
ফ্রান্সের দক্ষিন পশ্চিমে লাসাক্সে প্রস্তর যূগের অনেক গুহা পাওয়া যাচ্ছে এই ছবিটি তেমনই একটি গুহার। ছবিটি ১৭ ০০০ বছর পুরানো।
এই ছবিটি ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাইসেনা জেলার ভীমভেটকা অঞ্চলের ছবি।
এই ছবিগুলি উত্তর আফ্রিকার গুহা চিত্র। ধরা হয় প্রায় ৩০, ০০০ বছর আগেকার। The cave paintings at Tassili-n-Ajjer
সবাই ছবি আঁকতে পারেননা। যারা পারেননা তারা এই ছবিগুলি দেখে আনন্দ পান এই ভেবে যে আমাদের দেখা জগৎ এই শিল্পীরা কেমন একটি পটে হুবহু এঁকে দিলেন। আলোকচিত্র আবিষ্কার হওয়ার হাজার হাজার বছর আগে এই শিল্পীরা যে ছবি এঁকেছেন তা ঐ সময়ের দর্পন বা ইতিহাস হয়ে উঠেছে।
এর পরের ধাপটাতে আমরা দেখি মানুষের আগ্রহে একটা বিশিষ্টতা এসেছে। সে নারী দেহের মধ্যে যৌনতা ও উৎপাদনের একটা আগ্রহ ও অর্থবহতা খুঁজে পেয়েছে। তার শিল্প নির্মাণের আনন্দ খুঁজে পেল নারী শরীরের যোনিতে মনযোগ দিয়ে। হাত-পা অন্যান্য অঙ্গাদি নির্মাণ এড়িয়ে গিয়ে নারী শরীরকেই দ্রষ্টব্য বস্তু করল।
The Aurignacian culture The name originates from the type site of Aurignac, Haute-Garonne, which is a town in the south-west of France near Toulouse or Andorra.
বাঁদিকের প্রথমটি প্রায় ৪৫,০০০ বছ আগের, দক্ষিন ফ্রান্সে পাওয়া গেছে। পুরানো প্রস্তর যুগের। পরের দুটি ছবি একটা মূর্তীর। ভেনাস অব উইলেনদর্ফ বা উইলেনডর্ফের নারী, ১১.১ সেন্টিমিটার বা ৪.৪ ইঞ্চি উচ্চতা। ধরা হয়েছে, ২৮, ০০০ বছর থেকে ২৫, ০০০ বছর আগের তৈরি। ১৯০৮ সালে যখন প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌রা অস্ট্রিয়ার ক্রেম শহরের (in Lower Austria near the town of Krems) কাছে উইলেনডর্ফ (Willendorf) নামক এক গ্রামে পুরাণ এক প্রস্তর যুগের হদিশ পেয়ে খনন করছিলেন তখন এই ছোট্ট মূর্তীটা পেয়েছিলেন। মূর্তীটা এখন ভিয়েনার একটা যাদুঘরে আছে।
২০০৯ সালে বিজ্ঞানীরা (Hohle Fels cave near Schelklingen in south-west Germany,) জার্মানীতে উপরের এই মূর্তীটা পেয়েছিল। উচ্চতা ২.৪ ইঞ্চি। আনুমানিক ৩৫০০০ বছর আগের। মূর্তীটা নারী শরীরের। সুউচ্চ বুক, পেট, উরু, ও বিশাল যোনী। ভাবা হচ্ছে উর্বরতার প্রতীক। এগুলি পুরাণ প্রস্তর যুগের শিল্প। এখন প্রশ্ন হল মানুষ কবে থেকে এই আঁকা আঁকি শুরু করল। দেখা গেছে, জ্যামিতির নক্সা আফ্রিকার লাল লৌহচূর্ণ শিলাতে (red iron oxide rock) । এরকম অনেক ছোট ছোট ভাস্কর্যের নমূনা পরবর্তী সময়েও পাওয়া গেছে। সেগুলি হাতীর দাঁতের উপর নির্মান।
চেকোশ্লাভিকিয়াতে The Venus of Dolní Věstonice এই মূর্তীটা পাওয়া গেছে। উচ্চতা ৪.৪ ইঞ্চি। এটা পোড়া মাটির তৈরী। এখানেও নারী অঙ্গ বড় বড় করে বানানো হয়েছে। মানে উর্বরতার প্রতীক।
সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার হরপ্পা সংস্কৃতির মূর্তী বাঁ দিকে, আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর, ডান দিকে মেক্সিকোর (from Puebla, Mexico, Tlatilco culture Early-Middle Preclassic period 1300-800 B.C. ) এই দুটি নির্মাণেই তৎকালীন মানুষের ভাবনা বা পর্যবেক্ষণের ছাপ পড়েছে। তারা তখন কি ভাবত, তাদের চিন্তা আচ্ছন্ন থাকত কিসে বা গুরুত্বপূর্ণ কি ছিল তাই তাদের ভাস্কর্যে পাওয়া গেছে।। এই পর্যন্ত আমরা দেখি বৌদ্ধিক ছাপের চেয়ে মানুষের জীবনের প্রধান আগ্রহগুলি শিল্প কলায় স্থান পেয়েছে এবং তা সাদামাটা সরল বিষয়।
(Gravettian culture is a phase (c. 32,000–22,000 ya) পুরাণো প্রস্তর যূগে যখন পাথরের অস্ত্র-শিল্প শুরু হল। অস্ত্রের মাথা গুলো সূঁচালো। বা ধারালো, ঐ সময় মানুষ বাইসন, রেইনডিয়ার, ঘোড়া বা ম্যামথ বা বিশালাকায় হাতী শিকার করতে শুরু করল, সেই যুগ টাকে বলা হয় গ্রাভেটশিয়ান সংস্কৃতি (the site of La Gravette in the Dordogne region of France) এখানে এই নারী মূর্তীটি অদ্ভুত তার নির্মাণ।
ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ্‌রা সোমি ( Somme) নদীর পারে আবিষ্কার করেছেন বিরল নব্য প্রস্তর যুগের মায়ের রুপ।। ৬০০০ বছরের পুরাণো ৮ ইঞ্চি উচ্চতা। কোমর পাছা জুড়ানো, হাত অনেক অস্পস্ট। মাথাটা ছুঁচালো। এটা মাটি পুড়িয়ে বানানো হয়েছে। (নীচে বাঁদিকে)

(Çatalhöyük was a very large Neolithic and Chalcolithic proto-city settlement in southern Anatolia, which existed from approximately 7100 BC to 5700 BC, and flourished around 7000 BCKüçükköy, Çatalhöyük Yolu, 42500 Çumra/Konya, Turkey)
কাটালহোয়ুক এ যে মূর্তীটি পাওয়া গেছে সেটার অবস্থান ছিল একটা শষ্যভান্ডারের উপর। তাকে দেখে মনে হয়েছে তিনি সন্তান জন্ম দিয়েছেন, পেটের চামড়া শিথিল, স্তন ঝুলে পড়েছে ও মুরুব্বীয়ানা ঢংযে বসে আছেন আরাম করছেন। তাই তার মূর্তীটি মাতৃরুপ কল্পনা করা হয়েছে।
তূর্ক এর কাটালহোয়েক পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর, খ্রীষ্ট জন্মের ৭০০০ বছর আগে সেটা স্থাপন হয়েছিল। সেখানে ২০০০ ক্ষুদ্র মূর্তী পাওয়া গেছে, নব্য প্রস্তর যুগের চাষীরা, পিরামিড বা স্টোনহিঞ্জ ইত্যাদি তৈরি করার আগে তারা মেদবহুল মানুষ, ভেড়া ও গরু র প্রতিমূর্তী বানাত। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেছেন এগুলি শিক্ষা বা খেলনার জন্য বানানো হত। পরে ফেলে দেওয়া হত।
ভূমধ্য সাগরীয় অববাহিকায় শক্ত শিলার আশ্রয় গুলিতে (The Roca dels Moros or Caves of El Cogul ) এখানে আমরা দেখছি কিছু মহিলা একটি পুরুষকে ( লম্বা বড় পুরুষাঙ্গ সহ একজন পুরুষ মাঝখানে) ঘিরে নাচ করছে। এটা স্পেনের পাথুরে পাহাড়ের গায়ে আঁকা ৪৫টা নৃত্য ভংগিমা। সময়টা মধ্যপ্রস্তর যুগ থেকে নব্যপ্রস্তর যুগ। প্রায় ৮০০০ বছর আগে। মানুষের সমাজ অনেকটা উন্নত। তারা চাষবাস করে জন্তু জানোয়ার পোষে, ধর্ম ভাবনা শুরু করেছে।
এই অব্দি আমরা দেখছি, মানুষ তার আগ্রহের বিষয় – তার ভাবনা ক্ষমতা, পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা খ্রীষ্টজন্মের পূর্ব অব্দি কিসে সীমিত রেখেছিল। মূলতঃ তার জীবন যাপনে প্রধান বিষয়ঃ শিকার, জন্তু-জানোয়ার ও নারী শরীর বা জনন ও জননী্তে।
জার্মানীতে এই সিংহ মানবের মূর্তীটি পাওয়া গেছে। ৪০, ০০০( চল্লিশ হাজার ) বছর আগের। মানুষের দেহে পশুর মাথা হিসাবে সবচেয়ে পুরাণো এর আগের এমন নজির বিরল। (Löwenmensch figurine, found in the Hohlenstein-Stadel cave of Germany’s Swabian Alb and dated at 40,000 years old, is associated with the Aurignacian culture and is the oldest known anthropomorphic animal figurine in the world)

ঈশ্বরকে আগে যাদুগর বলত। ১৩০০০ বছর আগে ফ্রান্সের একটা গুহায় এই ছবিটি পাওয়া যায়, ধরা হচ্ছে। গুহা মানুষেরা শিকারে যাওয়ার প্রাক্কালে সম্ভবত গুহা মানুষেরা এই ছবিটাকে তুক তাক করে যেত। চার মিটার উচ্চতায় ছবিটা আঁকা যেখানে সাধারনতঃ কেউ ছুঁতে পারবেনা। অনেকটা নাচের ভংগিমায়, দেখতে কিছুটা জন্তুর সাদৃশ্য আছে।
সেটি আবার পুরুষাকার তার যৌনাঙ্গ নীচের দিকে ঝুলে আছে। Trois-Frères, Ariège, France, made around 13,000 BC.
আমি এখানে ছবির ইতিহাস বলছিনা, কিন্তু ছবির ভাষা বুঝাতে এই ছবি গুলে আপনাদের দেখাচ্ছি। আপনারা নিশ্চয়ই এই ছবির ভাষা বুঝতে পারছেন। এই ছবিগুলির নির্মাতা বা শিল্পীরা এই ছবি একেঁ কি বুঝাতে চেয়েছেন, কেন এঁকেছেন আমি এখানে তা পুনরোক্তি করছিনা।
এই ছবিগুলি আমরা সহজে বুঝতে পারি কারণ, এগুলি এমন ভাবে আঁকা দেখলেই মনে হয় বস্তুর কাছাকাছি একটা আদল দিয়ে শিল্পী কোন একটা গল্প বলছে। বা বস্তুটাকে বাস্তব সম্মত রুপ দিয়ে তার আকৃতিটা ধরতে চাইছে।
এই ছবিগুলি বোঝার জন্য আমাদের অসুবিধা হয়নি। গঠনমূলক ও তূলনামূলক শরীরের অঙ্গ প্রত্যংগের অনুপাত ঠিক না হলেও আমরা বুঝে নিই এটাতে শিল্পী কি বলতে চেয়েছেন। এই ছবিগুলি বোঝার জন্য আপনি আগে থেকে মনের মধ্যে ধারণা পুষে রাখেননি। যা দেখছেন তা আপনার ভাবনার সাথে মিলিয়ে চলছেন। এটাই হল ছবি দেখার ঠিক পদ্ধতি। মানে মনটাকে শূন্যতে এনে দেখতে থাকুন শিল্পী তার শিল্প বস্তু দ্বারা আপনার চোখ আর মেধাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা লক্ষ্য করুন। যেগুলি চোখ দেখতে চাইছে, তা দেখুন সব মিলিয়ে নিশ্চয়ি আপনি একটা ভাবনা বা ছবি বার্তা দেখতে পাবেন।
এর পরের ধাপটা কিন্তু আরো উন্নত ধাপ। ছবি অনেক মার্জিত ও গুনমান সমৃদ্ধ হয়ে এসেছে।
খ্রীষ্টের জন্মের ৩০০০ বছর আগে ঈজিপ্ট বা মিশরে শিল্পকলা একটা বিশেষ দিক নিল। কারণ ছিল মানুষের রাজার অধীনে জীবনযাপন। দেখা গেল অনেক উৎকর্ষতার সাথে আঁকা ও ভাস্কর্য একটা বিশেষ ভংগিমা বা প্যাটার্ণ এল।শিল্পী ভাস্কররা পৃষ্ঠপোষকতা পেল। প্যাপিরাস পাতায়, কাঠে,বা পাথরের উপর পেইন্টিং । পেইন্টিংযে দেখা গেল সংকেতের ব্যবহার।
রঙ যা প্রাকৃতিক ভাবে যার যে রঙ হওয়ার কথা তা তারা ব্যবহার করতনা। বিশেষ রঙ বিশেষ বিষয়কে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করত। রাজা থেকে প্রজা, জন্তুজানোয়ার ও দেবতা সবই সংকেতের মাধ্যমে বোঝানো হত। ছবির বিষয় পালটে গেল। রাজা রাজাদের কাহিনী দেবতা ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। পশুপাখি ও সাপদের মাথা প্রতীক হিসাবে ব্যবহার হত।
খটকা লাগতেই পারে মানুষের শরীরে পশুপাখির মাথা কেন? এর জন্য দরকার পড়ল ওদের তথ্য ও বিশ্লেষণ যা সম্পূর্ণ ওদের ভাবনায় নির্ভরশীল।
মিশরীয়দের এই সাংকেতিক আঁকা বা হায়ারোগ্লিফ থেকে অক্ষর সৃষ্টি
Minoan civilization মিনোয়ান সভ্যতা। ব্রোঞ্জ যুগ। ক্রেট ও ঈজিয়ান দ্বীপে, যীশু জন্মের ২৫০০ বছর আগে, অধিক রুচি শীল আঁকার প্যাটার্ণ দেখা গেল। তারা বড় বড় মিউরাল, ফ্রেস্কো, ইত্যাদি বানাত। আসবাব পত্র কোন কিছুর আদলে বানাত। সুন্দর করে মনের সুন্দরতা দিয়ে ছবি আঁকত।
যীশুর জন্মের ১০০০ বছর আগে গ্রীসে শুরু হয়েছিল জ্যামিতিক প্যাটার্ণ। ঐ সময় নানা যুদ্ধ ধ্বংস ইত্যাদি লেগে থাকত। নানা যুদ্ধের পর নতুন ধরণের শিল্প সাহিত্য ইতিহাস রচনা হত। দেখা যায় তাদের মধ্যে বিশেষ দ্বিমাত্রিক প্যাটার্ণে ছবি। দেওয়ালে, আসবাবপত্রে, ফুলদানিতে নানা ধরণের ভাবনার ছবি। নারী নগ্ন পুরুষ, প্রেম, রাজারাণি ইত্যাদি বিষয়ের।
ওদের ভাস্কর্যগুলি অনেক বাস্তব রীতিতে তৈরি। তারা টেরাকোটার বা পোড়া মাটির ভাস্কর্য ও গড়ত।
নব্য প্রস্তর যুগে চীনে টেরাকোটা ও পটারি শিল্প ব্যপকতা পেয়েছিল। শিল্পের বিষয় ছিল জন্তু জানোয়ার ও জীবন যাপন।
তাদের ভাবনায় রাজাদের পূর্বপুরুষ ও ধর্মভাবনা বিদ্যমান।

ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে মানুষ সমুদ্রের উপকূল বেছে নিয়েছিল। তেমনি উত্তর আফ্রিকার উপকূলের। এই রিলিফের ভাস্কর্যটি ৫ম খ্রীষ্টপূর্বাব্দের।
Stamp seal and a modern impression: unicorn or bull and inscription, Mature Harappan period, ca. 2600–1900 b.c সাঁচ বানিয়ে রিলিফের মুর্তী, আঁকিবুকি ও চিহ্নের ব্যবহার. ২) Recumbent mouflon, Mature Harappan period, ca. 2600–1900 b.c. Indus Valley একটা ভেড়ার মূর্তী, ৩) Bowl with painted decoration, ca. 2600–1900 b.c. Excavated at Damb Sadaat (level III), Baluchistan, Pakistan of the Indus Valley একটা বাটি বা পাত্রের গায়ে রেখা কেটে ভালোলাগা বা সুন্দর স্থাপন করা হয়েছে।
Standing female figure, ca. 2600–2400 b.c.; Early Cycladic II এই দাঁড়ানো মূর্তীটি খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০০ বছর। এখানে একটা মার্বেল পাথর খোদাই করে এই মূর্তী বা ভাস্কর্যটি বানানো হয়েছে। একটা অদ্ভুত রুপে। মাথায় নাকটা বোঝা যাচ্ছে। বাকীটা আন্দাজ করে নিতে হবে। পুরো আকৃতিটায় একটা সরলীকরণধর্মী কৌশল নেওয়া হয়েছে। মহিলার মূর্তী কিন্তু স্তন, হাত পা ইত্যাদি নির্মাণের মধ্যে বাস্তবানুগ করেনি। এমনকি যৌনাংগ দুটি দাগ কেটে বুঝিয়ে সেরে গেছে। আমাদের কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এটি একটা মেয়ের আকৃতি। তার দেহের অংগপ্রত্যংগগুলি সম্পর্কে সঠিক বিবরণ পেলামনা। হয়ত শিল্পী এটুকুই দেখাতে চেয়েছেন। বা তার ক্ষমতায় এটুকুই বানানো সম্ভব ছিল। বা ওখানকার শিল্পীরা এইভাবেই মূর্তী বানান, এমন ধারাতে। বা এও হতে পারে বাস্তবের থেকে বিষয়টা আহরণ করে শিল্পী সুন্দর প্রতিমূর্তী এইভাবেই বানালেন। সবসময় চোখমুখ দেখে দেখে আমরা ক্লান্ত, এখানে চোখমুখ না বানিয়ে একটা অন্যস্বাদ দর্শকদের দিতে চাইছেন। শিল্পী যা করেননি তা আমরা ভাবতে যাবনা। যা করেছেন তা থেকে আমরা যা পাই তার মধ্যেই আমাদের ভাবনা মিলিয়ে শিল্প বস্তু দেখা উচিত।
আমাদের মধ্যে এমন হয় যে যখন আমরা শিল্প বস্তুর প্রদর্শনী দেখতে যাই তখন হয় কোন পূর্ব কল্পিত কিছু আমাদের মনে পেয়ে আছে এমন মন নিয়ে যাই। সাধারণতঃ প্রত্যাশা থাকে একটা গল্প পাব। জীবনের সুখ দুখের কিংবা কোন জ্ঞানগর্ভ নীতি কিছু। কিন্তু শিল্পীরা বিভিন্ন ভাবনায় সাধারণ মানুষকে মনোরঞ্জন করতে চান। হয়ত দেখা গেল শিল্পী শুধু রঙ নিয়ে খেলতে খেলতে একটা মজা করেছেন। কোন বস্তুর ছবি সেখানে নেই।। কিবা কিছু আঁকিবুকি দিয়ে লুকোচুরি খেলার মতো কোন বিশেষ ছবি এঁকেছেন। তাতে ১) ভালোলাগাবোধ দিচ্ছে। বা ২) দর্শককে চুপিসারে বিশেষ কোন ঘটনা, গল্প বা মজা দেখাচ্ছেন।
শিল্প কখনো বাস্তবানুগ হয়, কখনো অবাস্তবানুগ হয়। কখনো বিমূর্তকারে ইত্যাদি নানা ভাবে হতে পারে। সব শিল্পাকৃতি আমাদের বোধগম্যে আসবে বা আসতেই হবে এমন কোন শর্ত নেই।
বিভিন্ন মানুষের মেধারস্তর ভিন্নরকমের। সেখানে একজনের ভাষার প্রকাশ ভিন্নরকমের হতে পারে। সমাজের সাধারণ স্তরে যারা বাস করেন তাদের কথার ব্যবহার , শব্দচয়ন, প্রকাশ ভঙ্গী সমাজের বিশিষ্টদের থেকে অনেক আলাদা। একই স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ও দশম শ্রেণীর ছাত্রের বাংলা , অংক ইত্যাদির মধ্যে ফারাক থাকে। গ্রহন করার ক্ষমতার মধ্যেও ফারাক থাকে। কোনকিছু বোঝার জন্যো যোগ্যতা লাগে। যোগ্যতা অর্জন করতে হয় ঘেঁটে ঘেঁটে, বুঝে বুঝে। না বুঝলে ক্ষতি নেই। বুঝলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা টাকায় পাওয়া যায়না। জীবনকে অনেক স্বাচ্ছন্দতায় ভরা যায়। সুখ-দুখ দুশ্চিন্তা সংযত করা যায়, নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কারণ শিল্প হল মেধা চর্চা। অংক চর্চার মতো। যে যত উচ্চ মেধার শিল্প সংস্কৃতির চিন্তা করেন চর্চা করেন তার তেমন সুউচ্চ জীবন বোধ ।
আপনি এতক্ষন ধরে যে ছবি দেখে আসছেন তাতে আপনার চোখ ও মনন একটা বোঝাপড়া করে নিল। এটাকে আমরা বলি দীক্ষিত হওয়া। সবকিছু শব্দে বর্ণে প্রকাশ করা যায়না। কিছু নিজের চোখ কান স্পর্শ ইত্যাদি পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। অনুভবের মাধ্যমে ভাল মন্দের উপলব্দি বা বিচার আসে। এই বিচারক্ষমতা যখন আপনার পূর্ণ হবে আপনি ছবি বুঝতে পারবেন।
মানুষের সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন ভৌগোলিক স্থানে, জীবন যাপনের সাথে যুক্ত বিষয়গুলি যখন শিল্পকর্মে ক্রমশঃ প্রকাশ পেতে লাগল তখন থেকে হঠাৎ করে শিল্প বোঝা কঠিন হয়ে পড়ছিল। শিল্প কর্ম দেখে ভাবা দরকার হয়ে পড়ছিল কখন, কে ও কোথায় বানানো হয়েছিল। আমরা উপরের ছবিগুলি দেখে মানুষের আকৃতি, কাজকর্ম, বেশভূষা ইত্যাদিতে যে ভিন্নতা রয়েছে তা বুঝতে পারি। ভিন্নতা রয়েছে আকাঁর কৌশলে। উপস্থাপনায়। ভিন্নতা আছে সময়ের হিসাব ধরে।
কোন বস্তুর প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি নয়। শুধু রেখা বা আঁকিবুকি মানুষের ভাবনায় চিহ্ন হয়ে, সংকেত হয়ে অর্থবহ হয়েছে। মানুষ রুপ বা আকৃতি ছেড়েও নিজের ভাবনাকে আঁকিবুকির মাধ্যমে প্রকাশের ভাষা খুঁজে নিল। জন্ম নিল বিমূর্ততার। যার রুপ নেই তাকেও রুপ দিয়ে শনাক্তকরণ চলল। রেখার আঁকিবুকি মানুষকে ভাললাগাবোধ এনে দিল। জন্ম নিল অলংকরণ, নক্সার লাবণ্য যাকে আমরা বলি ডিজাইন, প্যাটার্ণ, মোটিফ ইত্যাদি। মিশরের দেওয়াল লিপিতে, চীনের ব্যবহৃত আসবাবে।
আলোকচিত্র, ক্যামেরা বা ফটোগ্রাফির জন্ম ১৮৪০ এর পর ১৯৩৫ এ রঙ্গিন আলোকচিত্র আসে তারও অনেক পর আলোকচিত্রের জনপ্রিয়তা আসে। এই আলোকচিত্র মুহুর্তের মধ্যে কোন বস্তুর রুপ বা আকৃতি ধরতে সক্ষম। আগে শিল্পীরা রাজা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অবয়ব আঁকতেন যাকে আমরা বলি পোর্ট্রেট বা মুখচ্ছবি। বা কোন স্থানের দৃশ্যচিত্র। আলোকচিত্র যন্ত্রটি শিল্পীদের পেশা ও ভাবনায় সঙ্কট নিয়ে এল। ভাবনা হল সুন্দর কিছু সৃষ্টি করতে হবে। শিল্পীরা যন্ত্রের পাশে তাদের অস্তিত্বের মূল্যের প্রতিযোগিতায় নামলেন ও প্রমাণ করলেন যে মানুষের কাছে যন্ত্র অনেক তুচ্ছ।
শিল্প সম্পৃক্ত. প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য এখানে আমি খ্রীষ্টের জন্ম সময় অব্দি এসে থেমেছি। বলতে চেয়েছি ছবি বা ভাস্কর্য মানুষ কেন করে বা আমরা সাধারণরা কিভাবে ছবিটা বুঝব। এই লেখার পর আরেকটি অংশ আমার লেখার ইচ্ছায় রইল যেখানে এই গত ২০২০ সাল শিল্পের নানা বক্তব্য ও আন্দোলন। সেই নিরিখে সাধারণ ছবি কি ভাবে গ্রহন করবে।
পিকাশোর আঁকা Les Demoiselles d’Avignon (1907) ১৯১৬ অব্দি সাধারণের কাছে প্রদর্শিত হয়নি। পিকাশোর বন্ধুরা ভেবেছিল, এই ছবিটার বিষয় পতিতা মেয়েরা আর তাদের এত কুৎসিত করে আঁকা ভীষনভাবে তর্কবিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে।
১৯০০ দিকে আফ্রিকার ঐতিহ্যময় ভাস্কর্যের নান্দনিকতা সমগ্র ইউরোপের শিল্পীদের রুপকল্প বিষয়ে, আংগিক বা স্টাইল সম্পর্কে আমূল নাড়া দিয়েছিল। ফ্রান্সে হেনরি মাতিশ, পিকাশো প্রমুখ। তারা ছবিতে ফ্লাট রঙ চাপাইয়ে, বর্ণের তারতম্য ঘটিয়ে, টুকরো তুকরো জ্যামিতির ঘণক প্যাটার্ণ মিশিয়ে কাজ করতে লাগল।
১৯০৭ সালে পিকাশো প্যারিসের Museum of Mankind এ আফ্রিকার ভাস্কর্যগুলি দেখেন আফ্রিকার ভাস্কর্যগুলি ছিল আইভরি কোস্ট, গাবোন, ডেমোক্রাটিক রিপাব্লিক অব কঙ্গো লিবারিয়া, মালি ও নাইজিরিয়ার অখ্যাত শিল্পীদের।ঐ সময় পূস্তকের মধ্যেও আফ্রিকার শিল্পকলা দেখার সুযোগ ছিল। পিকাশো আফ্রিকার শিল্পকলায় অতিরিক্ত মাত্রায় প্রভাবিত হন।
Les Demoiselles d’Avignon (1907)

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।